ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

শপথ | রুমান হাফিজ

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৬
শপথ | রুমান হাফিজ মুক্তিযুদ্ধের গল্প/প্রতীকী ছবি

চারদিকে ঘন অন্ধকার। কোথাও সাড়াশব্দ নেই। দিনের লাল টুকটুকে সূর্যটা বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো এলাকার লোকজন যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়।

চারদিকে ঘন অন্ধকার। কোথাও সাড়াশব্দ নেই।

দিনের লাল টুকটুকে সূর্যটা বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো এলাকার লোকজন যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়।

গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা বিশাল নদী পার হওয়ার একমাত্র ভরসা রহিম মাঝি। দিনের বেলা সাধারণ মানুষেরা পারাপার করলেও রাতে তেমন কেউ পার হয় না। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের পার করে দিতেই সারা রাত নৌকা নিয়ে বসে বসে অপেক্ষা করেন রহিম মাঝি। সেই সন্ধ্যেবেলা ছেলে জসীম কে নিয়ে আসেন, এখন রাত প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি।
ফরিদ আর জামাল ওদের তো আজ পার হওয়ার কথা। এখনো আসছে না যে। কোনো সমস্যা হলো না তো! এসব ভাবতে ভাবতে রহিম মাঝি ছেলের দিকে তাকায়-
-জসীম
-জ্বি
-তোর কি ক্ষিধে লাগছে?
-হ বাজান
-এই নে চিড়া আর গুড়।
বাড়ি থেকে আসার সময় পুটলিতে করে তা নিয়ে আসে রহিম মাঝি। জসীম একমুঠো চিড়া আর একটুকরো গুড় মুখে দিয়ে বাবার কাছে এসে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করে-
-আর কতক্ষণ বাবা?
-কেন, তোর কি কষ্ট অইতাছে?
-না বাজান
-তাইলে?
-এতোক্ষণ হলো ওরা যে আইতাছেনা।
-হ্যাঁ, আসবে বাজান।
জসীম উপরের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ পর জসীম বলে উঠলো, ঐ যে দেখো বাবা, মনে ওরা আইসা গেছে।
রহিম মাঝি নৌকা ঘাটে ভেড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে তারা নৌকায় উঠে পড়ে।
-রহিম চাচা কেমন আছেন? ফরিদ প্রশ্ন করে
-না বাজান তেমন ভালো না।
-কেন, কি অইছে চাচা?
-পাক-বাহিনী যেভাবে দিনদিন গ্রাম চষে বেড়াইতাছে, তাতে আর ভালো থাকবার পারি?
-চাচা চিন্তা কইরেন, আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাইবো।
-চাচা আমার খুব ভয় অইতাছে, জসীম বলল।
-কি অইছে?
-আমাদের গ্রামের ইদ্রিস আলি আছে না, হে বলছে রহিম মাঝি শালার মুক্তিযোদ্ধাদের পার কইরা দেয়। হেরে শেষ কইরা দিতে অইবো।
-ভয় পাবেন না চাচা, একটু সাবধানে থাকবেন।
ততক্ষণে নৌকা ওপারে গিয়ে ভেড়ালে, সবাই নেমে পড়ে। যাওয়ার সময় ফরিদ কিছু টাকা রহিম মাঝির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল-
-চাচা আপনার এ ঋণ আমরা কোনোদিন শোধ করতে পারবো না।

-'না বাজান এ আর এমনকি। তোমাদের পার কইরা দিতাছি বইলা নিজের মনে একটু শান্তি পাই। আর যাই হোক, যতদিন বাঁচি ততদিন তোমাদের নৌকায় পার কইরা দিবো।

 সবাই নেমে গেলে রহিম মাঝি নৌকা ঘোরায়। উদ্দেশ্য নৌকাটা ঘাটে বেঁধে বাড়িতে যাবে। নৌকা পাড়ের কাছে ভেড়াতেই হঠাৎ উপর হতে কার যেন ডাক শুনতে পায় রহিম মাঝি। তাকাতেই বুকটা কেঁপে উঠলো। এতো ইদ্রিস আলি! পাক-বাহিনীর সহযোগী। ওদের নানাভাবে সহযোগিতা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে যায় মিলিটারি ক্যাম্পে। তার কারণেই আজ গ্রামের লোকজন ঘড়ছাড়া।
কিছু বলার আগেই গর্জে ওঠে ইদ্রিস আলি। সঙ্গে তার কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ।

‘এই রহিম্মা, তুমি নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের পার কইরা দিতাছো?  এ কথা শুনে রহিম মাঝি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রয়।

-'হ, পার কইরা দিতাছি, তাতে কি অইছে? তুমি তো পাক-বাহিনীর দালাল। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে জসীম উত্তর দেয়-
কোনো কথা না বলেই হাতে থাকা রাইফেল দিয়ে মুহূর্তেই গুলি ছোড়ে ইদ্রিস আলি। জসীম পানিতে ডুব দিয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও একটা গুলি লাগে রহিম মাঝির। নৌকায় দাঁড়িয়ে থাকা রহিম মাঝির রক্তাক্ত দেহ পানির প্রবল স্রোত দিয়ে যেতে লাগলো....।

সকালবেলা ঘাটে আসে জসীম। কিন্তু বাবাকে তো আর দেখা যাচ্ছে না। ঘাটের কাছে নৌকায় পা রাখতেই চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে। নৌকায় ছোপ রক্তের দাগ দেখে বুঝতে আর বাকি রইলো না, রহিম মাঝি আর বেঁচে নেই। নিষ্পাপ রহিম মাঝির একটাই অপরাধ, মুক্তিযোদ্ধাদের ভালোবেসে তাদের নৌকায় পার করে দেওয়া। ফলশ্রুতিতে তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করে।

নিষ্পাপ বাবার রক্তমাখা নৌকায় বসে শপথ নেয় জসীম -‘স্বাধীনতার লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে এই রক্তের বদলা নেবে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৬
এএ

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।