ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশে ইসলাম

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২২ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৯
পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশে ইসলাম পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ডে ইসলাম ও মুসলমান।

‘হাজার হ্রদের দেশ’ হিসেবে বিখ্যাত ফিনল্যান্ড। বাল্টিক সাগর-উপকূলের দেশটির অবস্থান ইউরোপের সর্ব উত্তরে। ফিনল্যান্ডের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সুমেরুবৃত্তে অবস্থিত। ১৯৯৫ সালে দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হয়।

দেশটির গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ হলো দীর্ঘায়ত বনভূমি। এগুলোকে ফিনল্যান্ডের ‘সবুজ সোনা’ বলা হয়।

১৯৫০ এর দশক পর্যন্ত ফিনল্যান্ড কৃষিপ্রধান দেশ ছিল। সে হিসেবে বলা যায়, ফিনল্যান্ডে শিল্পায়ন কিছুটা দেরিতেই হয়েছে। পরবর্তীতে শিল্পোন্নয়নে অগ্রগতি পেয়ে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হয় এটি।  

ঘন সবুজারণ্য ও স্বচ্ছ জলের স্রোতস্বিনীতে নয়নাভিরাম ফিনল্যান্ড। প্রাচীরঘেরা প্রাসাদ ও অত্যাধুনিক দালানকোঠার গভীর মিতালি দেখা যায় এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ফিনল্যান্ডের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর হেলসিঙ্কি।

নীল জলরাশি আর প্রকৃতির মিতালি নয়নাভিরাম করেছে ফিনল্যান্ডকে।  ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টের জরিপ অনুযায়ী, ফিনল্যান্ড পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ও বাসযোগ্য দেশ হিসেবে টানা দ্বিতীয়বার স্বীকৃতি পেয়েছে।

ফিনল্যান্ডের জাতীয় ক্রিকেট দলে নুরুল হুদা স্বপন ও তন্ময় নামে দুইজন বাংলাদেশি রয়েছেন। তারা এখন ক্রিকেট মাঠে ফিনিশদের প্রতিনিধিত্ব করছেন।

সৌন্দর্যের আধার ফিনল্যান্ডকে অনেকে ইসলামের উর্বরভূমি মনে করেন।  ছবি: সংগৃহীত

আয়তন ও জনসংখ্যা
ফিনল্যান্ডের এক দশমাংশই জলাশয় আর দুই তৃতীয়াংশ হচ্ছে বনভূমি। মোট আয়তন ৩ লাখ ৩৮ হাজার ১৪৫ বর্গ কিলোমিটার। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, (জুলাই ২০১৮) জনসংখ্যা ৫৫ লাখ ৩৭ হাজার ৩৬৪ জন।

ফিনল্যান্ড দেখতে শিল্পীর রংতুলিতে আঁকা ছবির মতো সুন্দর।  ছবি: সংগৃহীত

ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন জনসংখ্যা‍র দিক দিয়ে ফিনল্যান্ডের অবস্থান তৃতীয়। প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে মাত্র ১৬ জন মানুষ বসবাস করে। সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফিনল্যান্ডে মুসলমানের সংখ্যা লাখেরও বেশি। এদের বেশিরভাগ অভিবাসী। তবে স্থানীয় ও ফিনিশ মুসলমানের সংখ্যাও রয়েছে বেশ।

স্বাধীনতা ও ভাষা 
ফিনল্যান্ড ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর তৎকালীন রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক থেকে স্বাধীনতা লাভ করেন। এর আগে দীর্ঘ সময় সুইডেনের শাসনাধীন ছিল দেশটি। সেজন্য ফিনিশদের সংস্কৃতিতে সুইডিশ ও রুশ প্রভাব রয়েছে। দাফতরিক ভাষা ফিনিশ (৮৭%) ও সুইডিশ (৫.২%)।

মুসলিমদের সঙ্গে মতবিনিময়ে ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী।  ছবি: সংগৃহীত

ফিনল্যান্ডে ইসলামের আগমন
ফিনল্যান্ডে সর্বপ্রথম ইসলামের আগমন ঘটে ১৮০৯ সালে। তখন কিছু তাতার মুসলিম সৈনিক ও ব্যবসায়ী হিসেবে ফিনল্যান্ডে পা রাখে। তাদের নেতৃত্বে ১৮৩০ সালে ফিনল্যান্ডে প্রথম মুসলিম সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়।

১৯১৭ সালে রাশিয়া থেকে স্বাধীন হওয়ার পর সেই মুসলিমরা ফিনল্যান্ডে থেকে যায়। পরে ধারাবাহিকভাবে যুগোশ্লাভিয়া, মধ্য এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা, তুরস্ক, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে থেকে মুসলমানরা ফিনল্যান্ডে বসবাস করতে শুরু করে। ১৯২৫ সালে ফিনল্যান্ডের মুসলিমরা সাইয়েদ উমর আবদুর রহিমের নেতৃত্বে সরকারের কাছে স্বীকৃতি চায়। সে বছরই দেশের সরকার ইসলাম ধর্মকে স্বীকৃতি দেয়।

রমজানে ইফতারের দীর্ঘায়ত দস্তারখানে শরিক হয় ফিনল্যান্ডের জনগন।  ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালে সে দেশে মুসলিমের সংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার জনের মতো। কিন্তু এরপর ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে সংখ্যা। মুসলমানদের সংখ্যা অন্য ধর্মাবলম্বী ও ধর্মহীনদের তুলনায় কম হলেও তাদের দৈনন্দিন জীবনাচার, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সামাজিক বন্ধন ও ধর্মীয় ঐতিহ্যে মুগ্ধ হয়ে বহু ফিনিশ ইসলামে দীক্ষিত হচ্ছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি বছর ইসলাম গ্রহণকারী ফিনিশদের সংখ্যা গড়ে এক হাজার। এদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। তারা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম পুরুষদের বিয়ে করে সংসার গড়ছে।

আকাশ নেমেছে জলে, প্রকৃতি মেতেছে সৌন্দর্য-মাধুরতায়।  ছবি: সংগৃহীত

মুসলিমরা যেসব শহরে থাকে
ফিনল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে মুসলমানদের বসবাস। তবে রাজধানী হেলসিঙ্কিতেই থাকে বেশিরভাগ। এছাড়াও তামপেরে, ব্রুম্বাগ, তুর্কু, কুতা, পারভিনা ইত্যাদি শহরে মুসলমানদের বসবাস রয়েছে। এদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর।

মসজিদ ও নামাজঘর
ধর্মচর্চা ও ইবাদত-বন্দেগির জন্য ফিনল্যান্ডের মুসলমানরা দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার নির্মাণ করেছেন। মুসলিম সংগঠনগুলোর ব্যবস্থাপনায় রাজধানী হেলসিঙ্কি, তামপেরে, তুর্কু, অউলু, জাইভাসকিলা, লাহতি প্রভৃতি অঞ্চলে অনেকগুলো মসজিদ রয়েছে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ও বাসাবাড়িতে সম্মিলিত নামাজঘর রয়েছে (পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার স্থান)।

নামাজ শেষে মসজিদে কয়েকজন ফিনিশ মুসলিম।  ছবি: সংগৃহীত

১৯৪০ দশকের গোড়ার দিকে ইয়ারভেনপা শহরে প্রথম মসজিদ নির্মাণ করা হয়। স্থানীয়দের স্বেচ্ছাশ্রম ও আর্থিক সহযোগিতায় এটির নির্মাণখরচ বহন করা হয়। সর্বশেষ ২০০৯ সালে এই মসজিদটির সংস্কার হয়।

হেলসিঙ্কিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাধ্যমে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় মসজিদ ও দারুল আমান মসজিদ নামে দুইটি মসজিদ পরিচালিত হয়। মসজিদ দুইটির সার্বিক কার্যক্রম চলে ভাড়া করা ভবনে।

প্রকৃতি হেসেছে রূপের আভায়।  ছবি: সংগৃহীত

মসজিদভিত্তিক কার্যক্রম
ফিনল্যান্ডে মসজিদকেন্দ্রিক দাওয়াতি কার্যক্রম ও ত‍ৎপরতা পরিচালিত হয়। অধিকাংশ মসজিদের আওতাধীন পাঠাগার, কমিউনিটি হল, পবিত্র কোরআন শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। দুই-চারটি মসজিদে নারীদের নামাজ আদায়ের আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে।

মুসলিম সংগঠন ও সংস্থা
ফিনল্যান্ডের মুসলিমরা আধুনিক ইসলামী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে প্রথম ১৯৫২ সালে। এর নাম ফিনিশ ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশন। অন্যদিকে আরব বংশোদ্ভূত মুসলমানদের মাধ্যমে পরিচালিত সংগঠন ‘ইসলামিক সোসাইটি অব ফিনল্যান্ড’ও রয়েছে। ১৯৮৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

একসঙ্গে নাস্তা করছেন কয়েকজন ফিনিশ মুসলিম নারী।  ছবি: সংগৃহীত

তাছাড়া মুসলিমরা হেলসিঙ্কিতে ইসলামিক সেন্টার ও যুব ফাউন্ডেশনও প্রতিষ্ঠা করেছে। মসজিদ, শিশুদের স্কুল, দেশীয় অনুষ্ঠানের ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আলাদা আলাদা কনভেনশন সেন্টার, পাঠাগার ও অভ্যর্থনাকেন্দ্র ইত্যাদি ইসলামিক সেন্টারের আওতাধীন রয়েছে। তারা ফিনল্যান্ডের ভাষায় পবিত্র কোরআনও অনুবাদ করেছে।

রাজধানী ছাড়াও তামপেরে, তুর্কু, ব্রুম্বাগ, কুটা ও প্যারভিনা ইত্যাদি শহরে ইসলামিক সেন্টার রয়েছে। তবে হেলসিঙ্কি ও তামপেরের ইসলামী সংস্থা দুইটিই সবচেয়ে বড়। উভয়টির মাঝে দারুণ সমন্বয় ও বোঝাপড়া রয়েছে। সবগুলো সংস্থা ও সেন্টার একসঙ্গে মিলে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো করে থাকে।

ইসলাম গ্রহণের পর ফিনিশ দম্পতি।  ছবি: সংগৃহীত

বাধা নেই মসজিদ ও ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণে
বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ধর্মচর্চা, ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণ ও ধর্ম প্রচারের সুযোগ রয়েছে ফিনল্যান্ডে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। পৃথিবীর সর্ববৃহ‍ৎ এভানজেলিক্যাল লুথেরান গির্জা এখানেই অবস্থিত। অবশ্য দেশের শতকরা ২০ ভাগ মানুষের কোনো ধর্মীয় পরিচয় নেই।

হিজাব পরতেও নেই প্রতিবন্ধকতা
হিজাব পরার ক্ষেত্রে ফিনল্যান্ডে সরকারি কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। হেলসিঙ্কির বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ে, পথঘাট ও শপিংসেন্টারে ইসলামী পোশাকে মেয়েদের অবাধ বিচরণ দেখা যায়। স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ ও কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গেও মুসলমানদের রয়েছে চমত্কার সম্পর্ক। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ফিনল্যান্ড সরকার ইউরোপের অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি মুসলিমবান্ধব।

বরফ আবৃত হ্রদ।  শ্বেত-শুভ্র তুষার।  সঙ্গে একটি স্বপ্নবাড়ি।  ছবি: সংগৃহীত

মুসলিম শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থা
ফিনল্যান্ডের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাদের সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষা দেন পারিবারিকভাবে। মসজিদকেন্দ্রিকও প্রয়োজনীয় ধর্মশিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। স্কুল পর্যায়েও ইসলাম-শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। কোনো বিদ্যালয়ে যদি মুসলিম শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ে তাহলে সরকারি অনুমতিক্রমে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি শিক্ষার ব্যবস্থার সুযোগ রয়েছে।  

একটি স্কুলে মুসলিম নারী শিক্ষার্থীরা।  ছবি: সংগৃহীত

ফিনল্যান্ডের ১১টি মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েদের ধর্মশিক্ষার জন্য সরকার অনুমোদিত পৃথক পাঠক্রম রয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নবদীক্ষিত ফিনিশ মেয়েরা। দেশের শিক্ষামন্ত্রণালয় সরকারি স্কুলে ইসলাম-শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতি বছর পাঠ্যবই বের করে।

অন্যদিকে হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ রয়েছে। এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের স্নাতক, মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রিও দেওয়া হয়।

বরফের কুহেলিকা এসেছে বাড়ির দুয়ারে।  ছবি: সংগৃহীত

সব কিছু বিবেচনায় মুসলিমবান্ধব দেশ ফিনল্যান্ডে মুসলমানরা বেশ শান্তিতে আছেন। নারী-পুরুষ সবাই ধর্মানুরাগী। আচরণে ও উচ্চারণে অত্যন্ত মার্জিত ও রুচিশীল এবং ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল।

ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৫২২ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৯
এমএমইউ/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।