হজ-ওমরাহ উপলক্ষে পুণ্যার্থীরা যখন মদিনা মুনাওয়ারায় আগমন করেন, তখন তাদের হৃদয়-মানসে ভিন্ন রকম আমেজ কাজ করে। রাসুল (সা.)-এর শহরের ভালোবাসা তাদের মোহিত করে।
মদিনায় অবস্থানকালীন অনেকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো ঘুরে আসেন। এটা অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যে পরিণত হয়। মসজিদে নববী ছাড়াও মদিনার বিভিন্ন স্থানে রাসুল (সা.) ও তার প্রিয় সাহাবাদের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
নিছক ভ্রমণের জন্যও মদিনাতে আকর্ষণীয় স্থানের অভাব নেই। পাঠকদের জন্য মদিনার চমৎকার ১২টি স্থানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হল।
মসজিদে কুবা
ইসলামের ইতিহাসে নির্মিত প্রথম মসজিদ এটি। মসজিদে নববী থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মসজিদটি রাসুল (সা.)-এর হিজরতের সময় কুবায় অবস্থানের সময় নির্মাণ করা হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করে কুবার মসজিদে এসে নামাজ আদায় করবে, সে ওমরার সওয়াব পাবে। ’ (ইবনে মাযাহ)
মসজিদে জুমা
মদিনায় হিজরতের পর রাসুল (সা.) প্রথম এই স্থানে জুমার নামাজ আদায় করেন। পরবর্তীতে এখানে একটি মসজিদ তৈরি করা হয়। এ মসজিদে রাসুল (সা.) নামাজ আদায়ের পর থেকে মসজিদটির নাম ‘মসজিদে জুমা’ করা হয়। মসজিদে কুবা থেকে ৯০০ মিটার উত্তরে এবং মসজিদে নববীর ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে মসজিদটি অবস্থিত।
মসজিদে জিরার
মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য মদিনার মুনাফিকরা মসজিদে কুবার নিকটে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিল। ইতিহাসে মসজিদটি ‘মসজিদে জিরার’ নামে পরিচিত। পরবর্তীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে রাসুল (সা.) মসজিদটি ধ্বংস করে দেওয়ার আদেশ দেন। রাসুল (সা.)-এর আদেশে মুসলমানরা মসজিদরূপী মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রের এই আখড়া ধ্বংস করে দেন।
ধ্বংসস্তুপটি বর্তমানেও বিরাজমান রয়েছে। কোরআনে এই সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আর যারা একটি মসজিদ স্থাপন করলো ক্ষতিসাধনের ও অবিশ্বাসের জন্য, আর বিশ্বাসীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে, আর তার ঘাঁটি স্বরূপ যে এর আগে আল্লাহ্ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল...” (সুরা তওবা, আয়াত: ১০৭)
মসজিদে গামামা
মসজিদে নববীর ৫০০ মিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এই মসজিদটি অবস্থিত। রাসুল (সা.) ও তার সাহাবিরা এই স্থানে ঈদের নামাজ আদায় করতেন বলে বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে। পরবর্তীতে খলিফা উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রা.) এর শাসনামলে এখানে মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
একবার অনাবৃষ্টির সময় বৃষ্টি কামনায় রাসুল (সা.) ও তার সাহাবিরা এই স্থানে নামাজ আদায় করেন। তখন থেকে মসজিদটির নাম মসজিদে গামামা (মেঘের মসজিদ) নামকরণ করা হয়।
মসজিদে আবু বকর
মসজিদটি মসজিদে গামামার নিকট অবস্থিত। ইসলামের ১ম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.)-এর সম্মানে খলিফা উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) এর শাসনামলে এটি নির্মাণ করা হয়।
মসজিদে আলী
এটি মসজিদে আবু বকরের নিকট অবস্থিত। ইসলামের ৪র্থ খলিফা হযরত আলী (রা.)-এর স্মরণে খলিফা উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) এর সময়ে এটি নির্মিত হয়।
মসজিদে বিলাল
ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মুয়াজ্জিন হজরত বিলাল ইবনে রাবাহ (রা.) এর স্মরণে নির্মিত এই মসজিদ। মসজিদে নববীর নিকট খানিকটা দক্ষিণ-পূর্বে এটি অবস্থিত।
উহুদ পাহাড়
মদিনার উত্তরে অবস্থিত উহুদ পাহাড়। উহুদের নিকটবর্তী উপত্যকায় তৃতীয় হিজরিতে ইসলামের ইতিহাসে ২য় গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ১০৭৭ মিটার উচ্চতার এই পাহাড়ের পাদদেশে যুদ্ধের সব শহীদকে কবর দেওয়া হয়।
মসজিদে কিবলাতাইন
এটি মসজিদে নববীর উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। মসজিদটি রাসুল (সা.) এর সমকালীন একটি মসজিদও বটে। দ্বিতীয় হিজরিতে এই মসজিদেই নামাজ আদায় করছিলেন রাসুল (সা.)। তখন নামাজ থাকা অবস্থাতেই জেরুসালেমের মসজিদুল আকসা থেকে মক্কার পবিত্র কাবা ঘরের দিকে কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশ নাজিল করা হয়। কেবলা পরিবর্তন থেকে এই মসজিদকে ‘মসজিদে কিবলাতাইন’ বা দুই কেবলার মসজিদ নামকরণ করা হয়।
খন্দকের যুদ্ধক্ষেত্র
পঞ্চম হিজরিতে আরবের সম্মিলিত মুশরিক বাহিনীর আক্রমণের প্রেক্ষিতে রাসুল (সা.) হজরত সালমান আল-ফারেসি (রা.) এর পরামর্শে মদিনার প্রতিরক্ষায় মদিনার উত্তর সীমান্তের উন্মুক্ত স্থানে খন্দক খনন করেন। খন্দক খননের কারণে এই যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে খন্দকের যুদ্ধ নামে পরিচিত।
বর্তমানে খন্দকের কোনো চিহ্ন না থাকলেও এখানে খন্দক যুদ্ধের স্মৃতিস্বরূপ সাতটি মসজিদ নির্মাণ করে রাখা হয়েছে। সবগুলো একত্রে ‘মাসাজিদ আসসাবায়া’ (সাত মসজিদ) নামে পরিচিত।
ওয়াদি জ্বিন
মদিনা থেকে ৩০-৪০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত একটি ঢালু উপত্যকা। মূলত কিছু অতিলৌকিক কারণে এই স্থানটি ভ্রমণার্থীদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। এর ঢালে যদি পানি গড়িয়ে দেওয়া হয়, তবে ঢালের উঁচু অংশে পানি গড়িয়ে যায়।
বিরে শিফা ও বিরে উসমান
মদিনার একটি দূষিত ও বিষাক্ত পানির কূপ ছিল বিরে শিফা। পরবর্তীতে রাসুল (সা.) এখানে থুথু নিক্ষেপ করে আল্লাহর কাছে দোয়া করলে এর বিষাক্ত পানি সুপেয় পানিতে পরিণত হয়।
অপরদিকে মদিনার অন্যতম সুপেয় পানির উৎস ছিল বিরে উসমান। শুরুতে এই কূপটি মদিনার এক ইহুদির মালিকানাধীন ছিল। সে চড়া মূল্যে কূপটির পানি বিক্রি করতো। পরবর্তীতে হিজরতের পর হজরত উসমান (রা.) ইহুদির নিকট থেকে কূপটি কিনে নেন এবং সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য ওয়াকফ করে দেন। হজরত উসমান (রা.) এর নামে এই কূপের নামকরণ করা হয় বিরে উসমান।
স্থানগুলো ভ্রমণ করে মদিনায় আগত পর্যটকরা বিস্ময়ের মাত্রা অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন। হজ-ওমরাহর পালনের পাশাপাশি ঐতিহাসিক ও ইতিহাস-আশ্রিত অভিজ্ঞতা ও দর্শন লাভ করেন।
ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২২১৭ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০১৯
এমএমইউ