ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

তবুও বৈশাখ আনন্দ-বেদনায়

মীম নোশিন নাওয়াল খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৩
তবুও বৈশাখ আনন্দ-বেদনায়

পাখির কিচিরমিচির ডাক শুনে আস্তে আস্তে চোখ মেললো মতি। ভোর হয়েছে নিশ্চয়।

ওই তো মোরগের ডাকও শোনা যাচ্ছে। মতি এক লাফে উঠে পড়ল। হাত- মুখ ধুয়ে এসে দৌড়ে গেল পাকঘরে।

-মা, আমার খিদা লাগছে। খাওন দে।

-দিতেছিই তো। তরকারিটা এহনো হয় নাই। তুই যা, গিয়া দ্যাখ তোর বাপে কই। হ্যারে খাইতে আইতে ক।  
মতি আবার ছুটে গেল তার বাবাকে ডাকতে। মতির বাবার অনেক কাজ। আজ হাটবার। বাজার-সদাই করতে হবে। চারদিন বাদেই পহেলা বৈশাখ। আগাম প্রস্তুতি তো কিছু আছেই। তাই বাড়তি কিছু সদাই আছে। আজ আবার পাশের গাঁয়ে মোষের হাট বসবে। নিজেদের মোষটা বিক্রি করে আরেকটা মোষ কিনবে মতির বাবা। মতিদের মহিষটা বুড়ো-হাবড়া হয়ে গেছে। গাড়ি টানার উপযোগী নেই। তাই আরেকটা কিনতে হবে। আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। মতিও তাই যাবে ওর বাবার সাথে। সকাল সকাল রওনা দিতে হবে। যেতে হবে জেলেপোতা গ্রামের মোষের হাটে। সেখান থেকে ফেরার পথে গাঁয়ের হাট থেকে সদাই করে বাড়ি ফিরবে ওরা। শুধু এটুকুই না। বৈশাখ আসার আগে অনেক কাজ। কালকে মতির বাবা ঘরের টিন বাঁধবে। ওদের টিনের ঘর। বৈশাখ এলে আর রক্ষে নেই। কালবৈশাখী ঘরের টিন উড়িয়ে নেবে। তার আগেই ভালোভাবে ঘরের চাল মেরামত করে টিন বাঁধতে হবে।    

-বাহ মতি! তোদের মোষটা তো বেশ তাগড়া হয়েছে রে!  মতিদের মোষটার গায়ে হাত বুলিয়ে মুগ্ধ কণ্ঠে বলে আনিস।

মতি প্রশংসা শুনে গর্বিত ভঙ্গিতে মোষটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। এই মহিষটাকেই তারা হাট থেকে কিনে এনেছে। ওকে দিয়ে গাড়ি টানানোও শুরু হয়েছে। তবে এখনো ওকে গাঁয়ের অন্য মোষগুলোর সাথে একপালে রাখা হয় না। নতুন মোষ তো! ওর সাথে অন্যগুলো বা ও অন্যগুলোর সাথে মারামারি বাধালে তুলকালাম কাণ্ড হবে। তাই নতুন মোষটাকে একটু আলাদা রাখা হয়।

-হ্যাঁ রে মতি! কাল কিন্তুক বোশেখের শুরু। দত্তনগর ফারমে যাচ্ছি কিন্তুক। এবার চড়ুইভাতিটা জমিয়ে করতে হবে। আগেরবার তো খিচুড়িটা পুড়ে গিয়ে সব মাটি করে দিল। মতিকে বলে আনিস।

-হুম। তা তুই ঠিকই বলেছিস। তা কাল কিন্তুক জেলেপোতা গাঁয়ে বোশেখি মেলা হবে। আগেরবার আমরা যাইতে পারিনি। এবার কিন্তুক দত্তনগর থেকে আসার সময় ওখেন থেকে ঘুরে আসতে হবে। তাইলে কাল ভোর ভোর সক্কলে গাড়ি নিয়া পোড়ো বটতলায় চইলে আসিস। নাইলে কলাম দেরি হয়ে যাবে। আবার তো দুপুর গড়াইতেই ফেরা লাগবে। মেলায় যাইতে হবে।   হাত তুলে বক্তৃতা দেয়ার ভঙ্গিতে পেয়ারা গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালটা থেকে পা দোলাতে দোলাতে বলল মতি। কথাগুলো অন্য ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলা। ওরা সবাই এখানে প্রায় সমবয়সী। বয়স সবার এগার থেকে তেরোর মধ্যে। বন্ধুত্বও তাই অনেক গভীর।

গ্রামে যাঁদের বয়স নব্বইয়ের বেশি তারা বলেন ওই পোড়ো বটগাছে নাকি ব্রহ্মদত্যির বাস। তবে ব্রহ্মদত্যি যদি আদৌ থেকেও থাকে সেখানে, এই দুরন্ত কিশোররা তাকে থোরাই কেয়ার করে! তাকে নিয়ে ওদের বিশেষ মাথাব্যথা নেই, নেই কোনো ভয়ডরও। সারাটাদিন ছেলেরা পার করে দিল পরদিনের চড়ুইভাতির পরিকল্পনা করে। প্রতিবছরই তারা চড়ুইভাতি করে। পরিকল্পনায় কখনো ভিন্নতা আসে না। তবুও তারা প্রতিবছর চৈত্র মাসের শেষ দিনটা চড়ুইভাতির পরিকল্পনা করে কাটিয়ে দেয়। এতেও এক অন্যরকম আনন্দ।

কাল ভোর হতেই সবাই যার যার মোষের গাড়ি নিয়ে বটতলায় চলে আসবে। বাসা থেকে প্রত্যেকে নিয়ে আসবে আধা কেজি চাল, এক পোয়া ডাল, চারটে করে রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, খানিকটা করে নুন আর হলুদ। ওরা সবে মিলে বারোজন। চাল অনেক বেশি হয়ে যাবে। বাড়তি চাল বিক্রি করে তেল আর অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিস কিনে নেবে। তারপর দত্তনগর গিয়ে সবকিছু দিয়ে জমিয়ে খিচুড়ি রেঁধে খাবে। এমনটাই পরিকল্পনা নিয়ে সন্ধ্যেবেলা ঘরে ফিরল সবাই। মনে উঁকি দিচ্ছে চড়ুইভাতির ঝলমলে স্বপ্ন।

মোরগ ডেকে উঠতেই মায়ের কাছ থেকে চাল-ডাল, নুনসহ সব জিনিস নিয়ে মোষের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মতি। আজ পহেলা বৈশাখ। তারা আনন্দ উদযাপন করবে চড়ুইভাতি করে।

শহুরে মানুষেরা পহেলা বৈশাখে লাল-সাদা জামা পরে। নতুন জামা। তারপর ঘুরতে যায়। শখ করে পান্তা-ইলিশ খায়। একদিনের জন্য বাঙালি সাজে। কিন্তু গ্রামের চিত্রটা মোটেও তেমন নয়। না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল একই দেশের দুই প্রান্তে কত অমিল থাকতে পারে।

গ্রামাঞ্চলে মানুষ আলাদা করে বাঙালি সাজে না। তাদের দৈনন্দিন জীবনটাই খাঁটি বাঙালিয়ানায় পূর্ণ। কেউ লাল-সাদা দামি পোশাক পরে বৈশাখ উদযাপন করে না। তাদের আনন্দটা একদম অন্যরকম। টাকা দিয়ে কেনা আনন্দ নয়। একেবারে নির্মল খাঁটি আনন্দ। সেজন্যই তো মতির পরনে একটা হাতাকাটা গেঞ্জি-হাফ প্যান্ট আর মাথায় বাঁধা গামছা। শুধু মতি একা নয়, সবারই একই রকম বেশ। ওরা সবসময় এভাবেই থাকে। ঘুরতে যাওয়ার জন্য সুন্দর কাপড় পরার রেওয়াজ গ্রামে নেই।

বটতলায় সবাই জড়ো হওয়ার পর খানিক্ষণ নিজেদের পরিকল্পনাগুলো ঝালাই করে রওনা দিল কিশোরের দলটি। বাজারে থেমে বাড়তি চাল বিক্রি করে দরকারি জিনিসপত্র কিনে নিয়ে ফের রওনা দেয় ওরা।

একসঙ্গে আটটা মহিষের গাড়ি ছুটে চলেছে। মহিষের পায়ের খুরে পথের ধুলো উড়ছে। মাথার উপর নীল আকাশ। ফুরফুরে মিষ্টি বাতাস। দূর থেকে দেখে মনে হবে কুয়াশা ফুঁড়ে এগিয়ে আসছে একদল সাহসী কিশোর, সব অন্যায়-অবিচার দূর করে সুন্দর আগামী গড়ার প্রত্যয়ে।

ওদের মধ্যে যাদের গাড়ি নেই তারা অন্যদেরটায় উঠেছে। সবার মনে স্ফুর্তি। সবাই হৈ-হুল্লোড় করতে করতে চলেছে। গাঁয়ের শেষ প্রান্তে গিয়ে সবগুলো মোষের গাড়ি থেমে গেল। এখানে কয়েকটা ফুলের ক্ষেত। গোলাপ আর রজনীগন্ধা ফুলের চাষ হয়। সব গাড়িগুলো একসাথে দাঁড় করিয়ে রেখে ওরা ফুলের ক্ষেতে হৈ হৈ করতে করতে ঢুকে গেল কারো অনুমতির তোয়াক্কা না করেই। মতির গাড়িটা রাখা হল খানিক দূরে। মনের মতো ফুল তুলে কিশোর দলটি তাদের গাড়িগুলোর ছই সাজাল ইচ্ছেমত। কেউ তাদের বাঁধা দিল না। আধঘণ্টা পর দেখা যায় সবগুলো গাড়ির ছই গোলাপ-রজনীগন্ধায় সাজানো, লাল-সাদা রঙে রাঙানো। সে এক চমৎকার দৃশ্য!
আবার ওরা মোষগুলোকে ছোটায়। এখনো অনেক পথ বাকি। কিছুদূর যেতেই শুরু হয় টিপটিপ বৃষ্টি। মতি চিন্তিত হয়ে পড়ে। ঝড় উঠবে না তো? বৈশাখের প্রথম দিন কালবৈশাখী ঝড় ওঠে। তেমনটা হলে ওরা চড়ুইভাতি কীভাবে করবে? বৃষ্টির মাঝেই ওরা চলতে থাকে। ধীরে ধীরে আকাশও কালো মেঘে ছেয়ে যেতে শুরু করে। ওরা বিলের কাছে পৌঁছাল, ততক্ষণে ঝমঝম বৃষ্টি সব ভিজিয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে দমকা বাতাস। এর মধ্যে চলা সম্ভব না। তাই ছেলেরা সব মোষগুলো বিলের পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নিল। বৃষ্টি কমলে রওনা দেবে। মতি শুধু তার গাড়িটাকে আলাদা রেখে মোষটার পিঠে বসে রইল। বৃষ্টিটা কমে আসছে। আরেকটু পরেই তারা যেতে পারবে। হঠাৎ বিকট একটা শব্দ হল। সবাই চিৎকার করে উঠল। মোষগুলো জোরে ডেকে উঠল। কিন্তু মতির বা তার মোষের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। চিৎকার শুনে গ্রামের লোকজন ছুটে এলো। শব্দটা ছিল বজ্রপাতের। ওরা বড্ড ভয় পেয়েছে। কিন্তু মতি কিছু বলল না যে? সবাই মতির কাছে গিয়ে দেখে সে আর তার মোষটা স্থির হয়ে আছে। সাড়াও দিচ্ছে না, নড়ছেও না। কেউ একজন মতিকে ঝাঁকি দিতেই সে দুম করে পড়ে গেল। শরীরে তার প্রাণের স্পন্দন নেই। মতির নিস্তেজ দেহের পাশেই বাজটা পড়েছে। একটা তালগাছ পুড়ে গেছে। একটা চিল তার উপর দিয়ে উড়ে গেল। কোত্থেকে যেন কতগুলো কুকুর ডেকে উঠল। যেন মতির জন্য কেঁদে উঠল। সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। সেই বৃষ্টির ফোঁটা গড়াচ্ছে সবার গাল বেয়ে। একী শুধুই বৃষ্টির ফোঁটা? নাকী মতির জন্য ভালবাসার সামান্য প্রকাশ হিসেবে নিজের অজান্তেই খানিকটা অশ্রু ঝরানো? কেউ জানে না এসব প্রশ্নের উত্তর। শুধু সবাই বুঝতে পারে তাদের চোখ ভারি হয়ে ভিজে আসছে।

আবার এসেছে পহেলা বৈশাখ। দস্যি ছেলের দলটি দত্তনগর ফার্মে চড়ুইভাতি করছে। শুধু একজন নেই। মতি। অনেকদিন আগে এমনই একটা দিনে মতি হারিয়ে গেছে চিরদিনের মত। কিন্তু সে বেঁচে আছে বন্ধুদের মনের মাঝে। সবাই তাকে দেখতে পাচ্ছে। ওই তো, মোষের গাড়িতে বসে হাসছে। একটা দূর্ঘটনা মতিকে সরিয়ে দিয়েছে তার বন্ধুদের কাছ থেকে। সে দুর্ঘটনা ভোলার নয়। তবুও ওরা প্রতিবছর এই দিনে চড়ুইভাতি করে আনন্দ করে। সেই দিনের কথা কেউ মনে করে না। তবুও মাঝেমধ্যে মনের কোন এক কোণে অনুভূত হয় চিনচিনে ব্যথা, প্রিয় বন্ধুকে হারানোর ব্যথা। চোখের পর্দায় হঠাৎই ভেসে ওঠে তাদের মতো এক দুরন্ত কিশোরের মুখ, যার নাম মতি।
তবুও কিছু থেমে থাকে না। জীবন চলে তার নিজের গতিতে, কোন কিছুই তাকে থামাতে পারে না, মুছে দিতে পারে না আনন্দগুলো। আর সেজন্যই তো বারবার বৈশাখ আসে, আনন্দ নিয়ে আসে। সবাইকে সিক্ত করে আনন্দধারায়। কখনো কখনো বৈশাখ আসে বেদনা হয়েও, আসে অনেক দুঃখ নিয়ে। অশ্রু ঝরায় চোখ দিয়ে। কিন্তু তারপরেও মানুষ অপেক্ষা করে বৈশাখের জন্য, বেদনাকে তুচ্ছ করে আরেকটিবার আনন্দে মেতে ওঠার জন্য। আর সেজন্যই বৈশাখ আসে, বারবার আসে। আর আমরা তাকে বরণ করি মনের সবটুকু আনন্দ নিংড়ে, গভীর ভালবাসায়।

বাংলাদেশ সময়: ২০৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।