দ্বীপপুঞ্জ মিলিয়ে ফিজির মোট আয়তন ১৮ হাজার ২৭৪ বর্গকিলোমিটার। সবচেয়ে দূরবর্তী দ্বীপ ওয়ান-আই-লাও।
ফিজির মূল বন্দরটি রাজধানী সুভায় অবস্থিত। নিকটবর্তী প্রতিবেশীরা হলো পশ্চিমে ভানুয়াতু, দক্ষিণ-পশ্চিমে ক্যালাডোনিয়া, দক্ষিণ-পূর্বে নিউজিল্যান্ড, পূর্বে টোঙ্গা, উত্তরে টুভালু।
ফিজি ওই অঞ্চলের অন্যতম সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী দেশ। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশটির আয়ের মূল উৎস বনভূমি, খনিজ ও মাছ। তবে ইদানীং পর্যটন ও চিনি রপ্তানি থেকেও ভালো আয় হয়।
আগ্নেয়গিরির লাভা জমে ফিজির বেশির ভাগ দ্বীপই তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন তথ্যে বলা হয়েছে, এগুলোর প্রায় ১৫ কোটি বছর আগে তৈরি হয়েছে। ফিজিতে জনবসতি শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে।
ফিজিতে মানুষের বসবাস
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ফিজির দ্বীপগুলোতে মানুষের বসবাস রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে যাদের বাস সেখানে, তাদের ‘কাভেতি’ বলা হয়। বিভিন্ন তথ্য মতে, আফ্রিকার টাঙানেকা (বর্তমান কেনিয়া) থেকে এসে তারা এখানে বসতি গড়েছিল। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, ইন্দোনেশিয়া থেকে তারা ফিজি দ্বীপপুঞ্জে এসেছেন। তবে তাদের চেহারাবয়বে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার ছাপ লক্ষণীয়।
‘ইন্টারন্যাশনাল ডেট লাইন’-এ অবিস্থত পৃথিবীর একমাত্র আবাদি অঞ্চল ফিজি। ডেট লাইনের পাশেই অনিন্দ্য সুন্দর ও মনোরম একটি মসজিদ রয়েছে। এখান থেকেই প্রতিদিন পৃথিবীর সর্বপ্রথম আজান শোনা যায়। এখানেই প্রতিদিন সবার আগে সূর্য ওঠে।
ফিজিতে ইংরেজদের শাসন
এখানে ইংরেজদের আগমন ঘটে ১৮৭৪ সালে। তারা এ অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করে। ব্রিটেন এখানে এই উপনিবেশ স্থায়ী ছিল ১৯৭০ সাল পর্যন্ত। ফিজিকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয় ১৯৮৭ সালে। ১৯৯৮ সালের ২৭ জুন দেশটির নতুন সংবিধান কার্যকর হয়।
ভারতীয়দের আগমন
ফিজির মোট জনসংখ্যার ৪৭.৬ শতাংশ ভারতীয় বংশোদ্ভুত। তাদের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যাই বেশি। ভারতীয়দের যেভাবে ফিজিতে আনা হয়েছিল, সেটি সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের বর্বর চরিত্রের ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত। ইংরেজরা যখন এই অঞ্চলে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করে, তখন সেখানকার আদিবাসীরা চাষাবাদে অজ্ঞ-অনভিজ্ঞ ছিল।
ইংরেজ গভর্নর তাই ভারতীয় অভিজ্ঞ চাষিদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করে। উপমহাদেশও তখন তাদের সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশবাদের অন্তর্ভুক্ত। সেই ভাবনা থেকে চেন্নাই, কেরালা, বাঙ্গাল ও উত্তরপ্রদেশের গরিব কৃষকদের প্রলোভন দেখানো হয়। দরিদ্র কৃষকরা অল্প পরিশ্রমে বেশি উপার্জনের সুযোগ দেখে হাজার হাজার মাইল দূরের ফিজিতে যেতে রাজি হয়। কিন্তু যাওয়ার পর তারা ভিন্ন চিত্রেরে মুখোমুখি হয়। দাসত্বের জাঁতাকলে নির্মমভাবে পিষ্ট হতে থাকে তারা। প্রায় সময় তাদের ওপর চালানো হতো পৈশাচিক নির্যাতন।
ফিজির সৌন্দর্য তাদের রক্তের সিঞ্চিত ফসল
ফিজি দ্বীপপুঞ্জে নারকেল গাছের মুগ্ধকর সৌন্দর্য। সাগরঘেঁষা সারি ও বিপুল নারকেল গাছের উপস্থিতি ফিজির সৌন্দর্যকে বিকশিত করেছে। অর্থনীতিতেও সমৃদ্ধি যোগ করেছে। কিন্তু এগুলো হতভাগা সেই কৃষকদের ঘাম ও রক্তের সিঞ্চিত ফসল; যাদের ইংরেজরা ‘ভারতীয় কৃষক’ বা ‘কুলি’ হিসেবে নিয়ে যায়।
তারা যুগ যুগ ধরে দাসত্বের জীবন পার করেছে। পরবর্তীকালে তাদের এ দাসত্বের হতশ্রী জীবনের অবসান ঘটে। জীবনে উদিত হয় নতুন দিনের সূর্য। ফলে জীবিকার তাগিদে ভারতীয় অঞ্চল থেকে আরো বহু মানুষ সেখানে ছুটে যায়। বাংলাদেশে থেকেও শ্রমবাজার তৈরি হয়েছে সেখানে। এভাবেই জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশ ভারতীয়দের দখলে।
ফিজিতে মুসলমানদের আগমন যেভাবে
ভারতীয় উপমহাদেশের সেই কৃষক এবং পরবর্তীকালে আগতদের সঙ্গেই এতদাঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটে। ১৮৭৯ থেকে ১৯১৬ সালের মধ্যে কয়েক দফায় মুসলমানরা ফিজিতে যায়।
প্রথম কৃষক হিসেবে ভারত উপমহাদেশ থেকে ৬০৫৫৩ জন ফিজিতে যান। তাদের মধ্যে দুই হাজার ৫৩৭ নারীসহ ৭৬৩৫ জন মুসলিম ছিলেন। এ অঞ্চলে ইসলামের প্রচার তাদের মাধ্যমেই ঘটে।
এরপর পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও মালয় অঞ্চল এবং পূর্ব আফ্রিকা থেকে মুসলিমরা ক্রমান্বয়ে ফিজিতে আগমন করতে থাকে। এভাবে ফিজিতে মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯২৬ সালে মুসলিমরা সর্বপ্রথম সেখানে ইসলামী সংস্থা গড়ে তোলে।
ফিজির মুসলিমদের জনসংখ্যা
ফিজির মুসলিমদের মোট সংখ্যা ৬২ হাজার ৫৩৪ জন। দেশের মোট জনসংখ্যার ৭.৭%। ভারত-পাকিস্তানিদের মাঝে মুসলমানদের সংখ্যা ১৫.৯%। ৫৭.১৯% মুসলমান গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন। ১৯.১১% রাজধানীতে, বিশ হাজার ২৩১ জন বা অঞ্চলে, ৫২৮৮ জন রাওয়া অঞ্চলে বসবাস করেন।
ছাব্বিশ হাজার ৪৭০ জন মুসলিম ১৫ বছরের বেশি বয়সী। আর আঠারো হাজার ৯৮৮ জন মুসলিম ১৫ বছরের কম বয়সী। বিভিন্ন বেসরকারি তথ্য মতে ফিজিতে বর্তমানে মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজারের মতো।
ফিজিতে প্রথম মসজিদ নির্মাণ
সর্বপ্রথম যেসব মুসলমান প্রথম ফিজিতে যান, তারা নামাজ-রোজা প্রভৃতি ধর্মীয় মৌলিক বিষয় মেনে চলত। ইসলামের প্রতীকী বিষয়গুলোর প্রতি তারা বেশ যত্নবান ছিলেন। ফিজিতে তারা প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন।
কিন্তু নতুন প্রজন্মের মুসলিমদের ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। তাছাড়া হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ ও স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের মেলামেশা ছিল সার্বক্ষণিক; এতে ধীরে ধীরে দ্বীনের অনুসরণ ও ধর্মীয় আমল-আচরণ ম্লান ও প্রাণোচ্ছ্বলতা হারিয়ে ফেলে। তবে দাওয়াত ও তাবলিগের অসিলায় আল্লাহ তাআলা এখানে দ্বীনের আলো ফের সে দেশে তেজদীপ্ত করেন।
ফিজিতে প্রথম তাবলিগ জামাত
সর্বপ্রথম সম্ভবত ১৯৬৭ সালে ফিজিতে তাবলিগের জামাত আসে। জামাতটি আফ্রিকার দেশ জাম্বিয়ার ছিল। তারা মানুষকে দ্বীন-ধর্মের প্রতি ফিরে আসার প্রেরণা দেন। ফিজির প্রাচীন অধিবাসীরাও তাদের ধর্মীয় কর্তব্য ও সৃষ্টি উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পারে। নতুন নতুন মসজিদ নির্মাণ শুরু হয়। সেখানে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে মক্তব প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন দেশজুড়ে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক তৎপরতা বেশ সুন্দর ও গোছালো।
মসজিদ-মাদরাসা ও ইসলামী সংস্থা
প্রায় ২৫টি মসজিদ রয়েছে ফিজিতে। মসজিদগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ফিজি ইসলামিক অর্গানাইজেশন মসজিদগুলোর তত্ত্বাবধান ও দেখভাল করে। নতুন আরও পাঁচটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে। প্রতিটি মসজিদ ফিজির মুসলিমদের নিজস্ব উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ফিজিতে ১৩টি প্রাথমিক ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। বেশির শিক্ষাকেন্দ্র মসজিদ-সংলগ্ন। শিক্ষার বিভিন্ন রকম ও ধরন রয়েছে। অন্যদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক ছয়টি শিক্ষালয় রয়েছে। একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য জমি নির্বাচন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ইসলামী সংস্থার সদর দফতর নির্মাণ করা হবে।
ফিজির মানুষের মধ্যে দিন দিন ধর্মীয় অনুভূতি দারুণভাবে বিকশিত হচ্ছে। ফলে সেখানে মসজিদ, মক্তব-মাদরাসা ও ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা বেড়ে চলছে। বাংলাদেশের একজন আলোকিত মানুষ মাওলানা আবদুল গোফরান ফিজিতে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে দারুণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি একটি দাওরায়ে হাদিস মাদরাসার সূচনা করেছেন। বাংলাদেশের মাওলানা জাফর আলম ও মাওলানা কামরুজ্জামান এবং আরও কয়েকজন বাংলাদেশি আলেম রয়েছেন। তাদের নিবিড় তত্ত্বাবধান ও পরিচর্যায় ফিজিতে বর্তমানে অভিজ্ঞ ও মানসম্পন্ন আলেম তৈরি হচ্ছে।
ইসলামের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে
ফিজিতে মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় অনুরাগ বাড়ছে। দেশটির মুসলিম যুবকরা দিন দিন ধর্ম পালনে আগ্রহী হয়ে উঠছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো ফিজিতেও ইসলামবিরোধী নানা প্রচারণা রয়েছে। এরপরও ফিজির সাধারণ মানুষ ইসলামের প্রতি ঝুঁকছে। মসজিদমুখী হচ্ছে মানুষ; বাড়ছে মুসল্লির সংখ্যা।
আরও পড়ুন: ফিজিতে সর্ববৃহৎ মসজিদের উদ্বোধন
ফিজির সর্ববৃহৎ মসজিদ ‘মসজিদে হেলাল’ উদ্বোধনকালে (৬ এপ্রিল) ফিজির মুসলিম নেতা নাসির খান বলেন, ফিজির যুবকদের মধ্যে ইতিবাচক চিন্তার বিস্তার ঘটছে। তারা এখন মসজিদমুখী। তাই ধর্মীয় কাজের বিস্তৃতির সঙ্গে মসজিদ প্রসারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া ওই দেশের মুসলিমদের ইসলামবিরোধী কাজ থেকে ফিরিয়ে আনতে মসজিদভিত্তিক ইসলাম শিক্ষার পদক্ষেপ নিচ্ছে দেশটি। বর্তমানে ফিজির রাজনীতি ও অর্থনীতিতে মুসলিমদের জাগরণ চোখে পড়ার মতো। সেখানকার জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় তাদের।
ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। লেখা ও প্রশ্ন পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৯
এমএমইউ