স্বপ্ন দেখার কোনো নিয়মনীতি থাকে, নাকি আদৌ কোনো ব্যাকরণ থাকে সে কথা আমার ঠিক জানা নেই। আমার বিদ্যের দৌড় এখনো অতদূর পৌঁছেনি।
কী মুশকিল! নাছোড় তিতলি। এখন আমি কী করি?
এ ঝামেলার সূচনা ঘটিয়েছে আমাদের আম্মু। সারারাত ভালো ঘুম হয় না তার, নানান রকম স্বপ্ন দেখেই রাতের প্রহর পাড়ি দেয়। কত না রংবেরঙের স্বপ্ন তার চোখে এসে ধরা দেয়। তারপর দিনের বেলা একটু একটু করে ছাড়বে তার স্বপ্নের সুতো- কোনোদিন দাদুবাড়ির স্বপ্ন, কোনোদিন নানুবাড়ির স্বপ্ন; গত ডিসেম্বরে সবাই মিলে কক্সবাজার থেকে বেড়িয়ে আসার পর মাসখানেক চলল সমুদ্রের স্বপ্ন। হিমছড়ির ঝরনাধার, ডুলহাজরার সাফারি পার্ক সবই নাকি আম্মুর চোখে ঘুরে ফিরে আসে, আর সুযোগ পেলেই আমাদের শোনায় সেই স্বপ্নবৃত্তান্ত। এসব শুনে আব্বু শুধু হা হা করে হাসে। নানা রকম ঠাট্টা তামাশাও করে। তার হাসি শুনেই আমি বেশ অনুমান করতে পারি, এসব স্বপ্ন বিবরণে আব্বুর বিশেষ আস্থা নেই। আম্মুর স্বপ্ন দেখার সঙ্গে নিজের ছোটবেলাকার ঘুড়ি ওড়ানোর গোলমেলে এক তুলনা করে আব্বু বলেন, নাটাই চিনিস খোকা? ঘুড়ির নাটাই?
আমার নাম শাওন। তবু আব্বু যখন খোকা বলে, তখন বেশ মিষ্টি লাগে শুনিতে। ঈদের সময় গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখেছি, আমার দাদি এখনো অব্বুকে ডাকে খোকা বলে। ছোট্ট বালকের মতো আব্বু বেশ জবাবও দেয় ভারি আদুরে গলায়। আব্বুর মুখে খোকা ডাক শুনে আমারও মনের ভেতরটা কাদামাটির মতো নরম হয়ে যায়, আমি কান খাড়া করে থাকি। আব্বু বলেন, তোর আম্মু রোজ স্বপ্নের লাটাই থেকে সুতো ছাড়ে বুঝেছিস? জাদুর সুতো। সেই সুতো কিছুতেই ফুরোয় না।
আম্মু ক্ষেপে যায়, ক্ষোভ ঝাড়ে,
আমি তাহলে বানিয়ে বানিয়ে রোজ গল্প বলি, কেমন।
আব্বু কুটুশ করে চিমটি ঝাড়ে,
আহা! গল্প বানানো কি কম প্রতিভার ব্যাপার কেমন!
আম্মু রেগে যায়,
আচ্ছা, ঠিক আছে। আমার স্বপ্নে কথা আর তোমাদের কাউকে বলবো না। এ ঘটনার পর বেশ দু’তিন দিন আমাদের কেটে গেল স্বপ্নহীন। আব্বু তবু বেশ খুনসুঁটি করে- আকাশে বাতাস নেই বুঝেছিস খোকা! ঘুড়ি টানছে না, লাটাইয়ের সুতোও আর খুলছে না।
আমারা চাইছিলাম এই থমথমে অবস্থা কেটে যাক দ্রত, বাতাস উঠুক প্রবল, টান ধরুক ঘুড়িতে; লাটাইয়ের সুতো না ছেড়ে থাকবে কতক্ষণ! হ্যাঁ, খুব বেশি সময় লাগেনি। ওই চার পাঁচদিনের মাথায় ঘুড়িতে বাতাসের টান ধরেছে আবার। ভোরবেলায় তিতলিকে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে আম্মু তার দুই গালে টকাস টকাস করে গোটা দশেক চুমু খাওয়ার পর তিতলির চোখের গভীরে চোখ রেখে বলে,
তুই যে আমার ফুলপরী হয়ে যাচ্ছিস মা!
ফুলপরী! খিলখিল করে হেসে ওঠে তিতলি। বিস্ময়ে চোখ গোল করে সে জানতে চায়, পরীর মত ডানা আমি কোথায় পাব আম্মু?
কী মুশকিল! আজ রাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম যে! ফুলপরীদের সঙ্গে মিশতে মিশতে তুইও কেমন সুন্দর পরী হয়ে গেছিস। ডানা মেলে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছিস। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিস।
তিতলি দুম করে প্রশ্ন করে,
তুমি আবারও স্বপ্ন দেখেছ আম্মু?
ও মা! আমি তো রোজই স্বপ্ন দেখি।
তিতলি এবার জোর করে আবদার জানায়, আমিও একটা স্বপ্ন দেখতে চাই আম্মু।
বড় হ। বড় হলেই দেখতে পাবি।
তিতলির আর তর সইছে না। কেমন করে স্বপ্ন দেখা যায় তাই নিয়ে অনেক রকম প্রশ্ন করে জেরবার। অনেকদিন আগে আমিও একদিন স্বপ্ন দেখা নিয়ে আম্মুকে খুবই বিরক্ত করেছিলাম। আমার স্বপ্নে ঘুরে ফিরে স্কুলের বন্ধুরা আসে, তাদের সঙ্গে মারামারি হয়, কখনোবা স্যারদেরও দেখতে পাই। কেন এমন হয়-এই প্রশ্ন করায় আম্মু সেদিন আমার উপরে সাংঘাতিক রেগে যায়। ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, তুই বাপু তোর মতই স্বপ্ন দেখিস, আমার সঙ্গে লাগতে আসিস না। যা।
এতদিন পর তিতলির পীড়াপীড়িতে বিরক্ত হয়ে আম্মু আবার আমার কাছে ঠেলে পাঠায় ওকে। স্বপ্ন কেমন করে দেখতে হয় সেই কলা কৌশল নাকি শেখাতে হবে আমাকে। এ কোন মুশকিল! কোনো কিছুতে না বলাও যাবে না। এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পাবার খবরে আব্বু বলেন- আমাদের যুগে এত নম্বর পাবার কথা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি বাপু। ম্যাট্রিক পাস ভদ্রলোক হিসেবে এখন থেকে তোমাকে দায়িত্বশীল হতে হবে কিন্তু! কোনো কাজেই ‘পারিবনা’ বলা চলিবে না। হ্যাঁ।
আব্বুর এ পরামর্শ আমি মোটেই ভুলিনি। সহজে আমি পারব না বলতেও চাই না। তাই বলে আমার ছোটবোন তিতলিকে স্বপ্ন দেখানোও শেখাতে হবে! তিতলি পড়ে ক্লাস ফোরে। ওর বইয়ের অংক ইংরেজি কিংবা অন্য যে কোনো বিষয় বুঝিয়ে বলা কিংবা নিয়মকানুন ধরে শেখানো আমার পক্ষে আদৌ অসম্ভব নয়, খুব আনন্দের সঙ্গেই সেটা আমি পারব; কিন্তু আমার সামনে এ কোন গেরো। ক্ষণে ক্ষণে তিতলির আবদার- ও ভাইয়া, বলো না কেমন করে স্বপ্ন দেখা যায়। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড রাগও হয়। স্বপ্নছাড়া রাত কাটেনা আম্মুর, এ দায়িত্বটা আম্মু নিলেই পারে! নাছোড় তিতলির অবুঝ প্রশ্ন-তুমি কখনো স্বপ্ন দেখেছ ভাইয়া?
মিথ্যে বলতে পারি না, সত্যি স্বীকার করি, হ্যাঁ, দেখেছি তো বেশ কয়েকদিন।
কয়েকদিন! তিতলির ব্যাকুল প্রশ্ন, কী করে দেখলে ভাইয়া?
এটা কোনো প্রশ্ন হলো! এ প্রশ্নে কী জবাব হয়? আমি কোনো কুল কিনারা খুঁজে না পেয়ে দুম করে ওর মুখের উপর জিগ্যেস করে বসি,
আচ্ছা তিতলি, বল দেখি তোর রোল নম্বর কত?
তিতলি জানায়, তিন।
তার মানে ক্লাসের মধ্যে তুই থার্ড। তোর কখনো ফার্স্ট হতে ইচ্ছে করে না?
হ্যাঁ, করে তো!
এই ইচ্ছে করাটাও এক রকম স্বপ্ন।
বিশ্বাস হয় না তিতলির। সে বলে, ধ্যাৎ! তুমি আমাকে ফাঁকি দিচ্ছো। আমি তখন বুঝতে চেষ্টা করি- না না, ফাঁকি দেব কেন! স্বপ্ন দুই রকমের হয়।
তাই নাকি! দুই রকম স্বপ্ন!
হ্যাঁ। এক রকমের স্বপ্ন আছে, যা বিনা চেষ্টাতেই ঘুমের ঘোরে পাওয়া যায়। মনে কর- ফার্স্ট হবার কথাটা তুই সারাদিন মনে মনে ভাবছিস। রাতে ঘুমানোর পর স্বপ্নে দেখা গেল, নিশিকে হটিয়ে তুই ফার্স্ট হয়ে গেছিস।
কথার মধ্যে বাধা দেয় তিতলি- ঘুমুলে আবার দেখা যায় নাকি?
আমি বলি, যায় যায়। স্বপ্ন দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যায় না।
কী রকম?
এই যেমন ধর- রাতের স্বপ্নে ফার্স্ট হবার পর সকালে স্কুলে গিয়ে যদি দাবি করিস তুইই ফার্স্ট, মানবে সবাই?
ধ্যাৎ! তাই হয় নাকি!
ঠিক। হয়না। রাতের স্বপ্ন দেখার জন্যে কোনো চেষ্টা করাও লাগে না। বাস্তবেও মেলে না। কিন্তু দিনের স্বপ্নের ব্যাপারটা আবার অন্যরকম।
হি হি করে হাসিতে লুটিয়ে পড়ে তিতলি। হাসি থামলে সে শুধায়।
দিনেও স্বপ্ন দেখে মানুষ?
হ্যাঁ, সেটাই তো বাস্তব স্বপ্ন।
কী রকম?
যেমন ধর-তুই ফার্স্ট হতে চাস। এটাই তোর স্বপ্ন, সাধনা, ইচ্ছে। এবার ফার্স্ট হবার জন্যে সাধ্যমতো চেষ্টা কর, মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া কর; আগামী পরীক্ষায় ফার্স্ট হতেও পারিস। তাহলেই স্বপ্ন হবে সত্যি, বাস্তব।
তিতলি এবার দুই গালে দুই হাত লাগিয়ে বলে,
বাব্বা! স্বপ্ন নিয়েও এত ঝামেলা!
আমি আবারও বুঝাই,
ঝামেলা কিসের! স্বপ্নটাকে যারা বাস্তবে মিলিয়ে নিতে চায়, এ জন্যে তাদের একটু কষ্ট করতে হয়, চেষ্টা করতে হয়, এই আর কী! আর বাস্তবে মেলাতে না চাইলে তো অসুবিধাই নেই। ঘুমের ঘোরে এসে আবার ঘুমের ঘোরেই স্বপ্ন শেষ। এবার তুমিই বলো তো তিতলি বুড়ি, কোন স্বপ্নটা তুমি চাও?
তিতলির ভীষণ আপত্তি, কিছুতেই সে বুড়ি হবে না। অথচ এই মুহুর্তে নির্বিবাদে এই নামের আদুরে ডাক সে মেনে নেয় এবং আমার কোলের মধ্যে গুটিয়ে এসে দ্বিধাহীন কণ্ঠে ঘোষণা করে,
আমি ওই বাস্তবের স্বপ্নটাই চাই ভাইয়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪২ ঘণ্টা, আগস্ট ০৭, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি[email protected]