ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

মানুষ এমনটাই হওয়া উচিত

মীম নোশিন নাওয়াল খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫১ ঘণ্টা, জুন ৮, ২০১৩
মানুষ এমনটাই হওয়া উচিত

টেবিলে বসে চামচ দিয়ে টুংটাং শব্দ তুলে যাচ্ছে জাওয়াদ। আমি মুখ ডুবিয়ে আছি ডায়রির মধ্যে।

হাতের কলম চলছে ডায়রির উপর। মাম-বাপি রং-চং কী কী জিনিস যেন কিনতে গিয়েছিল। ফিরল কিছুক্ষণ আগে। সব আয়োজন নতুন ফ্ল্যাটের জন্য। |

আমি কেবল ডায়রির পাতায় আমাকে একটা নদীতে ডুব দেওয়াব, এমন সময় মাম ভাত নিয়ে এসে চেঁচামেচি শুরু করে দিল। কী আর করা! আমাকে পানির মধ্যে রেখেই ডাইনিং টেবিলে চলে এলাম আমি। মাম আমাকে ভাত বেড়ে দিয়ে বলল, আমি তোমাকে একটা ঘটনা বলি। আজকে ঘটে যাওয়া সত্যি ঘটনা। মাম বলতে শুরু করল মামের সেই সত্যি গল্প। আমি হ্যাঁ হুঁ করে শুনতে লাগলাম।

আমি আর তোমার বাপি রং-টং কিনে তোমার বড় খালামণির বাসায় রেখে এসেছি। রঙের কন্টেইনার খুব ভারি।

মোটরসাইকেলে নেওয়া সম্ভব না। তাই তোমার বাপি আমাকে রিকশায় তুলে দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে এলো।

কন্টেইনার ভারি হওয়ায় তোমার বড় খালামণির বাসায় পৌঁছুনোর পর রিকশাওয়ালা ওটা লিফটে তুলে দিলো।

তোমার বাপি মোটরসাইকেল রাখতে রাখতে আমাকে বলল, তুমি ওটা নামাতে পারবে না। দাঁড়াও, আমি আসছি।

আমি তাকে বললাম, আমি দেখি লিফট থেকে কোনোভাবে নামিয়ে নিলে বুবুর বাসায় কাউকে বললে ওরা ঢুকিয়ে নেবে।

এমন সময় একজন কে বলে উঠল, চিন্তা করবেন না আংকেল, আমি আছি না? আমি নামিয়ে দেব।

তাকিয়ে দেখলাম একটা ছেলে। ২৫-২৬ বছর বয়স হয়তো। সে কথাগুলো বলছিল, কিন্তু তাকিয়ে ছিল নিচের দিকে। আমি ছয়তলায় যাবো, ও যাবে পাঁচতলায়। নিচে তাকিয়েই আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আন্টি কোন ফ্ল্যাটে যাবেন?
আমি বললাম, ৬০১।

-হাসানাতদের বাসা? জিজ্ঞেস করলো তরুণটি।
-হ্যাঁ।

ছেলেটা আর কিছু বললো না। পাঁচতলায় এসে লিফট থামলো, ছেলেটা নামলো না। বলল, আমার বাসা ৫০১। আমি নামবো না। আপনাকে কন্টেইনারটা তুলে দিয়ে আসি।

আমি নিষেধ করা সত্ত্বেও ছেলেটা আমার সঙ্গে উঠলো। আমি জানতে চাইলাম, এক্সকিউজ মি, আপনি কী করেন?
সে উত্তর দিল, আমি একটা জব করি।

ব্যস! এটুকুই।

ছয়তলায় এসে ও রঙের ক্যানটা নামিয়ে দরজার কাছে এনে দিল। তোমার বাপি ফোন করেছিল, হাসানাত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। হাসানাতকে ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো, তুমি পারবে?
হাসানাত হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। আমি ছেলেটাকে ধন্যবাদ দিলাম। সে বলল, না না আন্টি, ধন্যবাদের কী আছে?  তারপর লিফটে উঠে গেলো। আমিই পারি না, হাসানাত কীভাবে এত ভারি কৌটো তুলবে? ও তো তুলতে গিয়ে ধুম! পরে আমরা দু’জন মিলে ওটাকে ঢুকালাম। লিফটে ওই ছেলেটার ব্যবহার আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। বুবুকে জিজ্ঞেস করলাম ও কে?
বুবু বলল, আমি তো খেয়াল করিনি। কোন ফ্ল্যাট?
ফ্ল্যাট নাম্বার শোনার পর তোমার বড় খালামণি বললো, ও তোমার কন্টেইনার তুলে দিয়েছে? বলেছে জব করে? আশ্চর্য! ও তো ডাক্তার। নামটা মনে করতে পারছি না।

হাসানাতকে ডাকলাম। হাসানাত বলল, মেজ খালামণি ওটা অপু ভাইয়া। উনি ডাক্তার।

তোমার বড় খালামণি তো বিশ্বাসই করতে চায় না। আজকাল এমন মানুষ আছে নাকী? ডাক্তার ছেলে, অচেনা একটা মানুষকে এভাবে সাহায্য করলো।

এখনো ভালো মানুষ আছে পৃথিবীতে। এখনো এমন মানুষ আছে যারা অন্যের কথা ভাবে। আমি খুব খুশি হয়েছি ডা. অপুর উপর। খুব খুশি হয়েছি।

মামের কথা শেষে আমি মামের দিকে তাকিয়ে বললাম, মানুষটাকে দেখতে পেলে খুব ভালো হতো।

-আমি আগেই ঠিক করে রেখেছি, এরপর যেদিন তোমার বড় খালামণির বাসায় যাব, তোমাদের দু’জনকেই সেদিন তার কাছে নিয়ে যাবো। বললো মাম।

বুঝলাম ডা. অপুর ব্যাপারটা মামের হৃদয়ের কোনো একটা কোণায় গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। সত্যি বলতে আমার নিজেরও খুব ভালো লেগেছিল।  

একজন ডাক্তারের কী কাজ? মানুষের সেবা করা। এখনকার ডাক্তাররা তো সেটাই করেন না। রোগীর সঙ্গে ভালো করে কথা পর্যন্ত বলেন না। করেন দুর্নীতি। সেখানে ডা. অপু নিজের দায়িত্বের বাইরেও মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। এমন মানুষ ক’জন দেখা যায় আজকের এই সমাজে?
আমি মনে মনে বলছিলাম, ভালো থাকুক ডা. অপু। ভালো থাকুক সেই সব মানুষ যারা আজও এই স্বার্থপর পৃথিবীতে সবার সঙ্গে এক জোয়ারে গা না ভাসিয়ে ভাবে মানুষের কথা। যে মানুষগুলো আজও অন্যকে সাহায্য করে আত্মতৃপ্তি পায়, আনন্দ পায়- স্যালুট সেসব মানুষগুলোকে।  

আমি এসব ভাবতে ভাবতে মাম থ্রিতে পড়ুয়া ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার জাওয়াদ বড় হলে ডা. অপুর মতো হবে, মানুষের পাশে দাঁড়াবে। তাই না জাওয়াদ?
জাওয়াদ কিছু বলল না। হালকা হাসলো কেবল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম মামের চোখের কোণে চিকচিক করছে মুক্তোর মতো অশ্রু। এ অশ্রু কষ্টের নয়, নয় আনন্দের। এ অশ্রু সম্পূর্ণ আলাদা। স্বপ্নের, বিশ্বাসের, প্রত্যাশার...  

বাংলাদেশ সময়: ১৯২০ ঘণ্টা, জুন, ০৮, ২০১৩
এএ[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।