ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয় পার্টি

পার্টির নেতারাই বিশ্বাস করেন না এরশাদকে!

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩১০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৮
পার্টির নেতারাই বিশ্বাস করেন না এরশাদকে! জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ফাইল ফটো

ঢাকা: জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ‘ইমেজ সংকটে’ পড়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। খোদ দলের নেতাকর্মীরাই এখন আর তার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন কয়েকজন নেতা। 

তারা বলছেন, দলীয় নেতাকর্মীদের এই আস্থাহীনতার ক্ষেত্র খোদ এরশাদেরই সৃষ্টি। এই সংকট তৈরি হয়েছে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বয়কটের ঘোষণার পর থেকে।

 

সূত্র বলছে, এরশাদের নির্বাচন বয়কট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ্য দু’টি ধারা তৈরি হয়। একটি এরশাদের নেতৃত্বে নির্বাচন বয়কটের পক্ষে। আরেকটি গ্রুপ তৈরি হয় সাবেক ফার্স্টলেডি রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নির্বাচনের পক্ষে।  

রওশন গ্রুপে প্রকাশ্যে ছিলেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জিয়াউদ্দিন বাবলু, কাজী ফিরোজ রশীদ, সদ্য প্রয়াত তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তবে কিছু নেতা ছিলেন যারা গোপনে দু’দিকেই যোগাযোগ রক্ষা করতেন।  

দলের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, প্রকাশ্যে এরশাদের বাসায় গেলে রাতের আঁধারে রওশন এরশাদের বাসায় আসা-যাওয়া করতেন কয়েকজন নেতা। এই গ্রুপের উল্লেখযোগ্য হলেন- পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ, এসএম ফয়সল চিশতী ও সুনীল শুভ রায়।
 
প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার সেদিনের ভূমিকা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী এক সাংবাদিক বাংলানিউজকে বলেন, আমার জীবনে এমন ‘স্ট্যান্ডবাজি’ দেখিনি। তার ভূমিকা দেখে বেশ সময় ধরে হেসেছিলাম সেদিন।
 
‘এরশাদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে বারিধারার বাসায় অনেকটা আবদ্ধ জীবন শুরু করেন। তখন বাবলা এসে এরশাদের সঙ্গে দেখা করে বের হয়ে বলেছিলেন, এরশাদ আমার রাজনৈতিক পিতা আমি অবশ্যই তার সঙ্গে আছি। ’ জানান ওই সাংবাদিক।  
 
তার ভাষ্য, ‘এ ঘটনার ঘণ্টাখানেক পরে রওশন এরশাদের বাসা থেকে তাকে বের হতে দেখা যায়। মুখ লুকিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। তখন তার কাছে প্রশ্ন ছিলো- আপনি কার সঙ্গে আছেন। জবাব দিয়েছিলেন, রওশন এরশাদ আমার রাজনৈতিক মাতা তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। ’

তবে সাংবাদিকদের ‘আপনি পিতা নাকি মাতার সঙ্গে থাকবেন’ এমন প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়েই চলে গিয়েছিলেন বাবলা। পরবর্তীতে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি এমপি নির্বাচিত হন।
 
জাপা নেতা এসএম ফয়সল চিশতী; তিনিও হঠাৎ করে ওই সময় এরশাদের বাসায় আসা-যাওয়া বন্ধ করে দেন। অথচ ওই সিদ্ধান্তের আগের দিন পর্যন্ত বাসা ও অফিসে এরশাদের সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকতেন ঢাকা মহানগর উত্তরের এই নেতা।  

তাকে দেখা যায়, নির্বাচনের পর এরশাদ যেদিন মন্ত্রী পদমর্যাদায় শপথ নিয়ে বাসায় ফেরেন সেদিন।
 
এরশাদের আহ্বানে যারা সাড়া দিয়ে দেশজুড়ে দুই শতাধিক প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। দ্রুত সময়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন- এরশাদের আপন ছোটভাই প্রেসিডিয়াম সদস্য জিএম কাদের, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান ও মীর আব্দুস সবুর আসুদ, হাজী সাইফুদ্দিন আহম্মেদ মিলন। অনেকে দিনরাত সমন্বয় করে এরশাদের বাসায় থাকতেন।  
 
ওই সময় এরশাদের পক্ষে যারা একাট্টা ছিলেন, তারা ভেবেছিলেন তারাই সঠিক পথে রয়েছেন, অন্যরা বেঈমানি করছে পার্টি তথা এরশাদের সঙ্গে। তাদের ভাষ্য, পার্টির সুদিন এলে নিশ্চয়ই এরশাদ বেঈমানদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেবেন। আর যারা তার পেছনে একাট্টা আছেন তাদের মূল্যায়ন করবেন। খোদ এরশাদও তখন এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
 
কিন্তু নির্বাচনের পর ধীরে ধীর বদলে যেতে থাকে প্রেক্ষাপট। বদলে যান এরশাদ নিজেও। সে সময়ের রাজনৈতিক ‘ভিলেন’রাই আবার পার্টির চালকের আসনে। মহাসচিবের স্ত্রী রতনা আমীন হাওলাদার মনোনয়ন প্রত্যাহার না করে এমপি নির্বাচিত হন।  

তাকেই পদোন্নতি দিয়ে পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান থেকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়। এ ধরনের অসংখ্য নজির রয়েছে।
 
পার্টি সূত্র জানায়, ওই সময়ে যারা এরশাদের নির্দেশ অমান্য করেছিলেন তাদের হাতেই বিভিন্ন জেলা কমিটির দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন এরশাদের চারপাশে যে বল, তার নেতৃত্বও দিচ্ছেন ‘ভিলেন’রাই। এতে ধীরে ধীরে হতাশা বাড়তে থাকে ত্যাগী নেতাকর্মীদের মধ্যে। পার্টির কার্যক্রম থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন পরীক্ষিত নেতারা।  

অনেকে মন্তব্য করেছেন, আমরা কি তাহলে সেদিন ভুল করেছিলাম, নাকি এরশাদের মনের ভাষা আমরা বুঝতে পারিনি। না এরশাদ ইচ্ছা করেই আমাদের বিভ্রান্ত করেছেন, যেটা আমরা ধরতে পারিনি।  
 
পরীক্ষিতদের মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা বলেন, এরশাদ কেন ভিলেনদের বুকে তুলে নিলেন? আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। আর এসব কারণে অনেকে আর এরশাদকে বিশ্বাস করতে চান না। আগামীতে বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নেবেন, এরশাদ বললেও হয়তো ঝাঁপিয়ে নাও পড়তে পারেন তারা।
 
এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বাংলানিউজকে বলেন, এরশাদের নির্দেশনা অমান্য করে যারা লাভবান হয়েছেন, অন্যদিকে যারা ভালো ফল পাননি এ ধরনের প্রেক্ষাপট পার্টির ডিসিপ্লিনের ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি করে। ভবিষ্যতে এমন প্রেক্ষাপট তৈরি হলে, অনেকে নির্দেশনা নাও মানতে পারেন। এটা পার্টির নেতৃত্বের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করে।  
 
এতে পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে কি-না? এমন প্রশ্নে তার উত্তর, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো বক্তব্য দিতে চাই না। ’

বাংলাদেশ সময়: ০৯০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৮
এসআই/এমএ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।