অনলবর্ষী এ রোদ্দুরে বৃষ্টি নেমে এলে স্বস্তি মিলবে। প্রশান্তি ও রহমতের বারিবর্ষণে সিক্ত হবে ওষ্ঠাগত প্রাণ।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি কি দেখ না, আল্লাহ সঞ্চালিত করেন মেঘমালাকে, তারপর তা একত্র করেন এবং পরে পুঞ্জীভূত করেন, অতঃপর তুমি দেখতে পাও তার মধ্য থেকে নির্গত হয় বারিধারা। ’ (সুরা নুর, আয়াত : ৪৩)।
সবুজাভ প্রকৃতি, শ্যামলি-নিসর্গ ও বনভূমির মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা প্রকৃতিকে সজীব ও প্রাণবন্ত করেছেন। সৃষ্টিকুলের জীবনধারণের সব উপকরণ তিনি পরিমিতভাবে ও যথাস্থানে স্থাপন করে রেখেছেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন, অতঃপর আমি এর মাধ্যমে সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি। অতঃপর আমি এ থেকে সবুজ ফসল নির্গত করেছি, যা থেকে যুগ্ম বীজ উৎপন্ন করি। খেজুরের কাঁদি থেকে গুচ্ছ বের করি, যা নুয়ে থাকে এবং আঙ্গুরের বাগান, জায়তুন, আনার পরস্পর সাদৃশ্যযুক্ত ও সাদৃশ্যহীন। বিভিন্ন গাছের ফলের প্রতি লক্ষ্য করো, যখন সেুগুলো ফলন্ত হয় এবং তার পরিপক্কতার প্রতি লক্ষ্য করো। নিশ্চয় এগুলোতে ঈমানদারদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। ’ (সুরা আনআম, আয়াত: ৯৯)
রোদ-বৃষ্টি দুইটিই আল্লাহর দান। আল্লাহর রহমত ও নেয়ামত। কৃষি কাজ ও শস্য ফলানোসহ মানবজীবনের অনেক ক্ষেত্রে বৃষ্টি যেমন প্রয়োজন, রোদ-গরমও তেমন জরুরি। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে কোনোটার মাত্রা কম-বেশি হয়। মানুষের আমল ও কর্মের কারণে প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসে বলে কোরআন-হাদিসে এসেছে।
তীব্র তাপপ্রবাহে বৃষ্টি না হলে, বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হয়। অনেক সময় মানুষজন অসুবিধা ও কষ্টে ভোগেন। তখন প্রয়োজন পূরণের জন্য আল্লাহর দরবারে বৃষ্টি কামনা করে দোয়া করা সুন্নত। আরবিতে এটাকে ‘ইসতিসকা’ বা ‘সিক্তকরণের দোয়া’ বলা হয়।
আর বৃষ্টি প্রার্থনায় সম্মিলিতভাবে জামাতে দুই রাকাত নামাজও আদায় করা হয়। এটাকে বলা হয় ‘সালাতুল ইসতিসকা’। ইমাম সাহেব কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে দুই হাত প্রসারিত করে রহমতের বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেন। মুসল্লিরাও তখন কায়মনোবাক্যে দোয়া-প্রার্থনা করেন। বস্তুত পাপমোচনের জন্য আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠ অন্তরে তওবা-ইস্তেগফার করতে হয়। কেউ অন্যের হক বা মানবাধিকার নষ্ট করলে, তা ফেরত দিয়ে দোয়া করতে হয়। তবেই আল্লাহ তাআলা মানুষের মনোকামনা পূরণ করেন এবং বৃষ্টি দিয়ে নিসর্গ সিক্ত করেন।
‘ইসতিসকা’র নামাজপ্রসঙ্গে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এ লেখায় কয়েকটি বিবৃত হলো। আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) নামাজের নির্ধারিত স্থানে গিয়ে ইসতেসকার নামাজ পড়লেন। যখন কেবলামুখী হলেন, তখন তিনি তার চাদরটা উল্টিয়ে নিলেন। ’ (মুসলিম, হাদিস নং: ১৯৪৭)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) একদিন ইস্তেসকার উদ্দেশে বের হলেন। তিনি লোকদের দিকে পিঠ রেখে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন এবং কেবলার দিকে মুখ করে তার চাদরটা উল্টিয়ে নিলেন। অতঃপর তিনি দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন। (মুসলিম, হাদিস নং: ১৯৫০)
আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি জুমার দিন মসজিদে নববীতে ‘দারুল কাজা’র (বিচারালয়) দিকে স্থাপিত দরজা দিয়ে প্রবেশ করে। এ সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। সে রাসুলুল্লাহর (সা.) দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে, হে আল্লাহর রাসুল! (অনাবৃষ্টির ফলে) ধন-সম্পদ বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জীবিকার পথ রুদ্ধ হয়ে আসছে। অতএব আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, যেন তিনি আমাদের মেঘ দান করেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) দুই হাত উঠিয়ে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের মেঘ দিন। ’ (আমাদের ফরিয়াদ শুনুন! আমাদের ফরিয়াদ শুনুন!)
আনাস (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম! এসময় আসমানে কোনো মেঘ বা মেঘের চিহ্নও ছিলো না। আর আমাদের এবং সালা পাহাড়ের মাঝে কোনো ঘর-বাড়ি কিছুই ছিলো না। (ক্ষণিকের মধ্যে) রাসুল (সা.) এর পেছন থেকে ঢালের মতো একখণ্ড মেঘ উদিত হয়। একটু পর তা মাঝ আকাশে এলে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং বৃষ্টি শুরু হয়। আল্লাহর কসম! এরপর আমরা সাপ্তাহ খানেকের মতো সূর্য আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। অতঃপর পরবর্তী জুমায় আবার এক ব্যক্তি ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করে। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। সে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সামনে দাঁড়িয়ে বললো, হে আল্লাহর রাসুল! ধন-সম্পদ সব বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পথ রুদ্ধ হয়ে আসছে। অতএব আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, যেন তিনি বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আবার হাত উঠিয়ে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের অবস্থা পাল্টে দাও। আমাদের ওপর এ অবস্থা চাপিয়ে দিওনা। হে আল্লাহ! পাহাড়ি এলাকায়, মালভূমিতে, মাঠের অভ্যন্তরে ও গাছপালা গজানোস্থলে তা ফিরিয়ে নিয়ে যাও। ’
এরপর বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে গেল। আমরা বের হয়ে সূর্য-কিরণে হাঁটাচলা করতে শুরু করলাম। (মুসলিম, হাদিস নং: ১৯৫৫)
আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত আরেক হাদিসে এসেছে, একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সময়কালে মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়। ওই সময় একদিন জুমার দিনে রাসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বারে বসে লোকদের সামনে জুমার খুতবা দিচ্ছিলেন। এক বেদুঈন দাঁড়িয়ে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! ধনসম্পদ বরবাদ হয়ে গেলো, সন্তান সন্ততি ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েছে। ’ অবশিষ্ট হাদিস পূর্বোক্ত হাদিসের অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। তবে এ বর্ণনায় আরও আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহুম্মা হাওয়ালাইনা ওয়ালা-আলাইনা’। (অর্থাৎ: হে আল্লাহ! আমাদের আশপাশে দিন, আমাদের ওপর নয়। )
এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) হাত দিয়ে যেদিকেই ইশারা করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে সেদিক ফর্সা হয়ে গেছে। এমনকি আমি মদিনাকে আয়নার মতো পরিষ্কার দেখতে পেলাম। আবার অন্যদিকে ‘কানাত’ নামক প্রান্তরে একমাস ধরে পানির ধারা বয়ে যায়। কোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ এসেছে, সে-ই অতি বৃষ্টির সংবাদ দিয়েছে। (মুসলিম, হাদিস নং: ১৯৫৬)
তাই আসুন দুর্বিষহ এ সময়ে শান্তির বৃষ্টি চেয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করি। সম্ভব হলে ‘সালাতুল ইসতিসকা’ বা বৃষ্টির নামাজ পড়ি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।
ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১২২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৯
এমএমইউ