হালাল ও হারাম ইসলামী শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পরিভাষা। সাধারণত ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে সব বৈধ বিষয়কে হালাল ও সব অবৈধ বিষয়কে হারাম বলা হয়।
আল্লাহর নির্ধারিত সীমা : মুমিনের জন্য হালাল ও হারাম আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা। কোরআনে আল্লাহ এই সীমারেখা অতিক্রম করতে নিষেধ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘এটি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা। সুতরাং তোমরা তা লঙ্ঘন কোরো না। যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন করে তারাই অবিচারী। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২২৯)
নির্ধারণের অধিকার শুধু আল্লাহর : হালাল ও হারাম নির্ধারণের অধিকার শুধু আল্লাহর। আল্লাহ এই অধিকার আর কাউকে দেননি। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, তোমরা কি ভেবে দেখেছ আল্লাহ তোমাদের যে জীবিকা দিয়েছেন তোমরা যে তার কিছু হালাল ও কিছু হারাম করেছ? বলুন, আল্লাহ কি তোমাদের এর অনুমতি দিয়েছেন, নাকি তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করছ?’ (সুরা ইউনুস, আয়াত : ৫৯)
হালাল ও হারাম ঈমানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট : আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশ্বাস মতে, কোনো ব্যক্তি যদি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত কোনো হালাল বস্তুকে হারাম এবং হারাম বস্তুকে হালাল মনে করে, তাহলে তার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। পবিত্র কোরআনে এই শ্রেণির মানুষের সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা আল্লাহর ওপর ঈমান আনে না ও পরকালের প্রতিও নয়; আর আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যা হারাম করেছেন তা হারাম গণ্য করে না এবং সত্য দ্বিনের অনুসরণ করে না, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে—যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে নিজ হাতে জিজিয়া দেয়। ’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ২৯)
মুমিনের পরিচয়ের অংশ : হালালকে হালাল মনে করা এবং হারামকে হারাম মনে করা মুমিনের পরিচয়ের অংশ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করেছে এবং তা মুখস্থ রেখেছে আর এর হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম মেনেছে, তাকে আল্লাহ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। ’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৯০৬)
হালালকে হারাম বলা জঘন্য অপরাধ : কোনো হালাল বস্তুকে হারাম বলা আল্লাহর প্রতি অপবাদ দেওয়ার নামান্তর। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের জিহ্বা মিথ্যারোপ করে বলে আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করার জন্য তোমরা বোলো না এটা হালাল এবং এটা হারাম। ’ (সুরা নাহল, আয়াত : ১১৬)
হালালকে হারাম করা সীমা লঙ্ঘন : কোনো হালাল বস্তুকে হারাম মনে করা বা হারামতুল্য মনে করে তা পরিহার করা সীমা লঙ্ঘন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনরা, আল্লাহ তোমাদের জন্য উত্কৃষ্ট যেসব বস্তু হালাল করেছেন, সেসবকে তোমরা হারাম কোরো না এবং সীমা লঙ্ঘন কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না। ’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৮৭)
হালাল বস্তু পরিহার করা অশোভনীয় : আল্লাহ মানুষের জন্য যা কিছু বৈধ করেছেন যা পরিহার করা মুমিনের জন্য শোভনীয় নয়। কেননা আল্লাহ বলেন, ‘বলুন! আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে? বলুন! পার্থিব জীবনে বিশেষ করে কিয়ামতের দিন এসব তাদের জন্য, যারা ঈমান আনে। ’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৩২)
হালাল পরিহার বঞ্চিত হওয়ার নামান্তর : আল্লাহ যেসব বস্তু হালাল করেছেন তা পরিহার করা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়ারই নামান্তর। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তারা তাদের ধারণা অনুসারে বলে, এসব গবাদি পশু ও শস্য ক্ষেত নিষিদ্ধ; আমি যাকে ইচ্ছা করি সে ছাড়া কেউ এসব আহার করতে পারবে না। ’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১৩৮)
মানুষের সন্তুষ্টির জন্য হালাল বস্তু বর্জন নয় : কোনো মানুষকে সন্তুষ্ট করার জন্য আল্লাহ যা বৈধ করেছেন তা পরিহার করার অবকাশ নেই। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী, আল্লাহ আপনার জন্য যা বৈধ করেছেন আপনি তা নিষিদ্ধ করছেন কেন? আপনি তো আপনার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাচ্ছেন, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ’ (সুরা তাহরিম, আয়াত : ১)
হালাল-হারাম সম্পর্কের ঊর্ধ্বে : আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হালাল ও হারামের বিধান যেকোনো ধরনের সম্পর্ক ও সম্প্রীতির ঊর্ধ্বে। এ জন্য ইহুদি ধর্ম ত্যাগের পরও সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে সালাম ও তাঁর সঙ্গীরা যখন শনিবারকে মর্যাদার চোখে দেখতেন এবং উটের গোশত খেতে অপছন্দ করতেন, তখন আল্লাহ তাআলা তাদের সতর্ক করে বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২০৮; বিস্তারিত : তাফসিরে তাবারি)
হালাল বর্জনকারীদের প্রতি নবীজির হুঁশিয়ারি : যখন মদিনার একদল সাহাবি নিজেদের ওপর কঠোরতা আরোপ করেছেন এবং বৈধ জিনিস নিজেদের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন বলে প্রকাশ পায়, তখন মহানবী (সা.) বলেন, ‘সাবধান! চরমপন্থীরা ধ্বংস হয়েছে। তিনি এ কথা তিনবার বলেন। ’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৬০৮)
হালাল বস্তু কখন পরিহার করা বৈধ : কোনো হালাল বস্তুকে হালাল মনে করার পর যদি ইসলামে অনুমোদিত কোনো কারণে কেউ তা পরিহার করে, তাহলে তার অবকাশ আছে। যেমন—
১. সন্দেহযুক্ত হওয়া : কোনো হালাল বস্তু যদি সন্দেহযুক্ত হয় তাহলে তা পরিহারের সুযোগ আছে। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে সন্দেহজনক জিনিস থেকে বেঁচে থাকবে সে নিজের দ্বিন ও সম্মানকে রক্ষা করবে। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২)
২. চিকিৎসকের বারণ থাকা : যখন কোনো দ্বিনদার চিকিৎসক রোগীর জন্য কোনো হালাল বস্তু ক্ষতিকর মন্তব্য করেন, তখন তা পরিহার করা বৈধ। যেমন ডায়েবেটিক রোগীর জন্য চিনি না খাওয়া।
৩. হারামের দিকে নিয়ে যাওয়ার ভয় থাকা : কোনো হালাল জিনিস দ্বারা যদি কারো ভেতর মন্দ প্রবণতা তৈরির ভয় থাকে, তাহলে পরিহার করা বৈধ। যেমন—এমন ঝাঁঝালো পানীয় পরিহার করা, যা ব্যক্তিকে মদপানে উৎসাহিত করতে পারে। (হেদায়া, পানীয় অধ্যায়)
৪. স্বভাবজাত অপছন্দ : কোনো বস্তুকে নিজের ও অন্যের জন্য বৈধ মনে করার পরও ব্যক্তিগত অপছন্দের জন্য তা এড়িয়ে যাওয়া বৈধ। মায়মুনা (রা.)-এর ঘরে গেলে তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে ‘দব’ (গুইসাপ সদৃশ একটি মরুচারী প্রাণী) পেশ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তা থেকে হাত উঠিয়ে নিলে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, দব খাওয়া কি হারাম? তিনি বলেন, না। কিন্তু যেহেতু এটা আমাদের এলাকায় নেই। তাই এটি খাওয়া আমি পছন্দ করি না। খালিদ (রা.) বলেন, আমি সেটা টেনে নিয়ে খেতে থাকলাম। আর রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৩৯১)
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২, ২০২১
এসআই