সংগ্রাম-সংঘর্ষ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরাও আসা শুরু করেছে। তারা বাংসামোরোতে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হ্রদে ছোট্ট নৌযানে করে ঘোরাফেরা করছেন।
বাংসামোরোর নতুন সরকার (নিজস্ব) কেন্দ্রীয় সরকার থেকে আইনগত ও অর্থনৈতিক লাভের লক্ষ্যে সমান্তরালে এই অঞ্চলের সম্ভাবনাগুলো সর্বাধিক কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে।
বাংসামোরো যেভাবে স্বায়ত্ব শাসন পেল
এ বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ ফিলিপাইনে সদ্য গঠিত মুসলিম স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বাংসামোরোর দায়িত্ব নেন মুসলিম নেতারা। ফিলিপাইনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী রাদ্রিগো দুয়ার্তে মোরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্টের (এমএমএফ) চেয়ারম্যান মুরাদ ইব্রাহিমের হাতে দায়িত্ব তুলে দেন। এর আগে বাংসামোরো অঞ্চলের নেতারা প্রশাসক হিসেবে তারা শপথ নেন। নতুন শপথ নেওয়া এই ৮০ জন প্রশাসক ও সরকারের ৪০ প্রতিনিধি ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংসামারোর সার্বিক দায়িত্ব পালন করবেন।
দীর্ঘ ৪৫ বছরের আন্দোলন ও সংগ্রামের পর অধিকতর স্বায়ত্ব শাসনের এই অধিকার লাভ করেন তারা।
স্বায়ত্ব শাসন পেতে গণভোট
গত ২১ জানুয়ারি ও ৬ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের এ অঞ্চলে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এর ফলাফলের ভিত্তিতেই মূলত মুসলিম বাংশোমারো অঞ্চল আইনি ভিত্তি ও মুসলিমরা নিয়ন্ত্রণের সাংবিধানিক অধিকার লাভ করে।
গণভোটে ১০ লাখ ৭০ হাজার বাসিন্দার মধ্যে ১০ লাখ ৫৪ হাজর ১৭ জন অংশ নেয়। বাংসামোরো আইন অনুযায়ী জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দ্বি-পর্যায়ের গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ফিলিপাইনের নির্বাচন কমিশন গণভোটের ফলাফল ঘোষণা করেন। ঘোষণায় জানান, কোতাবাতোর ৬৩টি গ্রাম ও ১টি শহর মুসলিম বাংশোমারোর অংশ হতে যাচ্ছে। পরে ফিলিপাইন সরকার ও জনগণ গণভোটের রায়কে স্বাগত জানায়।
মুসলিম মিন্দানাওয়ের সীমানা বৃদ্ধি
২০১৮ সালের জুলাইয়ে সরকার ও মোরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্টের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায় ঐতিহাসিক এই গণভোটের আয়োজন করা হয়। এই চুক্তি ‘বাংশোমারো অরগানিক ল’ নামে পরিচিত। মুসলিম মিন্দানাওয়ের সীমানা বৃদ্ধি এবং স্বায়ত্বশাসনের পরিধি বিস্তারের প্রশ্নে এই গণভোটের আয়োজন করা হয়।
গণভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে ফিলিপাইনের ৫টি প্রদেশ, ৩টি মহানগর, ১১৬টি পৌরসভা ও ২৫৯০টি গ্রাম বাংশোমারোর অংশে পরিণত হয়। আয়তনের হিসাবে এখন ফিলিপাইন কংগ্রেসে ৮জন মুসলিম প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পাবেন।
প্রসঙ্গত ২০১৪ সালে ফিলিপাইনের সাবেক স্বৈরশাসক তৃতীয় বেনিনো আকিনোর সময় ফিলিপাইন সরকার এবং মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্টের মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তির আওতায় বাংসামোরোর ‘মৌলিক আইন’ অন্তর্ভুক্ত ছিল। মূলত এটির প্রেক্ষাপটে মিন্দানাওতে বাংসামোরো স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাগোইন্দানাও, লানো দেল সুর এবং সুলু অঞ্চল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বাংসামোরোয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ।
বাংসামোরো যেমন হতে পারে
মিন্দানাওয়ে নতুন আইনটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে এ অঞ্চলের মুসলমানদের আইনি ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দ্বীপপুঞ্জে বিদ্যমান স্বশাসিত অন্যান অঞ্চলগুলোর চেয়েও উন্নত ও সুবিধা দিয়ে স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা করা হবে। নতুন আইন অনুযায়ী বাংসামোরোর স্বায়ত্তশাসিত সরকার ধর্মীয় স্বাধীনতার ভিত্তিতে শরিয়াসম্মত আদালতও গঠন করবে বলে জানা গেছে।
এছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকার মিন্দানাওতে বাংসামোরোর সরকারে কাছে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। তবে বাংসামোরোর পানিসম্পদ এবং জ্বালানি উৎস ব্যবস্থা যৌথ নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
মোরো যোদ্ধারা আঞ্চলিক সেনাবাহিনীতে
অন্যদিকে আইন অনুসারে মরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের সাবেক যোদ্ধারা এবং মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট (এমআইএলএফ)-এর সৈন্যরা সরকারি বাহিনীতে যোগ দিতে পারবে। জানা গেছে, মোরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্টের যোদ্ধারা (এমএমএফ) স্বায়ত্তশাসন চুক্তির পদক্ষেপের ভিত্তিতে ধীরে ধীরে বাংসামোরোর সেনাবাহিনীতে যোগদান করবে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২২ সালে এই প্রক্রিয়াটি দলীয় আইনের অধীন রূপান্তরিত হতে পারে।
বাংসামোরোর সংক্ষিপ্ত আখ্যান
স্বায়ত্বশাসিত মুসলিম এলাকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাওয়া স্বল্পপরিচিত মুসলিম জনপদ বাংসামোরোকে সংক্ষেপে ‘মরো’ বলা হয়। জানা গেছে, ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলীয় মিন্দানাও অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত এ জনপদের জনসংখ্যা ২ কোটি ৫৬ লাখ। এর ৯২ শতাংশই মুসলিম ধর্মাবলম্বী।
আরো পড়ুন: স্বায়ত্তশাসিত মুসলিম এলাকা গঠনে ফিলিপাইনে গণভোট
বাংসামোরোর সংগ্রাম ও লড়াইয়ের ইতিহাস সুদীর্ঘ। শতবছর ধরে মোরোরা নির্যাতিত ও নিপীড়িত ছিল। স্প্যানিশ ও বৃটিশ উপনিবেশবাদের মাধ্যমে মোরো মুসলিমরা নির্যাতিত হওয়ার পর গত ৫০ বছর ধরে ফিলিপাইন সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রাম-লড়াই করে গেছে। এ দীর্ঘ সংগ্রামে প্রায় লাখেরও অধিক মোরো মুসলিম জীবন বিসর্জন দিয়েছে।
বিভিন্নভাবে অবহেলার শিকার
স্বাধীনতাকামী মরোদের দীর্ঘ সংগ্রামের পর নতুন আইন অনুযায়ী গণভোট গ্রহণ শেষে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংসামোরো’ স্বায়ত্তশাসিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেন। কিন্তু এর আগে ফিলিপাইন সরকারের মতো মুসলিমবিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোও মুসলিম অধ্যুষিত জনপদটির প্রতি গুরুত্ব দেয়নি।
বাংসামোরো প্রাকৃতিক ও খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ। যদিও অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা দুর্বল। তবে নতুন এলাকা গঠিত হওয়ায় এখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে বলে আশা মোরোদের।
ইতিহাসের আলোকে জানা যায়, ড. হাজি মুরাদ ইবরাহিমের অব্যাহত সংগ্রাম ও দৃঢ় মনমানসিকতার দরুন বাংসামোরোর জনগণ স্বায়ত্বশাসিত সরকার পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংসামোরোতে একটি আদর্শ সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে।
স্বায়ত্তশাসিত বাংসামোরোকে পার্শ্ববর্তী দেশ ব্রুনাই দারুস সালাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও বাংসামোরোকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দেওয়ার কথা। পাশাপাশি এসব দেশ বাংসামোরের সামগ্রিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস মরো নেতাদের।
ইসলাম বিভাগে লিখতে পারেন আপনিও। লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০১৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১৯
এমএমইউ