মানুষের কয়টি চোখ? ভাবছো এ আবার কেমন প্রশ্ন! মাকড়সার চোখ আটটি হতে পারে, হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গা প্রতিমার তিনটি চোখ থাকতে পারে, মাছির দু’টি চোখ ছোট ছোট কিছু চোখের সমষ্টি হতে পারে, কিন্তু মানুষের তো দু’টি চোখ। তাই না?
কেউ আবার অন্তর্দৃষ্টি নামে একটা শব্দ ব্যবহার করেন।
অবাক হচ্ছো? তাহলে কোথায় আছে এই তিন নম্বর চোখ? কালের বিবর্তনে এই চোখটি অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণীতে একটি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির মতো কাজ করে। তিন নম্বর চোখটি সম্পর্কে জানার আগে চলো অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি সম্পর্কে জেনে নেই।
আমাদের দেহে অনেক অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি রয়েছে। এসব গ্রন্থি থেকে হরমোন নিঃসৃত হয়। এসব হরমোন আমাদের বেড়ে ওঠাসহ দেহের বিভিন্ন কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে, আমাদের একটি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি আছে যেটি অন্যগুলি থেকে একেবারে আলাদা। কারণ, এই গ্রন্থিতে রেটিনার মতো দেখতে কিছু কোষ আছে; এমনকি সত্যিকারের চোখের মতো নিজস্ব স্নায়ু অথবা স্নায়ুকোষের মতো কোষও রয়েছে। এই গ্রন্থিটির নাম পিনিয়াল গ্রন্থি। হ্যাঁ, এটিই সেই গ্রন্থি যাকে আমরা তিন নম্বর চোখ বলছি।
পিনিয়াল গ্রন্থিটি আমাদের মস্তিষ্কের অনেক গভীরে অবস্থিত। গ্রন্থিটি থেকে আমরা পাই মেলাটোনিন হরমোন। দেখা গেছে, হরমোনটি নিঃসরণের পরিমাণ আলো থাকলে কমে, অন্ধকারে বাড়ে। “যথেষ্ট আলো আছে”, “স্বল্প আলো আছে”, “অন্ধকার”: এই সংকেতগুলো আমাদের আসল চোখ থেকে স্নায়ুকোষের মাধ্যমে পিনিয়াল গ্রন্থিতে পৌঁছায়। এর ফলে গ্রন্থিটি মেলাটোনিন নিঃসরণের মধ্য দিয়ে ২৪ ঘণ্টায় আমরা সজাগ থাকবো কতক্ষণ, ঘুমোবো কতক্ষণ, এসব নিয়ন্ত্রণ করে। এই ব্যাপারটির একটা গাল ভরা নাম আছে: বায়োলজিক্যাল ক্লক, অর্থাৎ জৈবঘড়ি। দেহঘড়ি শব্দটিও বেশ যায়।
তিন নম্বর চোখের কাজ কিন্তু এতেই শেষ নয়। শুধু যে ঘড়ি হিসেবে চোখটি ব্যবহৃত হয়, তাই নয়। দেখা গেছে, শীতল রক্তের প্রাণীরা থার্মোমিটার হিসেবে এই চোখকে ব্যবহার করে। শরীরের তাপমাত্রা মেপে প্রাণীটিকে সে সিগন্যাল দেয় কখন লুকোতে হবে বা কখন শীতনিদ্রায় যেতে হবে।
ঘড়ি, থার্মোমিটারের পর এবার ফেয়ারনেস ক্রিমের পালা। ব্যাঙের ত্বকের রং নিয়ন্ত্রণ করে পিনিয়াল গ্রন্থির মেলাটোনিন হরমোনটি। যতো বেশি মেলাটোনিনের পরিমাণ বাড়বে, ততোই ব্যাঙের রং হালকা হতে থাকবে। দেখা গেছে, ব্যাঙকে অন্ধকারে রেখে দিলে তার রং ফর্সা হয়ে যায়। কেননা, অন্ধকারে মেলাটোনিনের পরিমাণ বাড়ে।
বলছিলাম, তিন নম্বর চোখটি রয়েছে মস্তিষ্কের অনেক গভীরে। কিন্তু কথাটি শুধু পাখি আর স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে খাটে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, ব্যাঙ ও অন্যান্য উভচর প্রাণী আর সরীসৃপ প্রাণীদের কপালেই থাকে চোখটি। ওরা ঘড়ি, থার্মোমিটার আর ফেয়ারনেস ক্রিম হিসেবে ব্যবহার করার পর, এই চোখটি দিয়ে নাকি দেখতেও পায়!
টুয়াটারা নামের একটি গিরগিটির মতো সরীসৃপকে বলা হয় জীবন্ত ফসিল। কেননা এটি আদিম যুগ থেকে এখনো পৃথিবীতে টিকে আছে। এই টুয়াটারার আছে সবচেয়ে সুগঠিত তৃতীয় চোখ। চোখের মতোই, এটিতে লেন্স, রেটিনা সবই আছে। অবশ্য আদিম যুগের অনেক প্রাণীদেরই এই চোখের অস্তিত্ব ছিলো। অনেক বিলুপ্ত প্রাণীদের মাথার খুলি পরীক্ষা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা একটি গর্ত দেখেন। এই গর্তটি ছিলো তিন নম্বর চোখের বসবার খোপ।
ধারণা করা হয়, এই চোখটি দিয়ে আদিম উভচর প্রাণীরা পানির উপরিতলের কাছাকাছি থেকেই, একটি চোখ বের করে দেখে নিতে পারতো ডাঙাতে কোনো বিপদ আছে কিনা। তাই, সে সময়, চোখটি যে টিকে থাকার জন্য বেশ জরুরি ছিলো, বলার অপেক্ষা রাখে না।
পরবর্তীতে, বিবর্তন প্রক্রিয়ায়, চোখটি আধুনিক প্রাণীতে একটি সম্পূর্ণ অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিতে পরিণত হয়।
ল্যামপ্রে মাছ আরেকটি জীবন্ত ফসিল। এদের আবার দু’টি অতিরিক্ত চোখ। একটির পেছনে আরেকটি। একটি পিনিয়াল গ্রন্থি থেকেই উদ্ভূত; অন্যটি প্যারাইটাল নামক আরেকটি গ্রন্থি থেকে।
ব্যাঙ, সাপ, গিরগিটি, গোসাপ, টুনামাছ, হাঙর- এসব প্রাণীর তিন নম্বর চোখ মাথার উপর একটি আলোকসংবেদী বিন্দু হিসেবে দেখা যায়। এটি একাধারে একটি চোখ এবং গ্রন্থি। অনেক সরীসৃপেই এই চোখটি আঁইশ দিয়ে ঢাকা থাকে। সেটি দেখার কাজে ব্যবহৃত হয় না।
বন্ধুরা, এতক্ষণে বোধহয় বুঝে গিয়েছো, আমি কেনো বলছিলাম, আমাদের আসলে তিনটি চোখ। জেনে গিয়েছো, এই তিন নম্বর চোখটি কোথায় থাকে আর তার কাজ কি। তবে তিন নম্বর চোখটিতে আরো কিছু রহস্য আছে কি না, সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীদের খোঁজ কিন্তু এখনও শেষ হয় নি। কি জানি, হয়তো আরও কিছু বিস্ময় লুকিয়ে রেখেছে তিন নম্বর চোখ!
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি[email protected]