ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

চেচনিয়ায় ইউরোপের সর্ববৃহৎ মসজিদ উদ্বোধন

ইসলাম ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৯
চেচনিয়ায় ইউরোপের সর্ববৃহৎ মসজিদ উদ্বোধন ইউরোপের সর্ববৃহৎ মসজিদের দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

চেচনিয়ায় ইউরোপের সর্ববৃহৎ মসজিদ উদ্বোধন করা হয়েছে। মসজিদটি রাশিয়ার স্বায়ত্বশাসিত চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনিতে অবস্থিত। এটি ৯ হাজার ৭০০ বর্গমিটার জমির উপর নির্মিত। মসজিদটির ভেতরে ৩০ হাজার মুসল্লি নামাজ পড়তে পারেন। এছাড়াও আশপাশের আঙিনা মিলে মোট ৭০ হাজার মানুষ এতে নামাজ আদায় করতে পারবেন। মসজিদটি ডিজাইন করেছেন উজবেকীয় এক স্থপতি।

শুক্রবার (২৩ আগস্ট) পবিত্র জুমআর নামাজ আদায়ের মাধ্যমে মসজিদটি উদ্বোধন করা হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে এমনটা জানা গেছে।

চেচনিয়ার সরকার কর্তৃপক্ষ মসজিদটিকে ইউরোপীয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মসজিদ বলে গণ্য করছেন। মসজিদটির নাম রাখা হয়েছে ‘ফাখর আল-মুসলিমিন’ বা ‘মুসলমানদের গর্ব’।

চেচনিয়ায় ইউরোপের সর্ববৃহৎ মসজিদের দৃষ্টনন্দন দৃশ্য।  ছবি: সংগৃহীতউদ্বোধন অনুষ্ঠানে কুয়েত আমিরি দিওয়ানের উপদেষ্টা ও আন্তর্জাতিক ইসলামী চ্যারিটেবল অর্গানাইজেশনের (আইআইসিও) চেয়ারম্যান ড. আবদুল্লাহ আল-মাআতউকসহ উর্ধ্বতন অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

চেচেন নেতা ও চেচনিয়ার শাসক রমজান কাদিরভ উদ্বোধনের সময় বলেছেন, আঞ্চলিক রাজধানী গ্রোজনির নিকটে অবস্থিত শহর শালীতে মসজিদটি অবস্থিত এবং এটি আকার, সৌন্দর্য, নকশা ও বিশালত্বের দিক থেকে অনন্য।

মসজিদটি আধুনিক ইসলামি স্থাপত্যের অনন্যতার সাক্ষর রেখেছে। উন্নতমানের মার্বেল পাথরে সজ্জিত মসজিদটির বাইরে ফোয়ারা ও সুবিশাল বাগানবীথি রয়েছে। এতে মসজিদের সৌন্দর্য বেড়েছে বহু গুণে।

মসজিদের ভেতরে জুমার নামাজ পড়ছেন মুসল্লিরা।  ছবি: সংগৃহীতমসজিদের তিনটি সদর দরজা প্রবেশ ও সুউচ্চ ৪টি মিনার রয়েছে। কারুকার্য, শোভানন্দন ও বৃহদায়তনের কারণে মসজিদটি দৃষ্টি কাড়ে যে কারো।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মসজিদটি উদ্বোধনের সময় উপস্থিত থাকতে না পারলেও এক বার্তায় মসজিদটির প্রশংসা করে তিনি বলেছেন, এটি চেচেন অঞ্চল ও প্রজাতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চেচনিয়ার শাসক রমজান কাদিরভ
মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে চেচনিয়ার ক্ষমতায় বসেন (পুতিন কর্তৃক) রমজান কাদিরভ। রমজান কাদিরভ চেচনিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধান মুফতি হাজি আখমেদ কাদিরভের ছেলে। বর্তমান রাশিয়ার সরকার চেচনিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য চেচনিয়ার বর্তমান শাসক রমজান কাদিরভের উপর খুবই নির্ভরশীল।

চেচনিয়া শাসনের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে কাদিরভ চেচেনদের সার্বিক উন্নতি ও ইসলাম প্রচারে বিভিন্ন আঙ্গিকে কাজ করছেন। তার কাজগুলো চেচেনদের নতুনভাবে উদ্দীপ্ত করছে।

পিতার মতো তিনি মুফতি ও বিচারক। এমনকি তিনি একজন মুষ্টিযোদ্ধাও। বিশ্বখ্যাত মুসলিম (ইসলামে দীক্ষিত) মুষ্টিযোদ্ধা মাইক টাইসনের সঙ্গে একবার লড়েছিলেন।

উদ্বোধন অনুষ্ঠানে চেচনিয়ার শাসক রমজান কাদিরভ।  ছবি: সংগৃহীতচেচনিয়াতে তিনি শরিয়া আইন চালু করেন। ইসলামচর্চা তিনি শুরু করেছেন নিজ পরিবার থেকে। তার ১২ ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রায় সবাই কোরআনে হাফেজ।

দুই দফা যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয় চেচনিয়া। র রাজধানী গ্রোজনি কাদিরভের নেতৃত্বে আবারও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, চেচনিয়ায় স্থিতিশীলতাও ফিরে এসেছে অনেকাংশে। গ্রোজনিতে এখন আছে নতুন নতুন রাজপথ, সুউচ্চ ভবন, একটি নতুন ফুটবল স্টেডিয়াম। কাদিরভের সমর্থকদের মতে তিনি চেচনিয়াকে পরিণত করেছেন উত্তর ককেশাসের সবচেয়ে স্থিতিশীল একটি অঞ্চলে।

চেচনিয়ায় ইসলামের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে চান কাদিরভ
রাশিয়ার চিন্তাধারার সঙ্গে কাদিরভের কর্মোদ্দীপনার ভিন্নতা রয়েছে। তবে কাজ করছেন রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সখ্য রেখে। ইসলামী ঐতিহ্যের পৃষ্ঠপোষকতা করাই কাদিরভের মৌলিক চিন্তা। চেচনিয়াকে রাশিয়ায় ইসলামের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে তিনি বদ্ধপরিকর।

আখমাদ কাদিরোভ মসজিদ।  এটি ‘চেচনিয়ার হার্ট’ হিসেবে পরিচিত।  ছবি: সংগৃহীতএ লক্ষ্যেই পিতার নামে (চেচনিয়ার প্রধান মুফতি ও প্রথম প্রেসিডেন্ট। ২০০৪ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হন। ) নির্মাণ করেন ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম মসজিদ। ২০০৮ সালের অক্টোবরে সেটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। উদ্বোধনকালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন উপস্থিত ছিলেন। মসজিদটিতে একসঙ্গে প্রায় ১০ হাজার মুসল্লি মসজিদটিতে নামাজ আদায় করতে পারেন।  

মসজিদটি ‘চেচনিয়ার হৃদয়’ (The Heart  of Chechnya) হিসেবে পরিচিত। ২০ কোটি ডলার খরচ করে বিলাসবহুল এ মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ‘ফখরুল মুসলিমিন মসজিদ’ নির্মাণের আগ পর্যন্ত এটি ইউরোপের সর্ববৃহৎ মসজিদ হিসেবে গণ্য হতো।

আরো পড়ুন: যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের ওপর নির্মিত দৃষ্টিনন্দন মসজিদ

চেচনিয়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
চেচনিয়া (অফিসিয়ালভাবে চেচেন প্রজাতন্ত্র) রুশ ফেডারেশনের অন্তর্গত একটি মুসলিম স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল। চেচনিয়া রাশিয়ার উত্তর ককেসাস অঞ্চলে অবস্থিত। আয়তন ১ লাখ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা ১৪ লাখ। চেচেনরা এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের সংখ্যা শতকরা ৭৫ ভাগ। প্রাদেশিক রাজধানী গ্রোজনি।

চেচনিয়া ইসলামের সূচনাকালেই ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়। দীর্ঘদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনে ছিলো। বহু বছর ধরে চেচনিয়া স্বাধীনতা আন্দোলন চালিয়ে আসছে। চেচেনদের বিরুদ্ধে রুশ আগ্রাসনের ইতিহাস প্রায় চারশ’ বছরের। পিটার দি গ্রেট থেকে শুরু করে মেদভেদেভ পর্যন্ত সব শাসকই চেচনিয়ার স্বাধীনতার দাবিকে অগ্রাহ্য করে এসেছে।

১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে ৬টি মুসলিম দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এতে চেচেনরা স্বাধীনতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।  

স্বাধানীনতার জন্য দীর্ঘ আন্দোলন
চেচেনদের স্বাধানীনতার নেতৃত্ব দেন দুদায়েভ। চেচেনদের দমন করতে রাশিয়াকে বেশ হিমশিম খেতে হয়। যুদ্ধে অতি উচ্চমানের অস্ত্র নিয়ে চেচেনদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রাশিয়া। এতে চেচেনদের জনপ্রিয় নেতা ও প্রেসিডেন্ট দুদায়েভ ১৯৯৬ সালের ২৪ এপ্রিল মিসাইল আক্রমণে শহীদ হন।  

কয়েক বছরের যুদ্ধে চেচনিয়ার প্রায় ৩০ হাজার লোক শহীদ হয়। আহত ও পঙ্গু হয় অসংখ্য চেচেন। রাশিয়াকেও চড়া মূল্য দিতে হয়। অবশেষে ১৯৯৬ সালের ৩১ আগস্ট চেচেন নেতা আসলান মাসখাদভ রাশিয়ার সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তির আওতায় চেচেনরা পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা না পেলেও অধিকতর স্বায়ত্তশাসন লাভ করেন।

চেচনিয়ার মানুষ সুন্দর ফর্সা ও সুঠাম দেহের অধিকারী। এরা যেমন উদারপ্রাণ তেমনি সাহসী। উভয় প্রদেশ থেকে প্রচুর মুসলমান হজপালনে সৌদি আরব গমন করেন।  

চেচনিয়ায় পাশের প্রদেশের নাম দাগিস্তান। উভয় প্রদেশের রাজধানীর মধ্যে দূরত্ব প্রায় ২০০ কি.মি.। দাগিস্তানের আয়তন চেচনিয়া থেকে বেশি। জনসংখ্যা ৩০ লাখের মতো। রাজধানীর নাম মাহাসকাল। জনশ্রুতি রয়েছে, এ এলাকায় প্রায় ৪০ জন সাহাবির কবর রয়েছে।

মদ ও নেশাদ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ
গ্রোজনিতে প্রচুর রেস্টুরেন্ট থাকলেও সেগুলোতে মদ ও নেশাদ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ। চেচেনদের পোশাক-পরিচ্ছদেও শালীনতা ধরে রাখার নিয়ম আরোপ করা হয়েছে।

চেচনিয়ার স্কুলছাত্ররা ইসলামী অনুশাসনের বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে অধ্যয়ন করেন। মুসলিম নারীরা হিজাব ব্যবহার করেন।  হিজাব চেচেন-ঐতিহ্যও বটে। অনেকে পা পর্যন্ত ঢাকতে লম্বা পোশাক পরিধান করেন, যা আভায়া নামে পরিচিত।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের ‘দ্য ন্যাশনাল.এই’ ও ‘আল-মুজতামা’ অবলম্বনে মুফতি মুহাম্মাদ মিনহাজ উদ্দিন

ইসলাম বিভাগে লিখতে পারেন আপনিও। লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৯
এমএমইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।