ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

জ্বীনের থাপ্পড় | মোহাম্মদ সালেক পারভেজ

গল্প / ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৪
জ্বীনের থাপ্পড় | মোহাম্মদ সালেক পারভেজ

দীর্ঘদিন পর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে মূসারা। আসলে দিন নয়, অনেক বৎসর বললে বিশুদ্ধ হবে।

মূসারা বেশ কয়েকজন ভাই। মূসার বড় ভাইরা আসলেও, মূসা এবং তার ছোট ভাই ঈসা— এ দু’জন আগে কখনো গ্রামে আসেনি। সুতরাং আসার আগ থেকেই কৌতূহলে তাদের দম বন্ধ যাবার উপক্রম হয়েছিল। গ্রামে ঢোকার পর যেন তারা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো। মূসাদের গ্রামটি খুব সুন্দর। গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবহমান বিখ্যাত ব্রহ্মপুত্র নদ। যদিও পলি জমে আর  ভূমি দস্যুদের খপ্পরে পড়ে সে এখন শীর্ণকায়, কিন্তু পাড়ে দাঁড়ালে সহজেই উপলব্ধি করা যায় তার অতীত বিশালতা! অথচ এখন? ছোট্ট ছোট্ট ডিঙি নৌকাতে মানুষ এপার-ওপার আসা-যাওয়া করছে, কোথাও কোথাও হেঁটেই পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দাদার কাছে শুনেছে যে একদা এই নদীতে বিশাল আকারের পাল তোলা নৌকা, এমনকি লঞ্চ-জাহাজ পর্যন্ত চলাচল করতো। তাদের বাবা সেদিন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলছিল, বাংলাদেশের নদীগুলোকে মেরে ফেলা হচ্ছে । এত্তো বড় বড় নদীকে আবার মারে কেমন করে! মূসা ঈসা কারোর মাথাতেই ঢোকেনি। তবে তারা অতটা মাথাও ঘামায়নি। প্রায়মৃত ব্রহ্মপুত্র দেখেই তারা আত্মহারা, নদী পাড়ের হাওয়া খেয়ে মাতোয়ারা।

সারাদিন হৈ হুল্লোড় আর খেলাধুলায় শেষ করে সন্ধ্যা হলে বিপদে পরে মূসা আর ঈসা। যদিও বিজলী বাতির ব্যবস্থা আছে, কিন্তু এখানে সেখানে নানা জাতের পোকার ডাক, বড় বড় গাছের নিচে আলো আঁধারের খেলা; এ যেন এক ভৌতিক পরিবেশ। রীতিমত গা ছম ছম করে। সবাই অবশ্য সাহস যোগায়, এখন ভূত-তুট কিচ্ছু নেই। যখন বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা ছিল না, তখন ছিল। বাতির ভয়ে জীন-ভূত পালিয়ে গেছে। বিদ্যুৎ আসার আগে অনেকেই অনেক জীন-ভূত দেখেছিল।
আব্বু, এই গ্রামের কে কে জ্বীন দেখেছে?— মূসা প্রশ্ন করে।
অনেকেই, যেমন তোমার সইফ্যা দাদু। কিন্তু কেন?— মূসার বাবার পাল্টা প্রশ্ন।
আমাদেরকে সইফ্যা দাদুর কাছে নিয়ে যাও। আমরা তার কাছ থেকে জ্বীন দেখার ঘটনা শুনবো।
ইস। কালকে বললেই তো হতো। সইফ্যা কাকু দেখা করতে এসেছিল। কাচারি ঘরে বসিয়ে দিলে অনেক গল্প শোনা যেত।
সইফ্যা দাদু কোন জন?
ঐ যে, বাম গাল বাঁকা একজন বুড়ো মানুষকে দেখেছিলে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। দেখলেই ভয় লাগে। দু’ভাই সমস্বরে জবাব দেয়।
ভয়ের কিছু নেই। কাকু খুব ভালো মানুষ।
আচ্ছা আব্বু, সইফ্যা আবার কেমন নাম? ঈসার প্রশ্ন।
আসলে কাকার নাম সফীউদ্দিন। কিন্তু গ্রামের মানুষের এক আজব অভ্যাস যে, ডাকার সুবিধার জন্য নামকে ছোট করবে। আর ছোট করতে গিয়ে বিকৃত করে ফেলে।
দু’ভাইয়ের মনে পড়লো যে, সব দাদা দাদীরা তাদের আব্বুকে কি এক অদ্ভুত নামে ডাকছে।
আচ্ছা, আমাদের নামটাও পাল্টে ফেলবে না তো?— উৎকণ্ঠিত স্বরে মূসার প্রশ্ন।
না, না। তোমাদের নাম অনেক ছোট। আর ছোট করা যাবে না।
যাক বাঁচলাম। দুই ভাই হাফ ছাড়ে।

বিকাল বেলা। সইফ্যা দাদুর বাসা। মুসার বাবা এসেছে দু’ভাইকে নিয়ে। দু-এক কথায় উদ্দেশ্য বুঝিয়ে দিয়ে দুই ভাইকে রেখে বাজারে চলে গেলেন। দু-চার মিনিট খোশ-আলাপ শেষে বুড়ো দাদু সইফ্যা বলতে শুরু করলেন তার জ্বীন দেখবার ঘটনা:
ছোটবেলা থেকেই আমি ভীষণ সাহসী। জ্বীন-ভূতের ভয় মোটেই ছিল না। রাতে  একা একা মসজিদে থাকা, অমাবস্যার রাতে একটিমাত্র হ্যারিকেন হাতে কবরস্থানে ঘুরে আসা ইত্যাদি কাজ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতাম। কিন্তু কোনদিন জীন-ভূতের টিকিটিও দেখি নি। গ্রামের মানুষ বলতো, যেখানে সইফ্যা যায়, সেখান থেকে জ্বীন-ভূত পালায়।
তার মানে দাদু! তুমি কোনোদিন জ্বীন-ভূত দেখোনি!— মূসা মনমরা স্বরে মন্তব্য করে।
না রে দাদু। দেখেছি।
সেই ঘটনাটিই বলো না!— আকুল স্বরে ঈসা বলে ওঠে।
বলছি, দাদু। — এ কথা বলে বুড়ো দাদু এক গ্লাস পানি খেলেন। তারপর কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে শুরু করলেন— বহু বছর আগের কথা। গ্রামে তো দূরের কথা, গোটা জেলাতেও তখন বিদ্যুৎ আসেনি। আমার এক জেঠা ছিল। নাম  রহিমুদ্দি, জেঠার কী এক আজব অসুখ হলো। ডাক্তার-বদ্যি বহুত দেখানো হলো সে কারণে। পরিশেষে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো, জ্বীন ডাকা হবে। জ্বীনকে বলা হবে ওষুধের ব্যবস্থা করতে। আগে গ্রাম দেশে এসব করা হতো। সূচীপাড়া গ্রামে এক হুজুর আছে। উনি জ্বীন হাজির করতে পারেন। এ সকল হুজুরদেরকে কবিরাজ বলা হয়। উনাকে ডাকা হলো। ঠিক হলো এশার নামাজের এক ঘণ্টা পরে জ্বীন ডাকা হবে। গ্রাম দেশে এশার এক ঘণ্টা পর সব নীরব হয়ে যায়। এ জন্যই এমন ব্যবস্থা।

অন্ধকার ঘর। ২০-২২টা চেয়ার ৫টা সারিতে রাখা হয়েছে। এগুলো থেকে বেশ দূরে আলাদাভাবে ২টা জিনিস রাখা— একটি সাধারণ চেয়ার, অন্যটি  বেশ বড় আকৃতির একটি টুল। এই চেয়ারটিতে বসেছেন কবিরাজ সাহেব। অন্য চেয়ারগুলোর প্রত্যেকটিতে কেউ না কেউ বসেছে অর্থাৎ কোনো একটি চেয়ারও খালি নেই। খালি কেবল টুলটি। কারণ জীন এসে ওখানে বসবে। আমি হিসাব করে এমন একটি চেয়ারে বসলাম যেখান থেকে উঠে টুল পর্যন্ত যেতে কারো সাথে ধাক্কা না লাগে। দরজা ভালো করে বন্ধ করা হলো যাতে চট করে খোলা না যায়, ভিতর থেকে হোক কিম্বা বাহির থেকে হোক। ঘরে কোনো অতিরিক্ত মানুষ নেই। এই অবস্থায় কুপি নিভিয়ে দেওয়া হলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার! কবিরাজ সবার উদ্দেশ্যে বললেন, কেউ কোনো ধরণের নড়াচড়া কিম্বা শব্দ করবেন না। আমি দোয়া পড়তে থাকবো। জ্বীন আসবে, টুলে বসবে। কথাবার্তা হবে। আপনারা নিজের কানেই শুনবেন।

আমরা সবাই চুপ করে আছি। কবিরাজ মোটামুটি আওয়াজে দোয়া পড়তে লাগলেন। ১০-১২ মিনিটের মতো পার হয়েছে। টিনের চালে প্রচণ্ড আওয়াজ হলো। কিছুটা ন্যাকা স্বরে বলতে শোনা গেল, আসসালামু আলাইকুম! চোখে যদিও কিছুই দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু পরিষ্কার মালুম হলো যে, ঘরের ভেতরে কেউ এসেছে। কবিরাজ সাহেব সালামের উত্তর দিলেন। তারপর কেমন আছেন ইত্যাদি হাল হকিকাত নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। বুঝলাম যে, ধীরে ধীরে মূল বিষয়ে অর্থাৎ যে কারণে জ্বীন ডাকা  হয়েছে সেদিকে যাওয়া হবে। সবাই শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় জীনের কথাবার্তা শুনছে। একটু ন্যাকা ন্যাকা স্বর, আওয়াজটা খস খসে। আমি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম। বিন্দুমাত্র আওয়াজ যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে টুলটির দিকে এগোতে থাকলাম। আগেই আন্দাজ করে নিয়েছিলাম কয় পা লাগতে পারে। অতগুলো পদক্ষেপের পর বুঝতে পারলাম যে টুলটির কাছে এসে গেছি।

এটুকু বলে দাদু হঠাৎ থামলেন। থেমেই রইলেন। দেখছেন দু’ ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া।
তারপর! তারপরে কী হলো?— এক শ্বাসে বলে উঠলো দুই ভাই। উত্তেজনায় ওদের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।
বাকিটুকু না বললে হয় না?— বুড়ো সইফ্যা মিটি মিটি হাসে।
হবে না দাদু। এখনি বলতে হবে। — ঈসা বলে।
না বললে আমি কেঁদে ফেলবো। — কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে ওঠে মূসা।
কাঁদতে হবে না বলছি। — দাদু শুরু করলেন।

আমি দু’হাত বাড়িয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে টুলে বসা জ্বীনটাকে আঁকড়ে ধরলাম। সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে উঠলাম— ‘ধইচ্ছি রে’।
কী মজা! কী মজা!!— দু’ভাই সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো। তাদের হাসি আর বন্ধ হয় না। অনেকক্ষণ পর তারা খেয়াল করলো, দাদু চুপচাপ। সাথে সাথে দু’জনেই থেমে গেল।
দাদু, তাড়াতাড়ি বলো, তারপরে কী হলো? তারপর?
অল্প হেসে দাদু আবার শুরু করলেন:
গালে প্রচণ্ড জোরে এক থাপ্পড় লাগলো। সাথে সাথে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেলাম। আবছাভাবে বুঝতে পারলাম কেউ একজন আমাকে শূন্যে তুলে দূরে নিক্ষেপ করছে। মাথায় শরীরে ভীষণ আঘাত পেলাম। তারপর আর কিচ্ছু মনে নাই। যখন জ্ঞান ফিরলো, দেখি খোলা মাঠে চৌকির উপর শুয়ে আছি। আমার আশেপাশে অনেক মানুষ। মাথা মুখ সব পানিতে ভেজা। বুঝলাম, অনেকক্ষণ ধরে পানি ঢালা হচ্ছিল। কী হয়েছিল জানতে চাওয়াতে সবাই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। বাবা আর জেঠাতো পারলে মারতে আসে, ইচ্ছামত বকা-ঝকা করলো। সবাই একটু শান্ত হলে কবিরাজ সাহেব কাছে এলেন। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে কিন্তু শান্ত স্বরে সব বললেন। আমি জ্বীনকে ধরার সাথে সাথে জ্বীন ক্ষেপে যায়। রাগের চোটে আমাকে থাপ্পড় মারে এবং শূন্যে তুলে এত জোরে মেলা মারে যে ঘরের বেড়া ভেঙে বাইরে এসে পড়ি। কিসমত ভালো যে, জানে মরিনি। জ্বীন কোথায় জানতে চাইলে বললেন, জ্বীন তো আমাকে নিক্ষেপ করেই চলে গেছে। প্রথমে কেউ কিছু বোঝেনি। হঠাৎ করে জীন বিদায় নেয়াতে কুপি জ্বালানো হয়। তাছাড়া ঘরের বাইরে যারা ছিল তারা হুলুস্থুল শুনে বাতি নিয়ে এগিয়ে এসে আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় পায়। ভাগ্য ভালো যে ওখানে খড় বিছানো ছিল। নচেৎ হাত-ঠ্যাং আস্ত থাকতো না। এমন কাজ ভবিষ্যতে যেন আর না করি সে ব্যাপারে সতর্ক করলেন। তিনি চলে গেলেন। আমি তাকিয়ে দেখি, সবাই অদ্ভুত নজরে আমাকে দেখছে। এতক্ষণে আমি ভয় পেলাম। বারংবার জিজ্ঞাসা করার পরে মক্তবের হুজুর, আমার ছোটবেলার ওস্তাদ ভাঙা গলায় বললো, সইফ্যারে, তোর গালটা বোধ হয় জনমের জন্য বাঁকা হয়ে গেল।

দাদু থামলেন। আতঙ্কে উত্তেজনায় দুই ভাইয়ের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। আরো জড়সড় হয়ে বসলো তারা। বারবার সইফ্যা দাদুর বাম গালটা দেখছে। জীনের থাপ্পড়ের বাস্তব চিহ্ন!

এমন সময়ে অনেকগুলো কাটা আম প্লেটে করে নিয়ে  দাদী রুমে ঢুকলেন। বললেন, কোনো ভয় নেই, দাদু ভাইরা! আম খাও। গাছ পাকা আম। বুড়ো সইফ্যা সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, হ্যাঁ ভাই। আম খাও। বুঝলে দাদুরা, এই ঘটনার তিন বৎসর আগে বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। নচেৎ এই গাল বাঁকা সইফ্যারে কেউ বিয়ে করতো না। তোমার দাদী কী আর করবে! এই  গাল বাঁকারে নিয়েই জিন্দেগি পার করলো। অনেক ভালো মানুষ। কী কও তোমরা?

জবাব না দিয়ে দু’ভাই ফিক করে হেসে আম খাওয়াতে মনোযোগ দিলো।



বাংলাদেশ সময়: ১৯৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।