তুমি কী কখনো রাতের আকাশে ঝাড়ুর মতো দেখতে কিছু ছুটে যেতে দেখেছো? যদি দেখে থাকো এবং না জেনে থাকো জিনিসটা কী, তবে জেনে নাও, সেই জিনিসটার নাম হচ্ছে ধূমকেতু। রাতের আকাশে আলোর ঝাড়ু হয়ে দেখা দেয় ধূমকেতু, ছুটে যায় এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
আচ্ছা, তুমি কী জানো ধূমকেতু কী? ধূমকেতু হচ্ছে ধুলো, বরফ এবং গ্যাস দিয়ে তৈরি এক ধরনের মহাজাগতিক বস্তু। ইংরেজিতে একে বলা হয় Comet.
ধূমকেতু দেখতে আকর্ষণীয় লাগে মূলত এর কমা এবং লেজের কারণে। কমা হচ্ছে পাতলা ও ক্ষণস্থায়ী বায়ুমণ্ডল। ধূমকেতুর নিউক্লিয়াস থাকে যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথর, বরফ এবং ধুলার সংকলনে তৈরি। নিউক্লিয়াসের উপর সৌরবায়ুর প্রভাব ও সূর্যের বিকিরণের কারণে সূর্যের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় একটি ধূমকেতু সুন্দর কমা এবং কখনো লেজ প্রদর্শন করে।
আমরা কখন ধূমকেতু দেখি জানো? ধূমকেতু যখন সৌরজগতের ভেতরে এগিয়ে আসে তখন সূর্যের বিকিরণের কারণে এর ভেতরের উদ্বায়ী পদার্থগুলো গ্যাস এবং ধুলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে যার ফলে তৈরি হয় কমা। আর কমার উপর সৌরবায়ুর প্রভাব ও সূর্যের বিকিরণ যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয় লেজ। কমা ও লেজে যেসব উপাদান থাকে সেগুলো আসলে নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে আসা অতিক্ষুদ্র উপাদান।
এগুলো সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা খুব অল্প উজ্জ্বল হয়। সেজন্য টেলিস্কোপ ছাড়া ধূমকেতু দেখা যায় না। তবে কমা ও লেজের এসব উপাদান অত্যুজ্জ্বল হলে খালি চোখেই আমরা ধূমকেতু দেখতে পাই। লেজের কারণে খালি চোখে ধূমকেতুকে দেখতে লাগে অনেকটা ঝাড়ুর মতো।
একটি ধূমকেতুর পর্যায়কাল কয়েক বছরও হতে পারে, আবার কয়েকশ বছর, এমনকী কয়েক লক্ষ বছরও হতে পারে। যেসব ধূমকেতুর পর্যায়কাল ২০০ বছরের চেয়ে কম, তাদের স্বল্পকালীন ধূমকেতু বলে। এ ধরনের ধূমকেতুর মধ্যে খুব পরিচিত একটি হচ্ছে হ্যালির ধূমকেতু। এই ধূমকেতুটি প্রতি ৭৬ বছরে একবার করে দেখা যায়। আর ২০০ বছরের বেশি সময় যেসব ধূমকেতুর পর্যায়কাল, তাদেরকে দীর্ঘকালীন ধূমকেতু বলে।
ধূমকেতুর উৎপত্তি কীভাবে হয় জানো? ধূমকেতুর উৎপত্তি হয় দু’ভাবে। স্বল্পকালীন ধূমকেতুর উৎপত্তি হয় নেপচুন গ্রহের কক্ষপথের বাইরে অবস্থিত কুইপার বেল্ট থেকে এবং দীর্ঘকালীন ধূমকেতুর উৎপত্তি হয় সৌরজগতের বাইরের বরফময় বস্তুর গোলাকার মেঘ ওরট থেকে- এমনটাই ধারণা করা হয়।
আমরা সবাই জানি সব বস্তুর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আছে। স্বাভাবিকভাবেই সব গ্রহগুলোরই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আছে। সৌরজগতের বড় বড় গ্রহগুলোর মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে ধূমকেতু সৌরজগৎ ছেড়ে চলে যেতে পারে। আবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে করতে ধূমকেতুর ভেতরের উদ্বায়ী পদার্থ পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধূমকেতু ভেঙে একাধিক খণ্ডে পরিণত হয়। কোনো কোনো ধূমকেতু কোনো গ্রহের সাথে সংঘর্ষের ফলে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ধারণা করা হয় পৃথিবীতেও ধূমকেতুর পতন হয়েছিল এবং ধূমকেতুর পতনের ফলেই ডাইনোসর ধ্বংস হয়েছিল। আবার অনেকেই ধারণা করেন যে পৃথিবী সৃষ্টির পর এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি এসেছিল ধূমকেতুর পতনের ফলে।
এতক্ষণ জানলে ধূমকেতু নিয়ে বিজ্ঞানের নানা কথা, নানা বিশ্লেষণ। ধূমকেতু কিন্তু বারবার ফিরে এসেছে আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতিতে। কবি-সাহিত্যিকরা বারংবার ধূমকেতুকে সাধারণের কাছে নিয়ে এসেছেন তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে। চিত্রশিল্পীরাও কাজ করেছেন ধূমকেতু নিয়ে।
আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের লেখায়ও উঠে এসেছে ধূমকেতুর কথা। নজরুল শুধু ধূমকেতু নিয়ে লেখেন নি, ‘ধূমকেতু’ নামে পত্রিকাও প্রকাশ করেছেন। লিও টলস্টয় ১৯১১ সালের বিশাল ধূমকেতুর কথা লিখেছেন তার একটি বইয়ে।
আবার ধূমকেতু নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণীও করা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো মিলেও গেছে। মার্ক টোয়েন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে ধূমকেতুর সাথে সাথে তিনি চলে যাবেন, এবং সত্যিই তার ভবিষদ্বাণী ফলে গিয়েছিল।
ধূমকেতু নিয়ে কুসংস্কারও কম নেই। প্রাচীনকালে ধূমকেতুকে দেখা হতো দুর্ভাগ্যের প্রতীক ও অশুভ সংকেত হিসেবে। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ধূমকেতুকে মনে করা হয় ধ্বংসের প্রতীক ও দুর্যোগের আগমনী বার্তা। হ্যালির ধূমকেতুর আবিষ্কর্তা এডমান্ড হ্যালির শৈশবে লন্ডনের আকাশে একটি ধূমকেতু দেখা যায় যাকে লন্ডনের অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়েছিল।
তুমি যদি রাতের আকাশে হঠাৎ দেখা পেয়ে যাও উজ্জ্বল ধূমকেতুর, তবে কিন্তু কুসংস্কার মেনে একে অনাসৃষ্টি মনে করে আঁতকে উঠো না, এটি আসলে অত্যন্ত সুন্দর একটি মহাজাগতিক বস্তু। তাই দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে বরং উপভোগ কোরো এই অসাধারণ সৃষ্টির অপূর্ব সৌন্দর্য।
ইচ্ছেঘুড়িতে লেখা পাঠান এই মেইলে: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৩
এমএনএনকে/এএ/এমজেডআর