‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ শিরোনামে ০৬-১২-২০১১ দৈনিক প্রথম আলোতে তাঁর একটি লেখা ছাপা হয়। পরে সে লেখা ‘নিউ ইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’ গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়।
পবিত্র জুমা, জুমার দিন ও জুমার রাত মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের দৃষ্টিতে সপ্তাহের সবচেয়ে বরকতময় ও ইবাদতময় দিন হলো শুক্রবার বা জুমার দিন। সুতরাং ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সবার মনে কৌতূহল জাগে।
‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ আসলে কী
যুক্তরাষ্ট্রে নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’ (শুকরিয়া দিবস) হিসেবে পালিত হয়। এর পরের দিন—অর্থাৎ প্রতি নভেম্বর মাসের শেষ শুক্রবার ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ হিসেবে পরিচিত। তবে সেটি একই তারিখে হওয়ার কোনো নিয়ম নেই। ২০১৫ সালে সেটি হয়েছে ২৭ নভেম্বর, ২০১৬ সালে ২৫ নভেম্বর, আর ২০১৭ সালে ২৪ নভেম্বর। তারিখ নয়, বরং নভেম্বর মাসের শেষ শুক্রবার হওয়াই এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
১৮৬৯ সালের দিকে আমেরিকায় ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল, সেই সময় মন্দা থেকে উত্তরণের উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ দিবসের কথা ভেবেছিলেন ব্যবসায়ীরা। ওই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর তাঁরা পণ্যে বিশেষ ছাড় দেন। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, ওই ছাড়ে তাঁদের অনেক লস হয়। পরে দিনটি ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সাধারণত ব্যবসায়ীরা ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’তে পণ্য বিশেষ ছাড়ে বিক্রি করেন। ওই দিন ৭০ থেকে ৯০ ভাগ পর্যন্ত মূল্য ছাড় দেওয়ার নজিরও রয়েছে। ন্যূনতম এক ভাগ হলেও ছাড় দেওয়া হয়। মূলত ২৫ ডিসেম্বর খ্রিস্টানদের বড়োদিন উপলক্ষে কেনাকাটা ওই দিন থেকে শুরু হয়। সে উপলক্ষেই এ ছাড়।
তাহলে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ নামটি কোত্থেকে এসেছে? এ বিষয়ে কয়েকটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়—
এক. ১৯৫০ সালে ফিলাডেলফিয়া রাজ্য পুলিশ ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’র পরের দিনকে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ নামে অভিহিত করেছিল। কারণ এই দিনে আমেরিকায় বছরের সবচেয়ে বড় লেনদেন হতো ও বছরের সবচেয়ে উত্তেজনাকর ফুটবল গেম অনুষ্ঠিত হতো। ওই ফুটবল প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত আমেরিকার সেনাবাহিনী। এই খেলার ফলে শহরের রাস্তাজুড়ে থাকত প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যাম। এ ছাড়া ফুটপাতে লেগে থাকত মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। এসব সামলাতে বেশ বেগ পেতে হতো ফিলাডেলফিয়া পুলিশ ও বাস ড্রাইভারদের। তাই দিনটি পুলিশদের জন্য ছিল খুবই বাজে একটা দিন। এ জন্য তারাই এই দিবসের নাম দিয়েছিলেন ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’। (https://www. huffing tonpost .com/2013/11/27/black-friday-origin_n_4346347.html)
দুই. অনেকের মতে, ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ শুরু হয় মধ্যরাত থেকে। মধ্যরাতেই ক্রেতাদের লাইন ধরা শুরু হয়, অন্ধকার থাকতেই স্টোর ওপেন করে দেওয়া হয়। মানুষ হুড়মুড় করে দোকানের ভেতর ঢুকে যে যেটা আগে ধরতে পারে, সে সেটা কিনে নেয়। পণ্য বিক্রির এ ব্যাপারটা শেষ হয়ে যায় দিনের আলো ফোটার আগে। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল’।
তিন. ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’র অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা হলো—যেসব বিক্রেতার বিক্রি-বাট্টা কমতে কমতে হিসাবের খাতায় লাল দাগ নেমে যায়, তাঁদের এই দিনের বিক্রির পর পুনরায় তা কালো কালির আঁচড়ে ফিরে আসে। তাই এ শুক্রবারকে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ বলে অভিহিত করা হয়। (http://articles .islamweb .net/media /index.php ?page= article &lang=A&id=২০১১৩৬)
চার. বিশ্বের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে শুক্রবার দিনটিতে অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেই দুঃসহ স্মৃতি থেকে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ শব্দের প্রচলন হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক সংকট দেখা দেয়। ৮ জুন, ১৬৮৮ সালে কিং জেমস দ্বিতীয় সাতজন ‘অ্যাংলিকান বিশপ’কে গ্রেপ্তার করেন। ১৮ অক্টোবর, ১৮৮১ সালে হারিকেনের আঘাতে স্কটল্যান্ডের আইমাইথে প্রায় ২০০ জনের মৃত্যু হয়। ১৮ নভেম্বর, ১৯১০ সালে ইংল্যান্ডে নারীর ভোটাধিকারকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা হয়। ২০ অক্টোবর, ১৯১৬ সালে লেইক এরিতে প্রচণ্ড ঝড়ে চারটি জাহাজ ডুবে যায়।
২২ নভেম্বর, ১৯৬৩ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে গুপ্তহত্যা করা হয়। ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮ সালে ইরানের তেহরানে অবস্থিত ‘ময়দানে জালেহে’ বিক্ষোভকারীদের গণহত্যা করা হয়। ৩১ জুলাই, ১৯৮৭ সালে কানাডায় ভয়াবহ টর্নেডো আঘাত হানে। ১২ মার্চ, ১৯৯৩ ভারতের মুম্বাইয়ে সিরিজ বোমা হামলা হয়। ২৬ জুন, ২০১৫ ফ্রান্স, কুয়েত, সোমালিয়া, সিরিয়া ও তিউনিসিয়ায় ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়। কাকতালীয়ভাবে উল্লিখিত দিনগুলো ছিল শুক্রবার। তাই অনেকের কাছে শুক্রবার ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ নামে পরিচিত।
ইসলামে জুমার দিনের গুরুত্ব
পবিত্র জুমা, জুমার রাত ও জুমার দিন ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের দৃষ্টিতে এই দিনকে ‘কালো দিন’ আখ্যায়িত করার কোনো সুযোগ নেই। এক হাদিসে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে দিনগুলোতে সূর্য উদিত হয়, ওই দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিন সর্বোত্তম। ওই দিন হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। ওই দিন তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় এবং ওই দিনই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করা হয়। আর ওই দিনই কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। ’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস : ৮৫৪)
অন্য হাদিসে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমরা পরে আগমন করেও কিয়ামতের দিন (আহলে কিতাবের) অগ্রবর্তী হব। তাদের আসমানি গ্রন্থ দেওয়া হয়েছে আমাদের আগে। আমাদের দেওয়া হয়েছে পরে। আর এই দিন—অর্থাৎ জুমার দিনের ব্যাপারেও আমরা অগ্রবর্তী। ইহুদি ও খ্রিস্টানরা এদিন নিয়ে মতভেদ করেছিল। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথ দেখিয়েছেন। ইহুদিরা আমাদের এক দিন পর—অর্থাৎ শনিবার পেয়েছে। আর খ্রিস্টানদের জন্য রবিবার। ’ (বুখারি : ৮৪৭)
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ তাআলা জুমার দিনের গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের আগের লোকদের উদাসীন রেখেছেন। ফলে ইহুদিদের জন্য শনিবার, আর খ্রিস্টানদের জন্য রবিবার...। ’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস : ৮৫৬)
মহানবী (সা.) আরো ইরশাদ করেছেন, ‘জুমার দিন এমন একটি সময় আছে (ওই সময় বান্দার যেকোনো দোয়া কবুল হয়), কোনো মুসলিম যদি ওই সময়টা পায়, আর তখন সে নামাজে থাকে, তাহলে সে কোনো কল্যাণ কামনা করলে আল্লাহ তাকে তা দান করেন। ’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪০০)
মুসলমানরা কি ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ উদ্যাপন করতে পারবে?
বর্তমানে কৌশলী নামে এই ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ মুসলিম দেশগুলোতে ঢুকে পড়ছে। ‘আমাজন’-এর ‘কল্যাণে’ আরব দেশগুলোর কোনো কোনো স্থানে এ দিবস ‘আল জুমুআতুস সাওদা’ বা ‘সাদা জুমা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়! প্রশ্ন হলো, মুসলমানরা কি ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ উদ্যাপন করতে পারবে? এ প্রশ্নের জবাবে আমরা কয়েকটি কথা বলতে চাই।
এক. মুসলমানদের দৃষ্টিতে জুমার দিন ‘কালো দিন’ তো নয়ই, বরং সেটি অত্যন্ত বরকতময় দিন। তাই এ শব্দ ব্যবহার মুসলমানদের জন্য সংগত নয়।
দুই. এই দিন খ্রিস্টানদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ মর্মে পর্যাপ্ত দলিল-দস্তাবেজ আছে। কাজেই মুসলমানদের জন্য অন্য ধর্মাবলম্বীদের সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্য কোনো জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে ওই জাতির দলভুক্ত বলে গণ্য হবে। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৫১২)
তিন. তবে ওই দিন ইসলামের সীমারেখা মেনে ব্যবসা-বাণিজ্য করলে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। ব্যবসা ও মুনাফা বৈধ বলে গণ্য হবে। কোরআনে এসেছে, ‘... আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয় হালাল ও সুদ হারাম করেছেন...। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৫)
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘হে ঈমানদাররা! জুমার দিনে যখন নামাজের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ করো...। ’ (সুরা : জুমুআ : ৯)
চার. বিভিন্ন কারণে খ্রিস্টানরা এই দিনকে অশুভ মনে করে। কিন্তু ইসলামে অশুভ বলতে কিছু নেই। ওই দিনে দুর্যোগপূর্ণ অনেক ঘটনা ঘটলেও এর সঙ্গে দিবসের কোনো সম্পর্ক নেই। ওই দিন ছাড়াও তো অন্য দিনের বহু দুর্যোগপূর্ণ ঘটনা আছে! মজার ব্যাপার হলো, খ্রিস্টানদের দৃষ্টিতেও একটি ‘গুড ফ্রাইডে’ আছে। খ্রিস্টানদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, যিশু খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার স্থান থেকে এই দিনে তাঁর পুনরুজ্জীবন হয়। এর স্মরণে খ্রিস্টানরা উল্লিখিত উৎসব পালন করে। ক্রুশিফিকেশন ডার্কনেস অ্যান্ড একলিপস পদ্ধতি মতে (প্রেরিতদের কার্য; ২:২০-এ প্রেরিত পিতর কর্তৃক বর্ণিত ‘রক্ত চন্দ্র’র বিবরণ অনুসারে), ‘গুড ফ্রাইডে’র তারিখ নিরূপণ করা হয়েছে ৩ এপ্রিল, ৩৩ খ্রিস্টাব্দে। ওই দিনটি খ্রিস্টানদের দৃষ্টিতে ‘শুভ দিন’।
কাজেই কোনো দিন ও কোনো বস্তুকে অশুভ মনে করা অযৌক্তিক। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কুলক্ষণে বিশ্বাস করা শিরক। ’ (আবু দাউদ, তিরমিজি, মিশকাত, হাদিস : ৪৫৮৪)
লেখক: সিইও, সেন্টার ফর ইসলামিক ইকোনমিকস বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা।
ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। বিষয়ভিত্তিক লেখা ও জীবনঘনিষ্ঠ প্রশ্ন পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৯
এমএমইউ