লাসভেগাসের অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সবুজাবৃত পর্বতমালায় আকৃষ্ট হয়ে প্রতিবছর প্রায় ৪২ মিলিয়ন পর্যটকের আগমন ঘটে এখানে। এখানকার ক্যাসিনোগুলোও পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আগত ধনীদের আগমনে থাকে মুখরিত।
লাসভেগাসের ওয়াশিংটন এভিনিউ ও এইচ স্ট্রিটের পাশে অবস্থিত ভেগাসের অন্যতম প্রাচীন মসজিদ আস সাবুর মসজিদ। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে প্রতিষ্ঠিত এ মসজিদটি লাসভেগাসের মুসলিমদের মিলনক্ষেত্র। বিত্তবান সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার এবং বিখ্যাত দুই বক্সার মাইক টাইসন (যিনি পরে ইসলাম গ্রহণ করে মালিক আবদুল আজিজ নাম গ্রহণ করেন) ও মুহাম্মদ আলী এবং তাঁর কন্যা লায়লা আলীর সার্বিক সহযোগিতায় মসজিদটি স্থাপিত হয় এবং ব্যাপক উন্নতি সাধন করে। মসজিদটিকে ঘিরে প্রায় ২০ বছরের পরিশ্রমের পর মসজিদের চতুর্থতম ইমাম ফাতিন সাইফুল্লাহ পাপে ভরপুর এই নগরীকে আলোকিত নগরীতে পরিণত করেন।
নেশাকর দ্রব্যাদি ও অপরাধমূলক কাজ থেকে মসজিদের আশপাশের এলাকাকে মুক্ত করেন তিনি। স্থানীয় মুসলিম ও বিভিন্ন সেবা সংস্থা তাঁর মহতী কাজে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসে। ফলে লাসভেগাস শহরের এদিকটায় আগের তুলনায় এখন ক্যাসিনো ও মাদকদ্রব্যের আদান-প্রদান তুলনামূলক কম। আর মসজিদের আশপাশজুড়ে পুরো এলাকা এখন নতুন রূপ ধারণ করেছে। মদ-জুয়া বা অনৈতিক কার্যাবলি থেকে তা এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। পশ্চিম লাসভেগাস স্ট্রিপের এক মাইল দূরে অবস্থিত অপরাধমুক্ত এই নগরীকে মসজিদের ইমাম অভিহিত করেন ‘মুসলিম ভিলেজ’ নামে। ক্যাসিনো, মদ-জুয়া ও অপরাধের অভয়ারণ্যখ্যাত ভেগাসের বুকে মুসলিম ভিলেজ দেখে অবাক হওয়াই স্বাভাবিক।
পাশাপাশি মুসলিম ও অমুসলিমদের জন্য এলাকাটিকে নিরাপদ এরিয়া হিসেবে গড়ে তুলতে মসজিদের আশপাশের অনেক ঘরবাড়ি ক্রয় করছে মসজিদ সাবুর কমিউনিটি। মুসলিমদের বসতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে গৃহ ক্রয় ও বিক্রয়ের কার্যক্রম চলছে বর্তমানে। মুসলিমদের এখানে বসবাসে আগ্রহী করে তুলতে নগর উন্নয়নের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তা ছাড়া মুসলিম ভিলেজকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হয়েছে কমিউনিটি হেলথ সেন্টার। বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয় সেখানে। শিশু, তরুণ ও বয়স্কদের শিক্ষাদানের জন্য আছে ইসলামিক এডুকেশন সেন্টার। অভাবীদের জন্য নিয়মিত খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। আশ্রয়হীন বা নিপীড়িত নারীদের আশ্রয় প্রদান করা হয়। আরো আছে মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির জন্য মাদক নিরাময়কেন্দ্র।
মোটকথা মানুষের প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা করা হয়েছে মুসলিম ভিলেজে। সামাজিক অপরাধ থেকে মুক্ত হয়ে নিরাপদে বসবাসের সব ব্যবস্থা আছে এখানে। বর্তমানে মসজিদের আশপাশে মুসলিমদের সঙ্গে অনেক অমুসলিমও সেখানে বসবাস করছে। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থী, নারী ও বয়স্কদের সংখ্যাই বেশি।
প্রায় ১০ বছর ধরে বছরের নির্দিষ্ট একটি দিনে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে মুসলিম ভিলেজে ইসলামী রিলিফ ইউএসএ সংস্থার তত্ত্বাবধানে মানবতার সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে স্কুল বস্ত্র-সামগ্রী, চিকিৎসাসেবা, খাবার, পরিচ্ছন্নতার সামগ্রী ও স্বল্প মূল্যে ঘর ভাড়ার ব্যবস্থা করা হয়। অনেক পরিশ্রম ও দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এমন প্রকল্প অব্যাহত থাকায় লাসভেগাসের এই এলাকাটিতে এখন অপরাধের মাত্রা অনেক কম এবং মদ-জুয়া ও অন্যান্য অপরাধ থেকে অনেক নিরাপদ বলে ঘোষণা দিয়েছে লাসভেগাস মেট্রোপলিটন পুলিশ। এ ছাড়া সিটি কাউন্সিলের গৃহীত অপরাধ দমনমূলক নানা পদক্ষেপে মসজিদ আস সাবুরের তত্ত্বাবধানে অনেক স্থানীয়ের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো।
মসজিদের এরিয়ায় অবস্থিত গির্জার লোকেরাও মুসলিমদের জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। সবার মধ্যে মুসলিম ভিলেজ এতই পরিচিত ও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে যে কেউ কোনো ধরনের সমস্যায় পড়লে তাকে সবাই মুসলিম ভিলিজের মসজিদে আসার পরামর্শ দেয়। এমনকি এখানকার যেকোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ছাড়া অন্যান্য সময়ও পুলিশ এখানে এসে সময় অতিবাহিত করে। মুসলিম ভিলেজ তাদের কাছে প্রশান্তি পল্লী হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে মসজিদ আস সাবুরটি আফ্রিকান, আমেরিকান, অভিবাসী ও নওমুসলিমসহ সব শ্রেণির কাছে অত্যন্ত প্রিয় একটি স্থান।
আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মসজিদ আস সাবুরের সম্মানিত ইমাম ফাতিন সাইফুল্লাহর জন্ম আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চল লুইজিয়ানায়। লুইজিয়ানার এক ব্যাপ্টিস্ট চার্চে বেড়ে ওঠেন তিনি। তাঁর দুই ভাই চার্চের যাজকদের পালক হিসেবে কাজ করছেন। লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকাকালে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের সংগঠন ‘নেশন অব ইসলাম’-এর কৃষাঙ্গ জাতীয়তাবাদী শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হন ফাতিন। অতঃপর শৃঙ্খলা ও ভ্রাতৃত্ববোধ উন্নয়নে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৮৮ সালে তিনি আমেরিকার অন্যতম মুসলিম চিন্তাবিদ দার্শনিক ও দায়ী, আমেরিকান সোসাইটি অব মুসলিমের প্রতিষ্ঠাতা ওয়ারিস উদ্দিন মুহাম্মাদের আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৯৯ সাল থেকে সাইফুল্লাহ ফাতিন মসজিদ সাবুরের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিগত ১০ বছর ধরে তিনি মুসলিম কমিউনিটি গড়ে তুলতে নিরলসভাবে কাজ করছেন। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘লাসভেগাসে মুসলিম বসবাস করতে পারে, এ কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু আমরা এখানে বসবাস করছি। যারা নানা কারণে এখানে বসবাসের আশা হারিয়ে ফেলেছে, আমরা তাদের অন্তরে আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি করতে চাই। ’
মূলত দীর্ঘকাল ধরে লাসভেগাস শহর অপরাধ ও অপকর্মের অবাধ নগরী হিসেবে পরিচিত সবার কাছে। অপরাধ দমনে এখানে কারো তেমন কোনো ভূমিকাও ছিল না একসময়। ১৯০৬ সাল থেকে ক্যাসিনো আর জুয়ার আড্ডায় ভরে যায় পুরো শহর। ওই সময়ের অপরাধ জগতের কুখ্যাত দুই গুরু বাগসি সিগ্যাল (Bugsy siegel) ও মায়ার ল্যানস্কি (Meyer Lansky) এসে লাসভেগাস শহরকে মদ-জুয়ার অভয়ারণ্যে পরিণত করে।
১৯৩০ সালে লাসভেগাসে ক্যাসিনো, জুয়া ও মদের বারগুলো আইনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। অতঃপর নানা রকম সামাজিক অপকর্মের মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। আমেরিকার অন্যান্য শহরে নিষিদ্ধ থাকা বিভিন্ন ধরনের মদ আর পতিতাবৃত্তির অবাধ বিচরণক্ষেত্র এটি। অন্য সব জায়গা থেকে আমোদ-ফুর্তির জন্য এখানে এসে জড়ো হয় সবাই। এমন একটি শহরে অপরাধ ও পাপাচার থেকে মুক্ত থেকে নিরাপদে মুসলিমদের বসবাসের উদ্যোগ সত্যিই সবার মনে আশার সঞ্চার করে।
লেখক: ধর্মবিষয়ক গবেষক ও রিসার্চ ফেলো সেন্টার ফর ইসলামিক থট, বসুন্ধরা, ঢাকা
ইসলাম বিভাগে আপনিও লেখা-প্রশ্ন পাঠাতে পারেন। জীবনঘনিষ্ঠ প্রশ্ন ও বিষয়ভিত্তিক লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৯
এমএমইউ