ঢাকা, বুধবার, ৩০ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২ রবিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

রহস্যময় ওয়াংফু দ্বীপে ভয়ঙ্কর দিনগুলো || সৈয়দ আহসান কবীর

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৪
রহস্যময় ওয়াংফু দ্বীপে ভয়ঙ্কর দিনগুলো || সৈয়দ আহসান কবীর

ক্রিকেট বলটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভোম্বলের কৌশল আসলেই অতুলনীয়।

নাদুস নুদুস শরীরে যখন ব্যাটিং পজিশনে থাকে তখন উইকেটটিও দেখা যায় না। ওরকম ভোম ভোলানাথ মার্কা শরীরকে বলটিও বোধ করি সম্মান করে দৌড়ে পালায়।

আমি তখন ক্লাস ফোরে। বাবা ফরেস্ট অফিসার। ট্রান্সফার হয়ে ওয়াংফু দ্বীপে এসেছেন। সেখানেই ভোম্বলের সাথে পরিচয়। রাসু, লাল্টু, মনা, রীমা আর পাতলা খানের সাথেও হয়েছিল বন্ধুত্ব। বিকেলে আমরা একসাথে সুজিং বনের ঠিক পাশের মাঠটিতে আসতাম, খেলতাম, গল্প করতাম। আজ ক্রিকেট খেলতে এসে বলটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পাতলা খানের বোলিংয়ে এমনভাবে অপমানিত হতে হবে কেউ ভাবতেও পারেনি।

বলটি খুঁজতে খুঁজতে সবাই বনের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। সূর্য প্রায় অস্তমিত। বনের মধ্যে অন্ধকার নেমেছে। সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়ি ফিরে যাব। ঠিক তখনই খেয়াল হলো লাল্টু আমাদের সাথে নেই। ভাবলাম আশেপাশে হয়তো কোথাও আছে। আমরা সবাই একসাথে লাল্টু লাল্টু বলে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু সাড়া শব্দ নেই। বনের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেললো না তো?
 
খুব ভয় হচ্ছিলো। বনের ধারে আসতে লাল্টুর বাবা মায়ের কড়া নিষেধাজ্ঞা। যদি বাড়ি না গিয়ে থাকে তবে আর রক্ষে নেই। সবাই আরও কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করলাম। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। হয়তো বাসায় চলে গেছে। কিন্তু লাল্টু পৌঁছেনি। বাবার কাছে ফোন করলাম। ফোন পেয়েই বাবা বনের মধ্যে ফোর্স পাঠিয়ে দিলেন। মুহূর্তেই বন আলো আলো হয়ে গেল। কিন্তু কোথাও লাল্টুকে পাওয়া গেল না। এমনকি কোনো চিহ্ন বা আলামতও মিললো না।

অবশেষে সবাই ফিরে এলো, কিন্তু বাবাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। আঙ্কেল আন্টির সে কী কান্না! বন্ধুর আকস্মিক নিখোঁজে আমরাও ভেঙে পড়লাম। তদন্ত চলছে, কিন্তু কোনো ফলাফল আসছে না।
 
প্রতিদিন বিকেলে মাঠে বসে থাকি। হয়তো লাল্টু আমাদের চমক দিয়ে বলবে, কেমন দেখালাম এ কয়দিন ?

ভোম্বলের সাথে লাল্টুর ভাবটা ছিলো সবচেয়ে বেশি। লাল্টু সব সময় ভোম্বলকে খুঁচিয়ে বেড়াতো। এক সময় ভুড়িতে গুতো দিলে অন্য সময় গলায় গলায় খাতির। এজন্য ভোম্বলের মনটা একটু বেশিই খারাপ।

এক সপ্তাহ হয়ে গেল। লাল্টুর হারিয়ে যাওয়া কেউই মেনে নিতে পারছে না। আমরাও না। বনের মধ্যে হারিয়ে গেলে পাওয়া যেতো। যদি কোনো হিংস্র পশু আক্রমণ করে তো আলামত থাকবে। কিন্তু একবারে লাপাত্তা কিছুই নেই। পুলিশ, বনের কর্মকর্তা কেউই বিশ্বাস করতে নারাজ লাল্টু আমাদের সাথে বল খুঁজতে বনের মধ্যে গিয়েছিল। তাদের ধারণা কোনো কিডন্যাপার হতে পারে। কিন্তু একসপ্তাহ অনেক সময়। কিডন্যাপার হলে এতোদিনে মুক্তিপণ দাবি করতো। সেরকমও ঘটছে না।

বন্ধুদের কাউকেই সন্দেহ করতে পারছেন না লাল্টুর বাবা মা। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে ভয় দেখিয়েছিল। লাল্টুর মা ধমক দিয়ে থামিয়েছিলেন, ওরা একজন অন্যজনের জন্য পাগল। ওদেরকে ছাড়–ন। আপনারা ভালো করে খুঁজে দেখুন।

লাল্টু রহস্যের কোনো জটই ছাড়ছে না। আর জট ছাড়বে কেমনে। প্রশাসনতো কোনো ক্লুই পাচ্ছে না।

প্রতিদিনের মতো বিকেলে মাঠে বসে আছি। মনটা খুব বেশি খারাপ। লাল্টুর আশা প্রায় সবাই ছেড়ে দিয়েছে। থমথমে পরিবেশটা ভাঙলো মনা, ভোম্বল, মন খারাপ করে থাকিসনে। চল আমরা আবার আগের মতো হয়ে যাই। এখন থেকে আবার আমরা খেলবো, গাইবো, গল্প করবো।

কথাগুলো বলতে বলতে ভোম্বলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে মনা। সবার চোখে পানি। ঠিক হলো, মাঠের নাম হবে ‘লাল্টর মাঠ’।

মাঠে নামছি আমরা। উইকেট পোঁতা হচ্ছে। ব্যাটিংয়ে ভোম্বল। বল করবে পাতলা খান। ধারাভাষ্য দিচ্ছে রাসু, প্রথম ওভারের প্রথম বল, সুন্দর করে ডিফেন্সিভ খেললো ভোম্বল। এবারেরটা ফুলটস, হালকা করে উঠিয়ে সজোরে ব্যাট চালিয়েছে ভোম্বল।

আশ্চর্য! বলটি বেশ উপরে উঠে যাচ্ছ, ঠিক সোজা বরাবর। আর দেখা যাচ্ছে না। রাসু ধারাভাষ্য দিতে পারছে না। সবাই আকাশের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। এও কি সম্ভব! ঘোর কাটতে আর আলোচনা শেষ হতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সূর্য ডুবুডুবু। এবার ঘরে ফেরার পালা। সবকিছু গুছিয়ে নিলাম আমরা। কিন্তু মনা আর ভোম্বল নেই। রীমার খুব ভয় হলো। কাঁপা কণ্ঠে চিৎকার করে ডাকলো, ভোম্বল, মনা তোরা কোথায়? সন্ধ্যা হলো, বাড়ি যেতে হবে। কোনো সাড়া শব্দ নেই।

সবার গলা শুকিয়ে কাঠ। লাল্টুর মতো আবার কোনো অঘটন ঘটল না তো?
হঠাৎ বনের মধ্য থেকে ভোম্বলকে আসতে দেখা গেল। সবাই প্রায়  সমোস্বরে জিজ্ঞেস করলাম, কী রে, মনা কোথায়? কই, জানি না তো। আমি তো সিসি দিতে ... ভোম্বলের উত্তরে আমরা পাথর হয়ে গেলাম। তাহলে কী লাল্টুর মতো মনাও..। ভাবতে পারছিলাম না।

আমার সন্দেহ, ভোম্বলই কি...! না, তা কী করে হয়, মনকে বোঝালাম। কিন্তু যা হবার তাই হলো। মনাকে আর পাওয়া গেল না। কোনোভাবেই মনকে বোঝাতে পারছিলাম না। তাহলে কি মানুষে যা কানাকানি করছে তা ঠিক! তা যদি হয় তা হলে ভোম্বলের উপর সন্দেহটা অমূলক নয়।
আব্বুকে দিয়ে ওয়াংফু দ্বীপের জিওগ্রাফিক্যাল এনালাইসিস বুকটা আনালাম। এক নিঃশ্বাসে বইটি শেষ করে রীতিমতো শিউরে উঠলাম।

দ্বীপটিতে ভ্যামপায়ার বা ড্রাকুলাদের বাস আছে। এরা যে কোনো সময় যে কোন রূপ ধারণ করতে পারে। বেঁচে থাকার জন্য একমাত্র খাদ্য রক্ত। পছন্দ মানুষ। সূর্য ডোবার ঠিক আগ মুহূর্তে পান করে। এ সময় এদের চোখ উত্তপ্ত লোহার মত লাল বর্ণ ধারণ করে। রক্তপানের পর আনেকটা হলুদাভ হয়।

মনা হারিয়ে যাওয়ার পর ভোম্বলের চেহারাটা মনে পরল। সব মিলে যাচ্ছে। ‘তাহলে কি ও-ই...’ ভাবতে পারছিলাম না। মনা নিখোঁজ এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। এক সপ্তাহ পরপর ভ্যাম্পায়ারদের রক্তের প্রয়োজন। আজ তাহলে ভোম্বল আবারও রক্ত পান করবে।

এই সপ্তাহে শুধু ফোনে ছাড়া কারও সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। মা বাবার কড়া নির্দেশ, লাল্টু-মনা রহস্য সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বাইরে যাওয়া নিষেধ। আমি রীমাকে ফোন করলাম। ভ্যাম্পায়ার-ড্রাকুলা আর ভোম্বল সম্বন্ধে আমার সন্দেহের সব জানালাম। যদি ভ্যাম্পায়ারের কাজ হয় তাহলে এবারের টার্গেট তুই। কারণ ওরা দু’জন ছেলের পর একজন মেয়ের রক্ত পান করে। ভয় পাস না। আমরা সবাই আসছি। আর কারও সাথে শেয়ার করিস না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
রীমা আকাশ থেকে পড়ল। আমার ভীষণ ভয় করছে। বাসায় বাবা মা কেউ নেই।

রীমাকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে বলে বাচ্চু মামাকে ফোন দিলাম। খুব দ্রুত বাচ্চু মামা, রাসু আর আমি রীমার বাড়িতে পৌঁছুলাম। কিছুক্ষণ পর আসলো ভোম্বল। পাতলা খানও পৌঁছে গেছে। ভোম্বলের গতিবিধির উপর সবার সতর্ক দৃষ্টি। আমাদের সন্দেহের কথা বুঝতে না দিয়ে আনন্দ করে যাচ্ছি। ভয়ও করছে প্রচুর। কখন কী ঘটে যায়।

সবার চেহারা দেখে মামা গল্প শুরু করলেন। ফাটানো হাসির গল্পে ঘর গমগম করছে।

সূর্য প্রায় ডুবে এসেছে। খুব সতর্ক থাকতে হবে। যে কোনো মুহূর্তে ঘটবে অঘটন। রীমা আমার কানে কানে বাইরে যেতে বলল। কী যেন জরুরি কথা আছে। আমি বাইরে এলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? রীমা বলল, এখানে কিছু বলা যাবে না। এ ঘরে আয়। আমি পাশের ঘরে গেলাম। ঢুকেই আমার সমস্ত শরীর হিম হয়ে গেল। বিছানার উপরে পড়ে আছে মনা আর লাল্টুর ক্ষত বিক্ষত দেহ। আমি কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না।

রীমা নিস্তব্ধতা ভাঙলো। ‘কি, অবাক হচ্ছিস? তোর ভাবনার অর্ধেকটা ঠিক আছে। তবে সিদ্ধান্তের কিছুটা ভুল। মেয়ে ভ্যাম্পায়াররা মেয়েদের রক্ত পান করে না’ - বলেই আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ধস্তা ধস্তি চলছে। আমি বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মানুষ সৃষ্টির সেরা। ভ্যাম্পায়ার আমাকে শেষ করবে এটা হতে পারে না। কিন্তু কোনোভাবেই পেরে উঠছি না। অশুরের শক্তি যেন রীমার মাঝে। গালের দু’পাশ থেকে তীক্ষè দাঁত বড় হয়ে বেরিয়ে আসছে। চোখ প্রজ্জ্বলিত লোহার মতো লাল। দেহের সব রক্ত যেন চোখে এসে জমাট বেঁধেছে।

রীমার গায়ের চামড়ার ভয়ঙ্কর পরিবর্তন হতে শুরু করল। শরীরের ভেতর থেকে যেন কোনো পশু বেরিয়ে আসছে। গা ভর্তি উস্কো-খুস্কো লোম। লাল্টু আর মনাও আরমোড়া ভেঙে হেলে দুলে এগোচ্ছে। পরিবর্তন হচ্ছে ওদের শরীর, বেরিয়ে আসছে এক একটি পশু। আমি আর পেরে উঠছি না। সব শক্তি যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রাণপণ চিৎকারে ভোম্বল, রাসু, বাচ্চু মামা, পাতলা খানকে ডাকছি। কিন্তু কেউ সাড়া দিচ্ছে না। একটু নড়াচড়ার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছি। রীমা ওর দাঁত বসিয়ে দিচ্ছে আমার ঘাড়ে ...।

অনেক দূর থেকে আম্মুর কণ্ঠ শুনতে পেলাম। কী বলছেন বুঝতে পারছি না। আবছা কণ্ঠস্বর গাঢ় হলো- তুষার, বাবা ওঠ। আর কত ঘুমাবি। স্কুলে যেতে হবে না!!?

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।