ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

আমাদের ঈদ

সুমি খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০১৩
আমাদের ঈদ

১৯৭১ সাল।   চট্টগ্রামের পশ্চিম পটিয়ার বরউঠান গ্রামের জমিদার এবং গভর্নমেন্ট প্লীডার মৌলভী ফজলুর রহমান খাঁর মসজিদ ও স্কুলের মাঠে ঈদের নামাজ শুরু হয়েছে।

মসজিদ পুকুরের  সিঁড়িতে  দুই শিশুকে গোসল করাচ্ছেন এক বিপ্লবী!

এক বছর ও তিন বছর বয়সী দুই শিশুকে গোসল করাতে গিয়ে বিপ্লবী বারবার বলে যাচ্ছেন-“ আহা! একটু তাড়াতাড়ি করো! আমি তো ঈদের নামাজটা মিস্ করলাম মনে হয় আজ!”

এই বিপ্লবী  এবং মুক্তিযোদ্ধার নাম কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো। পটিয়ার কেলিশহর জমিদার পরিবারের সন্তান তিনি । ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি–ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা দলের অন্যতম সংগঠক সাইফুদ্দিন খানের  সূত্রে  তার বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এবং এর আগে আশ্রয় নিয়েছিলেন অনেক পরিবার।

একটা চিরকুটে স্বাক্ষর করে নাকি আব্বু  ( সাইফুদ্দিন খান) অনেককে পাঠিয়ে দিতেন তার বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার জন্যে। এমন দুর্যোগের মাঝেও  কনিষ্ঠ সন্তানের এমন ‘অন্যায় আব্দার’ এর ঝড় –অবলীলায় মেনে নিতেন তার বাবা মৌলভী ফজলুর রহমান খাঁ এবং বাড়ির অন্যরা।  

সাইফুদ্দিন খানকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আলবদর রাজাকার বাহিনী। বাবার খোঁজে বাড়িতে রেইড দিয়ে গেছে পাকি সেনারা- “ কালাইয়া কাঁহা হ্যায়?” বাড়ির তরুণদের এলোপাতাড়ি পিটিয়ে গেছে। সিন্দুক লুট করে বাড়ির বৌ-ঝি দের হীরে আর সোনার গয়না লুট করে নিয়ে গেছে । পরে কিছু গয়না নাকি ফিরিয়েও দিয়ে গেছে শুনেছি।  
আমার দাদু মৌলভী ফজলুর রহমান খাঁ  কোলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজের  আইন বিভাগের ছাত্র । দাদুমণি গ্রামে হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, কালভার্ট, রাস্তাঘাট অনেক কিছুই করেছেন। শর্ত ছিল- কখনো যেন তার নামে কিছু করা না হয়।

তার বাবার নামে তিনি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাকে আমি দেখিনি। তবু বাবার কাছে শুনে জেনেছি কিছুটা। তার দীক্ষায় আমাদের শৈশব কেটেছে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে। একাত্তরে সবাই মিলে অসাম্প্রদায়িক ঈদ উদযাপন করেছেন-এমন ই স্মৃতিচারণ করতেন আমার বাবা-মা। দাদুমণি মৌলভী ফজলুর রহমান খাঁ সে বছরই মারা যান।

আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট নেতা কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগোকে ‘সেলিম ভাই’ নামে চেনে তখন সবাই। যে শিশুদের তিনি গোসল করাচ্ছিলেন, তাদের মধ্যে ছোট জন আমি। অনেক বড়ো হয়ে জেনেছি, আমার জীবনের আদর্শ -আমার সবচেয়ে প্রিয় সেলিম চাচ্চুর আসল  নাম পূর্ণেন্দু কানুনগো।  

ঈদের দিন সবার মাঝে চাচ্চু নিজের পরিচয় আড়াল করার জন্যে  আমাকে আর ভাইয়াকে খুব ধীরে সুস্থে গোসল করাচ্ছিলেন আর তাড়া দিয়ে বলছিলেন, তার নামাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে! আব্বু-  আম্মু খুব মজা পাচ্ছিলেন এসব দেখে! গ্রামের লোকজনও অনেক পরে জেনেছে চাচ্চুর আসল পরিচয়!

শৈশবের স্মৃতিতে মনে পড়ে, আমাদের বিশাল বাড়িতে সাত গ্রামের  হিন্দু-মুসলিম- জেলেপাড়া সব ধরনের মানুষ আসতো । ঘরের গরুর দুধে তৈরি  সেমাই , গুরাপিঠা আরো নানান নাশতা দিয়ে বড়ো জে-আম্মা, মেজ আম্মা, আম্মু  অক্লান্ত আতিথেয়তা করছেন।

কতো মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছেন ঢেঁকি ঘর, রান্নাঘর, দেউড়ি ঘর, পূবের ঘর- সবখানে বড়ো আপা, বড়ো ভাইয়ারা আড্ডা দিচ্ছেন- কী মধুর সব স্মৃতি!

আমাদের বাপ্পু  ডা. কামাল এ খান ছিলেন ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক সংগঠক –এক অসাধারণ মানবতাবাদী! চট্টগ্রাম  বন্দর এর প্রধান চিকিৎসক হিসেবে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে বিশাল বাংলো ছিল তার । ঈদের চার/পাঁচ দিন আগে সেখান থেকে চার সাম্পানে করে  আমরা বাড়ি যেতাম।

আমাদের পারিবারিক মাঝি ছিল। মতলব মাঝি ছিল তাদের প্রধান।   দাদুমণির পর বাপ্পুর প্রখর ব্যক্তিত্ব আর  অসাধারণ নেতৃত্ব পুরো পরিবারকে অসাম্প্রদায়িক রাখতে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছিলো।   আর ছোট ভাই হিসেবে আব্বু নিজের মতো করে নিভৃতে কাজ করে যেতেন গ্রামের সাধারণ মানুষের মাঝে।

আরেকটি স্মৃতি খুব মনে পড়ে।   চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটা অন্নদাচরণ দত্ত লেনে আমাদের তিন/চার পুরুষের ভিটে। যার অনেকটাই দখল হয়ে গেছে।   ১৯৭৬ সালে বাবা আর মা তাদের ব্যাংকের চাকরির  বেতন থেকে হোমলোন কেটে  খুব সাধারণ একটি বাড়ি করেন এই জায়গায়। নিতান্ত  মাথা গোঁজার ঠাঁই যাকে বলে।  

এই বাড়ির চিলেকোঠায় একটা ছোট্ট রুম করে বাবা বলেছিলেন, এই ঘরটি চিরজীবন আন্ডারগ্রাউন্ড বাম নেতাদের জন্যে। ১৯৭৫  সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত  ভাষা সৈনিক মওলানা  আহমেদুর রহমান আজমী ছিলেন এই ঘরটিতে।

আজমী চাচ্চু খেতেন আমাদের সঙ্গে, ঘুমাতেন এই চিলেকোঠায়।

১৯৮৩  সালের দিকে সেই বাড়িটির গ্রাউন্ডফ্লোর ভাড়া নেন ‘যুগান্তর’কর্মী  ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী সীতানাথ দাস এর পুত্র স্কুল শিক্ষক রঞ্জন রশ্মি দাস। আমাদের অনেক শ্রদ্ধার অনেক প্রিয় ‘দাদা’। তার স্ত্রী সুচন্দা দাস দোলা- আমাদের চিরদিনের  ভীষণ প্রিয় ‘দিদি’  চট্টগ্রাম বন্দরে চাকরি করতেন। তার প্রথম সন্তান টুম্পা তখন আড়াই বছরের ফুটফুটে এক মেয়ে। ১৯৮৪ সালে এ ঘরেই জন্ম নিলো দাদা এবং  দিদির একমাত্র পুত্র জনি। আমাদের সবকিছুতে তাদের সম্পৃক্ততা আর অংশগ্রহণ অনিবার্য।

আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি।   কেন যেন সেবার আমাদের বাড়ি যাওয়া হয় নি। আব্বুর গ্যাস্ট্রোলজি প্রবলেমের কারণে বড়ো রকমের অপারেশন হয়েছিলো সেবার । তাই মনে হয় যেতে পারি নি আমরা বাড়িতে।

যে কারণে এতোগুলো বিষয়ের অবতারণা-   ১৯৮৪ সালের ঈদের দিন দিদি আমাকে, আমার ছোটভাই অমিকে আর ভাইয়াকে ডাকলেন। ঈদের দিনের সেই  সকালে কপালে লাল সিঁদুরের বড় ফোঁটা, পাটভাঙ্গা শাড়ি পরা সদ্যস্নাতা  সুন্দর  দিদিকে কী যে স্নিগ্ধ আর সুন্দর লাগছিলো দেখতে!

আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই  দিদি কিছু টাকা গুঁজে দিলেন  আমাদের হাতে! কতো টাকা সেটা মনে নেই। শুধু  মনে আছে এই টাকা বা ‘বখশিশ’ এর মধ্যে  কী পরম ভালোবাসা আর আন্তরিকতা ছিল দিদির! প্রশ্ন আসে মনে –কেন দিদি প্রতি বছর ঈদে আমাদের ‘বখশিশ’ দিতেন?  

খুব সামান্য চাকরি করতেন। দাদা-দিদির টানাটানির সংসারে আমরা তিন ভাই-বোন কে? কেন দিদি প্রত্যেক বছর ঈদের বখশিশ দিতেন? দিদির চেহারায় একটা অসহায়ত্ব ছিল- লুকিয়ে টাকাটা দিয়ে যেন তার অতৃপ্তি রয়ে গেছে- যতোটা চাইছেন যেন পারেন নি!

আমার অনেক স্মৃতি দিদির  প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধের সঙ্গে!  অন্নদাচরণ দত্ত ছিলেন মাস্টার’দা সূর্যসেনের আইনজীবী। তার বাড়িটি দখল হয়ে নিশ্চিহ্ণ এখন। তার নামে করা রাস্তাটি এখন কাগজেপত্রে এ সি দত্ত লেন- সেই নাম ও  মানুষের মুখে বিলীন। আদালত ভবন, কোতোয়ালী থানা,  সিএমপি হেড কোয়ার্টার, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, লালদীঘির সঙ্গে সংযুক্ত  গুরুত্বপূর্ণ  এই রাস্তা  চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে বড়ো সুইপার কলোনির নামে পরিচিত হয়েছে গত ২৫ বছর । কী দুর্ভাগ্য আমাদের!

সেই রাস্তাটি  দিয়ে হাঁটলেই দিদির কথা মনে পড়ে। আমাদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্কে সম্পৃক্ত দিদি হঠাৎ কবে যেন মারা গেছেন। আমরা জানতেও পারি নি। টুম্পা আর জনির বিয়েতে নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে গেছি । আর দিদির শূন্যতা অনুভব করে নিজের অজান্তেই বারবার চোখ ভরে গেছে জলে।

আরেকটা ঘটনা মনে পড়ছে। ১৯৮৪ সালে আব্বু  চট্টগ্রাম মেডিকেলে অপারেশনের জন্য ভর্তি। কমরেড অনঙ্গ সেন আব্বুকে দেখতে গেছেন প্রতিদিনের মতো। আব্বুর পাশের বেডের বয়স্ক রোগী অনঙ্গ চাচ্চুর সঙ্গে খুব আড্ডা জমালেন। কারণ- লম্বা, সাদা দাড়ি নিয়ে চাচ্চু দেখতে ছিলেন  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো।

চাচ্চু তো আরবী ভাষা, হাদিস কোরান সবই জানতেন। আড্ডা বেশ জমে গেলো। আব্বু খুব মজা পেলো- যখন  মাগরেবের  আজান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনঙ্গ চাচ্চুকে পানি আর ইফতার সাধলেন সেই রোগী। চাচ্চু বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে অচেনা নিরীহ মানুষটির অনুরোধ রক্ষা করলেন।

এই তো আমাদের সমাজ! এই তো আমাদের সাধারণ মানুষ!  ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে ভালোবাসা আর আন্তরিকতা যেখানে সবার আগে!! জয় হোক মানবতার! জয় হোক ভালোবাসার!

সুমি খান: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ২১২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ০৭, ২০১৩
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।