ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

ঈদ আনন্দে গিট্টু ক্লাব | মিলন রহমান

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৫ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৭
ঈদ আনন্দে গিট্টু ক্লাব | মিলন রহমান ঈদ আনন্দে গিট্টু ক্লাব

গিট্টু দা’র জরুরি তলবে গিট্টু কিশোর ক্লাবের জরুরি মিটিং বসেছে। মাথায় হুটহাট বুদ্ধি খেলে গেলেই গিট্টু দা জরুরি মিটিং ডেকে বসেন। ক্লাবের সদস্যরা তাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম জরুরি মিটিং ডাকলে সবার বুকের মধ্যে ড্রাম বাজতো। এখন আর বাজে না।

নির্ধারিত সময়ের আগেই তুষার, অমিত এসে বসে আছে। আস্তে আস্তে আকাশ ও শান্তিকে দেখা গেলো।

আল-আমিন বোধহয় আজ আসতে পারবে না। কিন্তু সভাপতি কোথায়?

এমন সময় গিট্টু দা হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করলেন। এসেই হাঁকলেন, ‘শোন্, এবার ঈদ আমরা ব্যতিক্রমীভাবে উদযাপন করবো। ’

তুষাররের সেই স্বভাবের ব্যতিক্রম হলো না। গিট্টু দা আর কিছু বলার আগেই তুষার বলে বসে, ‘প্রত্যেকবার তো আমরা ঘুরে বেড়াই, খেলা করি, মজা করি; এবার কি এসব কিছু হবে না দাদা?’

কথা শেষ করতে না পারায় ক্ষেপে যান গিট্টু দা, ‘না, হবে না। এবার তোরা ঘরে বসে থাকবি, আর পান চিবুবি। এরপর থেকে মিটিংয়ে তুই দুইটা করে পান নিয়ে আসবি। মিটিংয়ের মধ্যে পান মুখে দিয়ে বসে থাকবি। তোর গালে পান থাকলে শান্তিতে একটু কথা বলা যাবে!’

‘দুইটা পান কেন দাদা?’ প্রশ্ন করে বসে অমিত। গিট্টু দা’র উত্তরও রেডি, ‘তুষারের মত আরও একটা পণ্ডিত পাওয়া যাবে জানতাম। সেই জন্যও দু’টো বলেছি। বুঝলি বুদ্ধু? দ্বিতীয় পানটা তুই চাবাবি। ’

পরিস্থিতি ঘোলাটে হচ্ছে দেখে আকাশ মুখ খোলে। ‘এই তোরা কী শুরু করলি, দাদাকে বলতে তো দিবি! তারপর সবাই এক এক করে বলিস। ’ ‘দাদা, আপনি ওদের মাফ করে দেন; এবার বলেন। ’

গিট্টু দা কিছুটা শান্ত হন। বলেন, ‘শোন তোরা তো মেজাজটা বিগড়ে দিয়েছিস। তারপরও মাফ করে দিলাম। তবে আজ আর মিটিং হবে না। কাল এই সময়ে আবার বসবো। তার আগে ঈদকে আমার কি করে ব্যতিক্রমীভাবে উদযাপন করতে পারি সবাই তা ভেবে আসবি। এরপর আলোচনা হবে। ’

পরদিন ফের মিটিং শুরু হলো। আজ সবাই এসেছে। শুরুতেই আল-আমিন বলল, ‘দাদা আগের দিন, তো আসতে পারিনি, তবে আলোচনার বিষয়বস্তু জেনে নিয়েছি। ’

‘আচ্ছা বল, এবার আমরা ঈদ নিয়ে নতুন কী করতে পারি?’ জানতে চান গিট্টু দা।
‘প্রত্যেক বার ঈদের দিন তো আমরা ঘোরাঘুরি করি, এবার আমরা ক্রিকেট খেলতে পারি। ’ বলে আল-আমিন।

‘এবার আমরা সাইকেল ভ্রমণে বের হতে পারি’; তুষারের প্রস্তাব।
‘আমরা সামাজিক বিভিন্ন প্রচারণা চালাতে পারি’; মত দেয় আকাশ।
শান্তি প্রস্তাব দেয়, ‘ঈদে আমরা দরিদ্র শিশুদের জন্য কিছু করতে পারি। ’

সবশেষে অমিতের বক্তব্য, ‘দাদা আমাদের ভালো এবং বিশেষ কিছু করতে হবে, যাতে সবাই আমাদের ক্লাবকে বাহবা দেয়। ’

গম্ভীর মুখে সবার বক্তব্য শোনেন গিট্টু দা। এবার তিনি মুখ খোলেন। বলেন, ‘শোন আমার মাথায় একটা বিশেষ আইডিয়া আছে বলেই এই জরুরি মিটিং ডেকে তোদের মাথায় কী আছে তাই যাচাই করছি। ’ একটু থামেন গিট্টু দা।

ফের শুরু করেন, ‘আমরা এমন কাজ করবো যাতে আমাদের ক্লাবের নাম মুখে মুখে ছড়িয়ে যাবে। সবটা এখন তোদের বলবো না, তবে শেষে তোরা মিলিয়ে নিস। এখন শুধু এইটুকু জেনে রাখ, রমজান মাস শুরুর তো কয়েকদিন বাকি; মধ্য রমজানে আমরা একটা প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করবো। ’

‘ক্রিকেট ম্যাচে কি করে নাম ফুটবে দাদা?’ জিজ্ঞেস করেই জিভে কামড় দেয় তুষার।

‘তোর এই স্বভাব আর ঠিক হবে না!’ হতাশা ব্যক্ত করে গিট্টু দা ফের বলেন, ‘এটা স্পেশাল প্রীতি ম্যাচ। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন মাশরাফি তো স্বপনের বন্ধু। আর স্বপনকে তো তোরা চিনিস; ওই যে আমার নড়াইলের বন্ধু। স্বপনের সাথে আমার কথা হয়েছে। মাশরাফি তার কিছু বন্ধু নিয়ে আসবে; সেটি হবে ক্যাপ্টেন একাদশ। আর আমরা গিট্টু কিশোর ক্লাব। দু’দলের টি-টোয়েন্টি ম্যাচ, জমজমাট লড়াই। খেলার জন্য সবাই প্রস্তুত হ, আর তার আগে এই ম্যাচের প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে। ’ বলেই আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে যান গিট্টু দা।

গিট্টু দা চলে যাওয়ার পর বাকিরা আলোচনা করতে থাকে। ‘ক্রিকেট ম্যাচ তো বুঝলাম। মাশরাফিরা খেললে তো মানুষের আগ্রহ থাকবে। কিন্তু গিট্টু দা কিছু একটা গোপন করে গেছে’; বলে আকাশ।

তাতে সায় দেয় অমিত। ‘হুম তা তো বুঝতে পারছি। গিট্টু দা’র মাথায় অন্যকোনো পরিকল্পনা আছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করা পর্যন্ত তো কিছুই বোঝা যাবে না। তাই দাদা, যা বলেন, তাই করা ছাড়া তো কোনো উপায় নেই। ’ অগত্যা সবাই যে যার বাড়ির পথ ধরে।

মাশরাফির সম্মতি পাওয়ার পর প্রচারণা শুরু হলো। ‘আসছে পনেরো রমজান গিট্টু কিশোর ক্লাবের মাঠে জমজমাট প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ। ম্যাচে মাশরাফির নেতৃত্বে ক্যাপ্টেন একাদশের মুখোমুখি হবে গিট্টু কিশোর ক্লাব। আর শুধু খেলা নয়, মাঠে থাকবে স্পেশাল কিছু! তাই মিস করবেন না, নির্দিষ্ট দিনে চলে আসুন মাঠে!’

এই প্রচারণার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে যাওয়ায় মিডিয়ারও আগ্রহ সৃষ্টি হলো। নির্দিষ্ট দিনে সকাল থেকেই গিট্টু কিশোর ক্লাবের মাঠে দর্শকদের আগমন শুরু হয়ে গেল। বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখা বাউন্ডারির চারিধারে দর্শকরা বসে যেতে শুর করলো। একদল স্বেচ্ছাসেবক দর্শকদের সারিবদ্ধ হয়ে বসে খেলা দেখার প্রস্তুতি নিতে সহযোগিতা করতে লাগলো।

সকাল দশটায় তুমুল করতালির মধ্যে দিয়ে মাশরাফি তার দল নিয়ে মাঠে প্রবেশ করলেন। খেলার ধারা বিবরণীর জন্য রাখা মাইক হাতে তুলে নিলেন তিনি।

মাশরাফি বললেন, ‘গিট্টু ক্লাবের এই খেলা উপভোগ করতে যারা মাঠে হাজির হয়েছেন, তাদের সবাইকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। আপনারা নিশ্চয় অবাক হয়েছেন, এমন একটা সামান্য ম্যাচ খেলতে আমি কেন দল নিয়ে এসেছি! গিট্টু দা যখন এই ম্যাচের প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে গেল, তখন আমিও অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু তার উদ্দেশ্য শুনে আমি সানন্দে রাজি হয়েছি এবং এখানে খেলতে এসেছি। এখন নিশ্চই আপনাদেরও জানতে ইচ্ছে করছে, কি সেই উদ্দেশ্য?

একটু থামলেন মাশরাফি। এরপর ফের শুরু করলেন, ‘আপনারা সবাই জানেন, আমাদের চারপাশে অনেক দরিদ্র, ছিন্নমূল পরিবারের শিশুরা আছে, একটি নতুন পোশাকের অভাবে যাদের ঈদ আনন্দ ফিকে হয়ে যায়। এই শিশুদের কাছে নতুন পোশাক পৌঁছে দিতে গিট্টু দা এই ম্যাচ আয়োজন করেছেন। এই ম্যাচের মাঠে কোনো টিকেট নেই। খেলা সবাই বিনা টিকিটে উপভোগ করতে পারবেন।

আর খেলা চলাকালে স্বেচ্ছাসেবকরা অর্থ সংগ্রহ বাক্স নিয়ে আপনাদের কাছে যাবেন। যার যা ইচ্ছে তাই আপনারা এই বাক্সে দান করবেন। খেলা শেষে এই অর্থ গণনা করা হবে। এই টাকায় নতুন পোশাক পাবে দরিদ্র শিশুরা। গিট্টু দা’র এই আইডিয়া আমাকে নাড়া দিয়েছে বলেই এখানে খেলতে এসেছি। তাই সবাই খেলা উপভোগ করুন, আর শিশুদের জন্য হাত বাড়িয়ে দিন। ’ এই বলে বক্তব্য শেষ করলেন মাশরাফি। মাশরাফির বক্তব্য শেষ হওয়ার পর হাততালি যেন থামতেই চায় না।

খেলা শুরু হলো। টস জিতে মাশরাফির ক্যাপ্টেন একাদশ ব্যাট করতে মাঠে নামলো। নির্ধারিত বিশ ওভারে ছয় উইকেট হারিয়ে তারা সংগ্রহ করলো ১৭২ রান। পাল্টা ব্যাট করতে নেমে গিট্টু কিশোর ক্লাব শুরুতেই মাশরাফির আগুন বোলিংয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো। মাশরাফি তার চার ওভারে চারটি উইকেট তুলে নিলেন। তারপরও আকাশ ও শান্তির অর্ধশতকে গিট্টু দা’র দল ঊনিশ ওভার তিন বলে একশ বায়ান্ন রানে অলআউট হয়ে গেল। বিশ রানে জয় পেল ক্যাপ্টেন একাদশ।

এদিকে, খেলা চলাকালেই স্বেচ্ছাসেবকরা দশটি বাক্স নিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। খেলা শেষে দর্শকদের উপস্থিতিতে টাকা গণনা করা হলো। দশটি বাক্স থেকে পাওয়া গেল বিয়াল্লিশ হাজার তিনশ পঁচিশ টাকা।

মাশরাফি দর্শকদের সামনে ঘোষণা করলেন, ‘মাঠের দর্শকরা শিশুদের জন্য দিয়েছেন বিয়াল্লিশ হাজার তিনশ পঁচিশ টাকা। আমি গিট্টু দা’র সাথে আলোচনা করেছি, একজন শিশুর জন্য গড়ে পাঁচশ টাকার মূল্যের পোশাক কিনলে দুইশ শিশুর জন্য পোশাক কিনতে এক লাখ টাকা লাগবে। ’ মাশরাফি নিজে বাকি টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিলেন। দর্শকরা দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে মাশরাফিকে অভিনন্দিত করলেন।

মাশরাফির এই ঘোষণা শুনে গিট্টু দা ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে গিট্টু দা বললেন, ‘আপনার এত বড় হৃদয় বলেই আপনি টাইগার দলপতি। ’

এরপর শান্ত হয়ে গিট্টু দা ঘোষণা করলেন, ‘ঈদের দু’দিন আগে এই মাঠেই শিশুদের মাঝে নতুন পোশাক বিতরণ করা হবে। আমরা অনুরোধ করবো, টাইগার দলপতি নিজে শিশুদের হাতে এই পোশাক তুলে দিয়ে তাদের আপন করে নেবেন। ’ মাশরাফিও রাজি হলেন।

টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও অনলাইনগুলো এই খবর ফলাও করে প্রচার করলো। মাশরাফি ও গিট্টু কিশোর ক্লাবের নামে সবাই ধন্য ধন্য করলো।

শুধু গিট্টু ক্লাবের সদস্যরা অবাক হয়ে ভাবলো, গিট্টু দা তো আগেই বলেছিল...!

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।