রাসুল (সা.) ও তার উত্তরসূরি মহান খলিফাদের দাওয়াতে সপ্রণোদিত হয়ে দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করতেন। কেউ কেউ আবার শান্তির আদর্শ ইসলাম গ্রহণ না করলেও ‘জিযয়া’ বা কর আদায় করতো।
তৎকালীন পৃথিবীর পরাশক্তি
ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের আগেই পৃথিবীর পরাশক্তি হিসেবে রোম সাম্রাজ্য (বাইজেন্টাইন) ও পারস্য সাম্রাজ্য (বর্তমান ইরান) আত্মপ্রকাশ করে। রোমের সীমানা ছিল সিরিয়া থেকে পশ্চিমে স্পেন পর্যন্ত। আর পারস্যের সীমানা ছিল ইরাক থেকে পূর্বে খোরাসান (আফগানিস্তান) পর্যন্ত।
রোম আর পারস্য উভয়েই যুগের পর যুগ ধরে পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। ৬০৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে রোমানদের সঙ্গে পার্সিয়ানদের যুদ্ধ শুরু হয়। পার্সিয়ানরা একের পর এক রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নিচ্ছিল। রোমানরা ছিল খ্রিস্টান, অন্যদিকে পার্সিয়ানরা ছিল অগ্নিপূজক। এক পর্যায়ে যুদ্ধটা ধর্মীয় যুদ্ধে রূপ নেয়।
৬১৫ খ্রিস্টাব্দে পার্সিয়ানরা দামেশক, বায়তুল মাকদিস পর্যন্ত দখল করে নেয়। পার্সিয়ান সম্রাট খসরু পারভেজ হেরাক্লিয়াসের নিকট যে পত্রটি লিখেছিল, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায় যুদ্ধটা ধর্মীয় যুদ্ধে রূপ নিয়েছিল।
মুসলিমরা যখন রোমানদের পক্ষে
সেসময় মক্কায় রাসুল (সা.) এর সঙ্গে মুশরিকদের নতুন এক ধরনের যুদ্ধ চলছিল। রোমানদের পরাজয়ের খবর শুনে মক্কার মুশরিকরা খুশী হয়েছিল, কারণ পার্সিয়ানরাও তাদের মতো পৌত্তলিক। অন্যদিকে মুসলিমদের সঙ্গে রোমানদের অনেক মিল, উভয়েই নবী, আসমানি গ্রন্থ ও আখেরাত ইত্যাদিতে বিশ্বাসী। তাই রোমানদের এই বিজয়ে মুসলিমরা দুঃখিত হয়েছিল। মুশরিকরা এই নিয়ে মুসলিমদের সঙ্গে ঠাট্টা করতে শুরু করে। তখন আল্লাহ কোরআন নাজিল করলেন, ‘রোমকরা পরাজিত হয়েছে। ’ (সুরা রুম, আয়াত: ২)
পরবর্তী আয়াতে রোমানদের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। ভবিষ্যদ্বাণীটি এমন সময় করা হয়, যখন রোমান সাম্রাজ্যের আর উঠে দাঁড়ানোর কোনো শক্তি নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিকটবর্তী এলাকায় এবং তারা তাদের পরাজয়ের পর অতি শিগগির বিজয়ী হবে, কয়েক বছরের মধ্যে। অগ্র-পশ্চাতের কাজ আল্লাহর হাতেই। সেদিন মুমিনরা আনন্দিত হবে। ’ (সুরা রুম, আয়াত: ৩-৪)
ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন
এ প্রসঙ্গে কোরআনে অনেকগুলো ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। এর একটি হলো রোমানরা কয়েক বছরের মধ্যে বিজয় লাভ করবে। কোরআনের এই বাণী সত্য হয়েছিল। রোমানরা পার্সিয়ানদের থেকে জেরুজালেম এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল হেরাক্লিয়াসের নেতৃত্বে দখল করে। ৬২৪ সালে তারা ইরানীদের সবচেয়ে বড় অগ্নিকুণ্ড ভেঙে ফেলে। (অর্থাৎ ৯ বছরের মধ্যেই রোমানরা পার্সিয়ানদের উপর চূড়ান্তভাবে বিজয় লাভ করে। )
আরেকটি ভবিষ্যদ্বাণীটি হল, ওই সময় মুমিনরা আনন্দ করবে। আগে ও পরের ঘটনা ও আয়াত গুলোতে এটা প্রকাশ্যই ধরা পড়ে, রোমানদের বিজয়ে মুমিনরা খুশী হবে। কিন্তু, যেই সময় রোমানরা পার্সিয়ান দের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করে, ঠিক একই বছর মক্কার মুশরিকদের বিরুদ্ধে মুসলিমরা বদরের যুদ্ধে মুখোমুখি হয়ে বিজয় লাভ করে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘সেদিন মুমিনগণ আনন্দিত হবে। আল্লাহর সাহায্যে। তিনি যাকে ইচ্ছা সাহায্য করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। ’ (সুরা রুম, আয়াত: ৩-৪)
কোরআনের এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হওয়ার পর, মক্কার অনেক মুশরিক ইসলাম গ্রহণ করে। আল হামদুলিল্লাহ। বস্তুত আল্লাহ্ নিঃসন্দেহে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে অবগত। আল্লাহ্ দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সব কিছুই জানেন।
রোমানদের সঙ্গে মুসলমানদের যুদ্ধ
পরবর্তীতে রাসুল (সা.)-এর সময় থকেই রোমের সঙ্গে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের যুদ্ধ শুরু হয়। একবার রাসুল (সা.) হারেস ইবনে ওমায়র আজদি (রা.)-কে এক চিঠি দিয়ে বসরার গভর্নরের কাছে দূত হিসেবে পাঠান। তখন রোমের কায়সারের নিযুক্ত ‘বালাকা’ এলাকার গভর্নর শোরাহবিল ইবনে আমর গাসসানি সেই দূত হারেস ইবনে ওমায়র আজদি (রা.)-কে হত্যা করে। দূতকে হত্যা করা তৎকালীন সময়ে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল ছিল। তাই মুসলমানদের ৩ হাজার সেনাবাহিনী নিয়ে রোমানদের ২ লাখ সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। এটিই ইসলামের ইতিহাসে মুতারযুদ্ধ হিসেবে প্রসিদ্ধ। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) -এর বুদ্ধিমত্তায় সে যুদ্ধে মুসলিমরা জয় লাভ করেন। পরে মুতার যুদ্ধ ও তাবুকের অভিযানের পরে রাসুল (সা.) সবশেষে ওসামা (রা.)-কে সেনাপতি নিযুক্ত করে রোমদের বিরুদ্ধে সর্বশেষ বাহিনী পাঠান।
আবু বকর (রা.)-এর খিলাফত কালে তিনি সে বাহিনীর নেতৃত্ব অপরিবর্তন রেখেই সামনে অগ্রসর হতে বলেন। রাসুল (সা.)–এর ওফাতের পরে যখন ইরাকে বিভিন্ন গোত্র বিদ্রোহ করে বসে, আবু বকর (রা.) তখন মুছান্না (রা.)-কে দিয়ে সুকৌশলে সেই বিদ্রোহ দূর করে ইরাকেই মুসলিমদের এক বিশাল বাহিনী গড়ে তোলেন, যারা ইরাকের মুসলিমদের বিদ্রোহ থেকে শান্তির পথে একীভূত করে ইরানের দিকে এগিয়ে যান।
রোম বিজয়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
এদিকে খালিদ (রা.)-কে মদিনা থেকে ইরাকের দিকে অভিযানে পাঠানোর পরপরই খলিফা আবু বকর (রা.) সেনাপতিদের পতাকা দিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নিজ নিজ এলাকায় পাঠিয়ে দেন। তিনি খালিদ ইবনে সাইদ (রা.)-কে ‘তায়মার’ দিকে [এখানে ওমর (রা.) খালিদ ইবনে সাইদকে সিরিয়াতে পাঠাতে খলীফাকে নিষেধ করেন, কারণ সে রেশমের জুব্বা পরার ব্যাপারে ওমর (রা.) এর সঙ্গে তর্ক করেছিল; অথচ ইসলামে পুরুষদের জন্য রেশমের কাপড় নিষিদ্ধ। ]
ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.) কে ‘দামেশকে’র দিকে, আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.) কে হিমসের (আলেপ্পো) দিকে এবং আমর ইবনুল আস (রা.) কে ফিলিস্তিনের দিকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠান। পথে আবু উবায়দা (রা.) সে বালাকা অঞ্চলের জনগনের সঙ্গে সন্ধির মাধ্যমে ‘বালাকা’ জয় করেন। সিরিয়ায় এটাই প্রথম সন্ধি চুক্তি।
ইয়ারমুকের যুদ্ধ
মুসলিমরা যখন সিরিয়ার দিকে আগমন করেন, তখন রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস ভয় পেয়ে যায়। কারণ সে জানত রাসুল (সা.) শেষ নবী আর তাদের খ্রিস্টান ধর্মের সময় শেষ হয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলা নতুন ও মনোনীত শেষ ধর্ম ইসলামের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন। হিরাক্লিয়াস তখন হিমসে অবস্থান করছিল। আবু বকর (রা.)-এর মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ও তাদের সাহায্যার্থে ছিল ইকরিমা ইবনে আবু জাহেল (রা.)-এর ৬ হাজার সৈন্য।
মুসলিমদের সিরিয়া জয়
হিরাক্লিয়াসের সম্মুখ বাহিনীর দায়িত্বে ছিল জুরজা। যিনি পরে ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পরপরই ইয়ারমুকের জিহাদে শহিদ হন। হিরাক্লিইয়াসের ২ লাখ সৈন্যের বিরুদ্ধে মুজাহিদদের সংখ্যা কম হওয়ায় তারা খলিফা আবু বকর (রা.) এর কাছে সাহায্য চাইলে তিনি খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-কে ইরাক থেকে সিরিয়া যেতে নির্দেশ দেন। খালিদ (রা.) পাঁচ দিন পর তার নয় হাজার মুজাহিদ নিয়ে ইয়ারমুকের যুদ্ধে মূল সেনাপতির দায়িত্বে এসে নিযুক্ত হন। খালিদ (রা.) সেখানে যেয়ে দেখেন মুজাহিদগণ রোমানদের সঙ্গে জিহাদে লিপ্ত। অন্যদিকে তার আগমনের সংবাদ শুনে রোমানরা মুসলিমদের সঙ্গে সন্ধি করার আগ্রহ প্রকাশ করে। আর সিরিয়াই ছিল রোমান সাম্রাজ্যে মুসলমানদের প্রথম জয়কৃত এলাকা।
ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে, যখন ইয়ারমুকের যুদ্ধে দুই বাহিনী প্রচণ্ড লড়াই করছিল, তখন আরব থেকে এক পত্র বাহক এসে খালিদ বিন ওয়ালিদের (রা.) কাছে খলীফার একটি চিঠি দেন। পত্র বাহক খালিদ (রা.)-কে একান্তে নিয়ে গিয়ে বলেন, খলিফা আবু বকর ইন্তেকাল করেছেন, ওমর (রা.) পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত হয়েছেন। ওমর (রা.) আপনার স্থলে মূল সেনাপতির দায়িত্ব দিয়েছেন আবু উবায়দা আমির ইবনে জাররাহ (রা.)-কে। কিন্তু খালিদ (রা.) এই সংবাদ যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত গোপন রাখেন, যেন যুদ্ধরত সাহাবি ও সৈন্যদের মনোবল ভেঙে না যায়।
আজনাদায়নের যুদ্ধ
তৎকালীন ‘মা’ওয়ারের আরবা’ অঞ্চলে আমর ইবনে আস (রা.) এর সঙ্গে রোমানরা যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, সেখানে তার সাহায্যার্থে খালিদ (রা.), আবু উবায়দা (রা.), শুরাহবিল (রা.) ও মুরছাদ (রা.) মুসলিম সৈন্যদের নিয়ে হাজির হলে আজনাদায়নের যুদ্ধ শুরু হয়। এযুদ্ধে রোমানরা ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার। আর মুসলিম মুজাহিদরা ছিলেন মাত্র ৪০ হাজার। অবশেষে মুসলিম যোদ্ধারাই কাফিরদের পরাজিত করেন। কাফিরদের সেনাপতি কায়কালান নিহত হয়।
তথ্যসূত্র:
১. আবুল ফিদা হাফিজ ইবনে কাসির আল-দামেশকি (ইমাম ইবনে কাসির), আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৬-৭ম খণ্ড দ্রষ্টব্য।
২. আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী, আর রাহিকুল মাখতুম।
৩. ইমাম ইবনে কাসির, আবুল ফিদা হাফিজ ইবনে কাসির আল-দামেশকি, তাফসিরে ইবনে কাসির, পঞ্চদশ খণ্ড (ড. মোহাম্মদ মুজীবুর রহমান কর্তৃক অনূদিত), পৃষ্ঠা: ৬২১।
৪. ড. মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ, আসহাবে রাসুলের জীবনকথা [আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.)-এর জীবনী...]।
৫. নসিম হিজাজি, হেজাজের কাফেলা।
লেখক: ইমাম ও খতিব, মসজিদুল আবরার, বারইয়ার হাট পৌরসভা, মিরসরাই, চট্টগ্রাম।
ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২২০২, জুলাই ৩১, ২০১৯
এমএমইউ