ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

স্বপ্নের পিঞ্জিরা ও পাখির ছানা

শাহজাহান মোহাম্মদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৪
স্বপ্নের পিঞ্জিরা ও পাখির ছানা

আমি তখন ৭ম শ্রেণির ছাত্র। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে বেলা বারোটায়।

বই খাতা বগলে নিয়ে সোজা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরা। স্কুল থেকে বাড়ির দূরত্ব আধা মাইল। তাই আসতে বেশি সময় লাগে না। কোনোরকম বই খাতা টেবিলে ফেলে দিলাম ছুট।

বাড়ির পিছনে বন-জঙ্গলে ভরা। বড় বাঁশ বাগান, বড় বড় আম গাছ, আতা গাছ, সঙ্গে সোনালু গাছও। যে গাছে থোকায় থোকায় হলদে ফুল কানের ঝুমকার মতো ঝুলতে থাকে। আরও নানা রকমের গাছ আছে। তবে আমপাতা গাছে শালিক (পুইশারো) পাখির বাসা। মোটা গাছের মাঝখানে গর্তে বাসা। আমি এক দৌঁড়ে পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে আমপাতা গাছের দিকে পাখির বাসায় নজর দিলাম। দেখি স্ত্রী পাখিটি মাথা বের করে বসে আছে। আর পুরুষ পাখিটি অন্য পাশের গাছের ডালে বসে ঠোঁট দিয়ে গা চুলকাচ্ছে।

আমি তখন চিন্তা করতে থাকি, কী করে গর্তে থাকা পাখিটা ধরা যায়। আমার নিজ হাতে তৈরি পিঞ্জিরার মধ্যে রাখা যায়। বনে বনে ঘোরা ও পাখি ধরার বেশ নেশা ছিল আমার। কত যে মায়ের হাতে মার খেয়েছি এই পাখি ধরার জন্য!

আমি একপা দুইপা করে চুপি চুপি মাথা নিচু করে গাছের নিচে যেতে থাকি। এক সময় দেখি, বাইরে ডালে বসা পাখিটি উড়ে চলে গেল। আমি আস্তে আস্তে করে গাছের গোড়ার দিকে গিয়ে উঠতে শুরু করলাম। ঠিক যখন গর্তের কাছে গেলাম, তখন ফুরুৎ করে বাসার পাখিটি বেরিয়ে উড়ে গেল। মনটা গেল খারাপ হয়ে। বুঝতে পারলাম না! কোনো শব্দ করলাম না। পাখিটি উড়ে গিয়ে পাশের গাছে ডালে বসলো। আমি পাখিটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। দেখি পাখিটির চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। মনে মনে ভাবলাম, আজও পাখি ধরা হলো না। তবুও মনে মনে পণ করলাম পাখিটি ধরা চাই।

আমি গাছ থেকে না নেমে কোনোরকম ভয় না করে গর্তের ভিতরে হাত ঢুকানোর চেষ্টা করলাম। প্রথমে একটু কষ্ট হলেও পরে হাত ছেঁচড়ে ঢুকালাম। দেখি গরম ভাপ। আরও ভিতরে প্রবশ করালাম। হাতে নাগালে দেখি চারটি ডিম। ঠিক কোয়েল পাখির ডিমের মতো। গায়ে ছোট ফোঁটা ফোঁটা চিহ্ন। ডিম দেখে অনেক খুশি হলাম। ভাবলাম, মা ও পাখির বাচ্চাসহ সবাইকে ধরা যাবে।

দাদী আমাকে প্রায়ই বলতো, দাদা পাখি ধরতে হয় না। বাসা ভাঙতে হয় না। ওরা অভিশাপ দেয়। কে শোনে কার কথা। আমি যথা নিয়মে প্রতিদিন নজরদারি করি পাখির বাসার দিকে। দেখতে দেখতে প্রায় সপ্তাহ দু’তিন হয়ে গেল। একদিন দেখি, পাখির বাচ্চা ফুটে গেছে। মা ও বাবা দু’জনেই খাবার আনছে আর বাচ্চাগুলো খাওয়াচ্ছে। আমি মনে মনে নিজকে বুঝাতে থাকি যে, কবে পাখির বাচ্চাগুলো একটু বড় হবে। আমি ধরে আমার স্বপ্নের তৈরি পিঞ্জিরায় রাখব। পুষে বড় করব। আমার কথা শুনবে। কথা বলবে। এই আশায় নাওয়া খাওয়া ছেড়ে শুরু হলো পাখি ধরা অভিযান।

বাচ্চাগুলো একটু বড় হয়ে গেছে। আমি গাছে উঠে বাচ্চাগুলোকে ধরে বের করলাম। দেখি দুটি বাচ্চা ফুটেছে। আর দুটি ডিম হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে। মা ও বাবা আমার মাথার ওপরে চেঁচামেচি শুরু করে দিল। এগাছ ওগাছের ডালে উড়ে বসে প্রাণপণে চিৎকার করছে। বাচ্চাগুলোকে ধরে আমার স্বপ্নের খাঁচায় ঢুকালাম। বাসায় নিয়ে গেলাম। সেই রাতে আমার ঠিকমতো ঘুম হলো না। শুধু পাখির খাঁচার দিকে মন পড়ে রইল।

এদিকে চিন্তা করতে থাকি, এবার মা পাখিটাকে ধরা যায় কী করে। কয়েকদিন পরে দেখি গাছের গর্তে পাখি মাথা বের করে বসে আছে। এবার চিন্তা করলাম মা বাবা যাকেই হোক ধরতে হবে। কি করা যায়? কীভাবে ধরা যায়? মনে মনে ঠিক করালাম আমার খালাতো ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ধরতে হবে। খালাতো ভাই আমার চেয়ে এক ক্লাস ওপরে পড়ে। ওকে সঙ্গে নিয়ে আসলাম গাছের নিচে। বুদ্ধি বের করলাম। তারপর ঠিক করলাম, একটি বাঁশের মোটা কঞ্চি লম্বায় আট-দশ হাত। একটি ছোট চিকন কঞ্চি গোল করে তার সঙ্গে গাছের বড় বড় পাতা বেঁধে দিলাম। গোল ঢাকনার মতো করে লম্বা লাঠির মাথায় বেঁধে দিলাম। অপেক্ষা করতে থাকলাম পাখি দুটি কখন ঢোকে বাসায়। কিন্তু আজ আর পাখি দুটো বাসায় ঢুকলো না। এদিকে বাচ্চাগুলোকে চালের খুদ, সরিষা খাওয়াতে থাকি। কিন্তু মনে হচ্ছে বাচ্চাগুলো নাজেহাল হয়ে গেছে। সারক্ষণ চেঁচামেচি করছে। আশপাশে মা বাবা দু’জনেই করুণ সুরে ডাকছে।

পরের দিন একই নিয়মে চলে গেলাম খালাতো ভাইসহ গাছের কাছে। দেখি গর্তের ভিতরে মাথা দেখা যাচ্ছে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না পাখি না অন্য কিছুর মাথা। খালাতো ভাই বললো পাখি। ঠিক করলাম আজ আর রক্ষা নাই। ধরা পড়তেই হবে পাখি তোমাকে। খালাতো ভাই সেই ঢাকনাওয়ালা কঞ্চি দিয়ে গর্তের মুখ বন্ধ করে ধরল। আর চিৎকার দিয়ে বলতে থাকলো, তাড়াতাড়ি গাছে ওঠ। দেরি করিস না।

আমি ঝটপট করে দৌঁড়ে গাছের দিকে গিয়ে উঠতে শুরু করলাম। গর্তের কাছাকাছি গিয়ে দেখি পাশের ডালে দুটো পাখিই চেঁচামেচি করছে। তখন থমকে গেলাম! খালাতো ভাইকে বলাম কি-রে... তুই না বললি- পাখি বাসায় বসে আছে। এখন দেখি দুটোই বাইরে। সেও হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকায় আর পাখি দুটোর দিকে তাকায়। এমন সময় হাতের কঞ্চি নড়ে ঢাকনা সরে যায়। গর্তে দেখা যায় একটি সাপ। মাথা বের করে আছে। সাপ সাপ বলে চিৎকার করে খালোতো ভাই। আমি গাছের ডাল জড়িয়ে ধরে বসে আছি। কি করবো বুঝে উঠেতে পারছিলাম না। এদিকে খালাতো ভাই ছুটে দূরে সরে গিয়ে বলে, নাম নাম দেরি করিস না। আমি কি করবো, লাফ দেবো না নেমে পড়বো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে বুকে, হাতের চামড়া ছেঁচড়ে গিয়েছিল সেদিন। এতই ভয়ে পেয়েছিলাম, হয়তো সাপের হাত থেকে আর কোনো দিন রেহাই পাবো না।

সেদিন থেকে শিক্ষা নিয়েছিলাম আর কোনো দিন পাখি ধরবো না। সন্তান হারানোর ব্যথা এখন বুঝি। যেহেতু বাবা হয়েছি। সন্তান চোখের আড়াল হলেই কত কষ্ট লাগে। পরে দাদীর কথা মতো পাখির বাচ্চা দুটোকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। মা পাখি ও বাবা দুজনেই বাচ্চা পেয়ে খুশিতে তাদের মন ভরে ওঠে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।