খরগোশের মন খারাপ হয়েছে। হবে না কেন? সে তো আর বিড়ালের মতো দুষ্টু না।
বাড়ির গিন্নি মানুষ ভালো হলেও বাছবিচার করেন কম। টেবিলের গ্লাস ভাঙা দেখেই তার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। টেবিলের কোনায় বসা খরগোশ তখনও আরাম করে পাতাকপির ডাঁটা চিবুচ্ছিল। শব্দ শুনে শুধু বিড়ালের লেজটা দেখতে পেল সে।
আর কিছু দেখার আগেই গিন্নিমার লাঠির বাড়ি এসে পড়ল মাথায়। কপির স্বাদ নেয়া তো দূরের কথা, জান বাঁচানোই দায় হলো। সে-তো কবুতরের মতো উড়তে পারে না। উপায় না দেখে শেষে গিন্নিমার কোলেই ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ততক্ষণে খরগোশের গাল কেটে ঠোঁটের কোণায় রক্ত জমেছে। তারই এক ফোঁটা হাতে পড়তেই গিন্নিমা আবার বাড়ি মাথায় তুলল, ওরে, কে কোথায় আছিস, ডাক্তার ডাক। আমার টুসিমণিকে কে কামড়েছে, দেখে যা! শয়তান পুষিটা গেল কোথায়? এ নিশ্চয় তারই কাজ!
সন্ধ্যার আগেই অবশ্য রাগ-ব্যথা দুটোই দূর হয়ে গেল খরগোশের। পুষিটা এসে তার কাছে মাফ চেয়েছে। মাঝে মাঝে খরগোশ অবাক হয়ে ভাবে, ওই ছোট্ট পুষিটার কী দুঃসাহস! সুযোগ পেলেই থাবা দেখিয়ে বলে, একটু বড় হই, মজা দেখাবো তোমাদের।
খরগোশ আর কবুতর খুবই অবাক হয় তার কান্ড দেখে। নিজেরা বলাবলি করে, পুষি কখনো ভালো হবে না।
কবুতর দুঃখ করে বলে, যদি তোমারও দুটো পাখা থাকত, বিড়ালটা এত জ্বালাতে পারত না।
‘না-না, আমার পাখার দরকার নেই। আমার তুলতুলে লোমই ভালো। তুমি যখন আকাশে ওড়ো- আমি ভয়ে কাঁপতে থাকি : এই বুঝি পড়ে যাও। কী ব্যথাই না পাবে তাহলে!’ ভয় পেয়ে বলে খরগোশ।
কবুতর সশব্দে হেসে ওঠে। মনে মনে খরগোশের জন্য একটু মায়াও হয় তার। বেচারা এত সরল! ঠোঁট দিয়ে সে খরগোশের মাথাটা চুলকে দিয়ে বলে, তবু সাবধানে থেকো তুমি। পুষির বাচ্চাকে তো বিশ্বাস নেই-ই; গিন্নি মাকেও নেই। রাগ যার যত বেশি, বুক তার তত কঠিন।
খরগোশও মানে সে কথা। তবু গিন্নিমাকে সে খুব ভালবাসে। তার মত দয়ালু মানুষ কমই হয়। নিজের দুধের গ্লাস থেকে অর্ধেক সামনে ঢেলে দিয়ে বলবেন, খা। খেয়ে খেয়ে আরেকটু বড় হ। তোকে কোলে নিয়ে যেন বুকটা জুড়িয়ে যায় আমার। তাড়াতাড়ি বড় হ তো, কুটকুটি বুড়ি।
এসব আদরে খরগোশ একেবারে গলে যায়। আর এতেই পুষির বাচ্চার যত হিংসে। সুযোগ পেলেই বলবে, দ্যাখ খরগোশ, আমার গায়েও তোর মত পশম আছে। আমার লেজ তোর লেজের চেয়েও বেশি সুন্দর। তাও গিন্নিমা তোকে কোলে নিয়েই ঘুরবে। আমি তা হতে দেব না। তোকে কিছু করতে না পারলে গিন্নি মায়েরই পা কামড়ে দেব আমি।
জানালার উপর থেকে কবুতর বলে, সে আর বলতে। তুই যে কত শয়তান, তা আমরা জানি। গিন্নি মা’র পা কেন, হাতও কামড়াতে পারবি তুই।
তাই করব। তাতে তোর কি?
না, আমার কিছু না। আমি অপেক্ষা করছি ডানা দিয়ে কবে তোর চোখে ঝাপটা দেব, যেন তুই কানা হয়ে যাস। তাতে যদি তোর শয়তানি বুদ্ধি থামে।
গর গর করে পুষির বাচ্চা সরে যায়। কারণ, গিন্নিমা আর কাজের মেয়েটা ঘর পরিষ্কার করতে এসেছেন।
পুষির বাচ্চা সময় থাকতেই কেটে পড়তে চায়। কি জানি, গিন্নি মা যদি কোনভাবে তাকে ধরে ফেলেন, তাহলেই হয়েছে! এর আগে একবার কাজের মেয়েটাকে আঁচড়ে দিয়েছিল সে। তারপর যা ঘটল, মনে পড়লে সে ভয়ে কুঁকড়ে যায়। বিশাল এক ডাক্তার এসে বিরাট এক সুই ঢুকিয়ে দিল তার উরুতে। অমন কষ্ট বোধহয় কেউ মরলেও পায় না।
থাক বাবা, তার চেয়ে সরে-সরে থাকি।
কবুতর মিষ্টি হেসে বলল খরগোশকে, দেখলে তো, বন্ধু। শয়তানটা আগেই কেটে পড়ল। তুমি যদি গিন্নি মাকে বলে দাও, সেই ভয়ে।
আমি কিভাবে বলব, বলো? আমার কথা কি তিনি বোঝেন? আর বুঝলেই বা কি হতো? রাগ হলে তো তিনি পাগল হয়ে যান। তার অবস্থা হয় প্যাঁচার মত, চোখ পিট পিট করে ঠিকই, কিন্তু কিচ্ছু দেখতে পায় না।
আর সূর্যি মামা কেঁদে মরেন।
হো হো করে হাসে দুই বন্ধু।
পরদিন সকালে ভাঙলো আরেকটি গ্লাস। গিন্নি মা তখন বই পড়ছিলেন চোখে চশমা দিয়ে। তার চশমাটা খুবই সুন্দর। কিন্তু তার ভেতর দিয়ে তিনি কিছু দেখতে পান বলে মনে হয় না। তার কোলের মধ্যেই বসে ছিল খরগোশ। তাই তাকে দুষতে না পারলেও তিনি চিৎকার করে উঠলেন, কে? কে ভাঙলো গ্লাসটা? এই সিঁড়ি, তুই ভাঙলি?
কাজের মেয়েটা কেবল বাসনগুলো নিয়ে যাচ্ছিলো। ঝামটা মেরে বলল, আপনি কানা নাকি, মা? দেখছেন না আমার দুহাত থালা-বাসনে ভরা? আমি কি করে ভাঙবো?
তাহলে কে ভাঙলো?
কে আবার, আপনার পুষি। সাথে একটা মুরগীর ডানাও গেছে।
কী? কী বললি? মুরগীর ডানা? রানটা তো রেখেছি তোতনের জন্য। স্কুল থেকে ফিরেই খাবে। আর হাড্ডিটা দেব ডগিটাকে।
থাক, আর দিতে হবে না। সিঁড়ি গটগট করে হেঁটে গেল ভেতরে।
খরগোশ ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে গিন্নি মায়ের দিকে। তার চোখ লাল হয়ে উঠছে। সে সরে যেতে চায়, বড্ড ভয় পেয়েছে। কিন্তু গিন্নি মায়ের হাত তাকে আঁকড়ে ধরেছে। হায়-হায়, তার বুঝি শ্বাসই আটকে যায়।
দেয়াল থেকে সবই দেখছিল কবুতর। খরগোশের করুণ দশা দেখে ঘরের মধ্যেই দুটো চক্কও দেয় সে।
গিন্নি মা ঘরের মধ্যে কবুতর ওড়া পছন্দ করেন না। ঝট করে নেমে টেবিল থেকে লাঠিটা তুলে মারার চেষ্টা করেন বাকুমকে।
কিন্তু কবুতরের সাথে তিনি কী করে পারবেন? যুদ্ধ-জাহাজের মত ঘুরে পাশ কাটায় কবুতর। খরগোশও এক লাফে খাঁচায় ঢুকে পড়ে।
‘কই, পুষি কই? কই গেল শয়তানটা? ওকে আজ মেরেই ফেলব আমি। ’- গিন্নি মা ঘরময় লাঠি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন আর পুষির বাচ্চা টেবিল থেকে চেয়ার, চেয়ার থেকে খাটে লাফিয়ে বেড়ায়। একসময় লাঠির বাড়িতে গিন্নি-মায়ের নিজের চশমা-ই ভেঙে খান-খান হয়ে যায়।
‘ও-মা, একি হলো আমার!’- গিন্নি-মা’র গগনবিদারী চিৎকারে সবাই এসে জড়ো হয়।
ততক্ষণে তোতনও স্কুল থেকে ফিরে এসেছে। এ বাড়ির সবচে’ লক্ষ্মী ছেলে সে। মায়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে, কেঁদো না, মা। একটা চশমাই তো ভেঙেছে মাত্র। বাবা বানিয়ে আনবেন। এবার থামো তো তুমি।
না, থামব না। আগে তুই পুষির বাচ্চাটাকে ধরে আন। ওকে দু’ঘা না লাগালে আমার শান্তি হবে না।
কেন, কি করেছে পুষি?
সে আমি পরে বলছি। আগে তো ওকে দু’ঘা লাগাই।
আচ্ছা, দাঁড়াও। ওকে আনছি।
পুষির বাচ্চার মালিক তোতনই। বাড়ির কারো বিড়াল পছন্দ না হলেও, তোতনের খুব পছন্দ। ‘কই গেলি, পুষি? বেরিয়ে আয়। ’ চিৎকার করতে করতে সে সব ঘরে ছুটে বেড়াল।
পুষি লুকিয়ে ছিল এ-ঘরেরই খাটের নিচে। টর্চের আলো পড়তেই তার চোখ জ্বলে উঠল। আদুরে গলায় তোতন বলল, পাজি, আমাকেও ভয় দেখাস? আয় এদিকে, মা তোকে বকবেন, আর মারবেনও।
তোতনের কথার ভঙ্গিতে খরগোশ আর কবুতর ঠোঁট টিপে হাসে। এই না হলে মালিক! শয়তানটার ভাগ্য ভালো।
বিড়ালটাকে হাতে নিয়ে গিন্নি মায়ের সামনে যায় তোতন। ‘এই যে মা, এনেছি বদমাশটাকে। আস্তে মারবে। এখনও ছোট তো!’
ছোট্ট দুটো পিটুনি খাওয়ার পর ছাড়া পায় পুষি।
শুধু কবুতরই দেখতে পায়, দুটো পিটুনিই তোতন নিজে দিয়ে বিড়ালটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে!
খরগোশও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল, হায় রে! এত ভাল মানুষের কী বদমাশ বান্ধবী!
বাংলাদেশ সময়: ২১০৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১৩
এমএনএন/এএ/এমজেডআর[email protected]