ইউরোপ ও ইতালির বরেণ্য ইসলামী ব্যক্তিত্ব শায়খ আবদুর রহমান রসারিও পাসকুইনি ইন্তেকাল করেছেন। গত বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) তিনি মারা যান।
গত শতাব্দীতে ইতালির মিলান শহরে অবস্থিত মসজিদে আবদুর রহমান নির্মাণে বড় ভূমিকা ছিল তাঁর। মিলানের এই মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারই ছিল ইতালির প্রথম মসজিদ। শুধু তা-ই নয়, মিলান শহরের সেই শিশু পরবর্তী সময়ে নতুন প্রজন্মের আধ্যাত্মিক গুরুতে পরিণত হন। ইসলামের মূলকথা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে ইতালীয় ভাষায় পবিত্র কোরআন অনুবাদসহ অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেন তিনি।
জীবদ্দশায় এক বিবৃতিতে শায়খ আবদুর রহমান জানিয়েছিলেন, ‘তিনি স্থানীয় চার শর বেশি ব্যক্তিকে ইসলাম বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। পরবর্তী সময়ে তারা সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছে। আমি যথাসাধ্য ইসলামের দাওয়াত অব্যাহত রাখার চেষ্টা করি। ইতালিয়ান সবাইকে আমি ইসলামিক সেন্টারে আসার আমন্ত্রণ জানাই। প্রতি রবিবার উপস্থিত লোকদের প্রশ্নোত্তরের ভিত্তিতে আলোচনা করি। তা সবার জন্য খুবই ফলদায়ক ছিল। ’
শায়খ আবদুর রহমান রসারিও পাসকুইনি ১৯৩৪ সালের ১৩ জুন ক্রোয়েশিয়ার ফিউম শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালে মিলান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর বার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মিলান শহরে আইনজীবী হিসেবে এক যুগ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে তূলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে গভীর অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে এক মিসরীয় মুসলিমের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন। এর পরই তিনি ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা দেন। ১৯৭৭ সালে ইসলামের বার্তা ছড়িয়ে দিতে ইতালীয় ভাষায় (Il Messaggero dell’Islam) ‘দ্য ম্যাসেজ অব ইসলাম’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে মিলান ও লোম্বারডি শহরে ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
আইনের শিক্ষার্থী ও আইনজীবী হওয়ায় শায়খ আবদুর রহমান ইসলাম প্রচার, গ্রন্থ রচনা, মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠাসহ সব কর্মকাণ্ড দেশীয় আইন অনুসরণ করেই পালন করতেন। ফলে তিনি নিজ কাজে কোনো ধরনের বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতেন না; বরং তাঁর এ দক্ষতা মুসলিম জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় বেশি কাজ দেয়। ইসলামের সামাজিক দিকগুলো দেশের সরকার, বিচার বিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে স্পষ্ট করে তুলে ধরতেন।
ওই সময় মসজিদুর রহমান নামে মিলান শহরে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানেই তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং এর পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়। ১৯৮৯ সালে ইতালিতে ইসলামী ওয়াকফ বোর্ড এবং পরের বছর ফেডারেশন অব ইসলামিক অর্গানাইজেশন প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি ইসলামী গ্রন্থ প্রকাশের জন্য দারুল কলম নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এখান থেকে তিন শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
ফেডারেশন অব ইসলামিক অর্গানাইজেশনসের প্রধান ইয়াসিন লিফারাম বলেন, ‘মিলান শহরে তিনি আমাদের মতো তরুণদের জন্য আশা-ভরসার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। বিভিন্ন শহর থেকে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মিলানের ইসলামিক সেন্টার ও মসিজদে আসত। সেখানে সবাই তাঁর কাছে মিলিত হতাম। আকিদা, ফিকহসহ ইসলামের নানা বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্বের অধিকারী হওয়ায় বিভিন্ন সেমিনারে আমরা উপস্থিত হতাম। তা ছাড়া ইতালীয় ভাষায় পারদর্শী হওয়ায় তাঁর কথা শুনে আমাদের জন্য সঠিকভাবে দ্বিন বোঝা সহজ ছিল। কেননা আমাদের অনেকে ভালোভাবে আরবি পারে না। ’
তিনি আরো বলেন, ‘এ মহান ব্যক্তি অত্যন্ত আল্লাহভীরু ছিলেন। তাঁর মজলিসগুলো ছিল ঈমান ও আধ্যাত্মিকতায় ভরপুর। কেউ তার সঙ্গে বসলে সে নিজের গভীর ঈমান অনুভব করবে। অত্যন্ত হস্যোজ্জ্বল ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তরুণ-যুবকদের অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভাষায় যেকোনো প্রশ্নের সুন্দর জবাব দিতেন। ’
ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান মুহাম্মদ বাহি বলেন, ‘অনেক মুসলিম তরুণদের বাবা-মা ভিন্ন প্রবাসে যাওয়া দেশ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখেন না। ফলে সন্তানরা ভিন্ন সংস্কৃতির ফাঁদে পড়ে নানা সমস্যায় পড়ে। এমনকি ইসলামের পথ থেকেও হারিয়ে যায় অনেকে। এ শূন্যতা পূরণ করে প্রয়াত শায়খ উদভ্রান্ত তরুণদের আশ্রয়স্থল ছিলেন। সবাইকে তিনি সুপরামর্শ দিতেন। ’
সূত্র : আলজাজিরা ও অন্যান্য ওয়েবসাইট
সৌজন্যে কালের কণ্ঠ