আমাদের সমাজে লর্ড কর্নওয়ালিশের (গভর্নর জেনারেল অব ফোর্ট উইলিয়াম ১৭৮৬-১৭৯৩) নামে কারো নাম রাখতে তেমন দেখা যায় না। কিন্তু লর্ড রিপন(ভাইস-রয় অব ইন্ডিয়া ১৮৮০-১৮৮৪)-এর আদলে রিপন নামটি এখনো আপনি বাঙালি মুসলমান সমাজে দেখতে পাবেন [লিটন(১৮৭৬-১৮৮০), কার্জন(১৮৯৯-১৯০৫), মিন্টু (১৯০৫-১৯১০) ইত্যাদি নামও আমাদের সমাজে নেহায়েত কম নয় ]।
এই বৈপরিত্যের একটা সহজ কারণ হলো কর্ণওয়ালিশ বাংলা নাম হিসেবে অতটা শ্রুতিসখ্য নয়। তাছাড়া ওই লোকটার মারেফতে পূর্ব-ভারতীয় কোম্পানি বা ইংরেজ রাজত্বের ঝান্ডা নিয়ে যে জাহাজখানি ১৬১২ সালে সুরাট বন্দরে ভিড়েছিল তা বাংলায় বা ভারত-মুল্লুকে ১৭৯৩ সালে 'পার্মানেন্টলি' 'সেটেল'করে। আর রিপনসহ অন্য যাদের নাম করলাম তারা ইংরেজ সাম্রাজ্যের ভরা যৌবনে ভারতবর্ষ শাসন করেছেন।
কর্ণওয়ালিশ কদর্যরুপে সাম্রাজ্যের স্থায়ী ভিত্তি দিয়েছেন আর রিপন সাম্রাজ্যবাদকে শিল্পের রূপ দিয়েছেন।
প্রথমজন 'জমিদার'দের জনক, সুতরাং ফিউডালিজম এর প্রতিভূ (চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ১৭৯৩), দ্বিতীয়জন মাটির একটু কাছাকাছি 'জোতদারদের' পিতা (বঙ্গীয় প্রজাসত্ত্ব আইন ১৮৮৫)। জমি ও জোত- শব্দ দুটোর মধ্যে উৎকর্ষগত পার্থক্য যেন শ্রেণীগত পার্থক্য-কে উস্কে দিয়েছে। ব্যবধানটা যেন 'ভূমি' ও 'ক্ষেত '-এর মধ্যকার দূরত্বের সমান।
জোতদাররা একসময় রায়ত (চাষা/কিষাণ) ছিলেন বটে, বঙ্গীয় প্রজাসত্ত্বের (১৮৮৫) 'ভাগকরো শাসন করো' নীতির সুক্ষ্ম চালে ফুলে-ফেঁপে ওঠা উচ্চ রায়তশ্রেণী অধীনস্ত রায়তদের শোষণ করা শুরু করলো।
কর্ণওয়ালিশ ও রিপনের শাসনকালের মধ্যে প্রায় একশত বছরের ব্যবধান। ততদিনে আমেরিকান যুদ্ধের পরাজিত জেনারেল কিন্তু টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষে এসে জয়ী হওয়া সেনাপতি কর্ণওয়ালিশের উত্তরসূরী রিপনের সাম্রাজ্যের রশি অনেক লম্বা হয়েছে (রিপনের মুখে লম্বা দাঁড়ি ছিলো, যা ভারতবর্ষে আসা অন্য কোনো গভর্নর-জেনারেলের ছিলনা)।
রিপন রায়তদের প্রতি দরদী ছিলেন (এস. গোপাল:১৯৫৬)। কারণ, রায়তশব্দটা যে তার নামের আদ্যাক্ষর 'র' দিয়ে শুরু! আহা! বিশ্বাস হলোনা? আচ্ছা, হেয়ালি ছাড়াই বলছি রিপন ছিলেন ১৮৮০'র জমানায় ইংলিশ লিবারেল প্রধানমন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোন-এর 'উদারনৈতিক ভারত নীতির' যোগ্য খলিফা। উনিশ শতকের শেষ ভাগে বা বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বাঙালী মুসলমানের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন সাধারণ রায়ত। তাই রিপনের রায়তমুখী ভূমি নীতি ও চেহারায় মুসলিম আদলের দাঁড়ি তাঁকে বাঙালী সমাজে জনপ্রিয়তা দিয়েছিলো বলে অনুমান করি। তাই তার নামের সাম্রাজ্যের সলতে এখনো জ্বলতে দেখতে পাই!
উপনিবেশের জাল বিস্তারে ইংরেজরা ভূমি-কে ভূমিকা হিসেবে ব্যবহার করেছে ১৬শ শতাব্দী থেকে (প্যাট্রিক মাকুস্লান: ২০০৬)। না হলে বাংলা ভাষায় শুরু করার বাংলা 'ভূমি-কা' হতে যাবে কেন? ইংরেজরা প্রথম খেলেছে আয়ারল্যান্ড-এর ভূমি ব্যবস্থা নিয়ে। কিন্তু বাংলায় যেভাবে তারা ভূমি নিয়ে কারবারী করেছে তার জুড়ি মেলা ভার।
যোগ্য লোকও পাওয়া গেল--কর্ণওয়ালিশ! হেস্টিংস-এর হেসিটেটিং জোয়ার-ভাটার ভূমি নীতি ইংরেজ রাজনীতিকদেরও উদ্বিগ্ন করে তোলে(রনজিত গুহ: ১৯৬৩)। তাই তরুণ প্রধানমন্ত্রী পিট্ (পিট্ দ্য ইয়ংগার) তুখোড় বক্তা এডমুন্ড বার্কসহ তার অন্যান্য সভাসদ নিয়ে 'চিৎকার' করে ওঠেন ১৭৮৪ সালে (পিট্'স ইন্ডিয়া এক্ট)। তাই শিল্প-বিপ্লবের ঠনঠনানী নিয়ে ১৭৮৬ সনে ভারত এসে কর্ণওয়ালিশ 'কৃষি-বিল্পবে' মন দেন। তিনি শস্য ফলাবার চান। চাইবেন নাই বা কেন? শস্য তো তার নামের সাথেই আছে--'কর্ন'!
মুরব্বিরা প্রায় সহমত যে কর্ণওয়ালিশ-এর বিশ্বাস ছিল জমির মালিকানা যদি 'জমিদারদের' স্থায়ীভাবে দিয়ে দেয়া যায় তারা খুশি হয়ে অঢেল জমি চাষের আওতায় আনবেন আর বাংলায় 'কৃষি-বিপ্লব'হয়ে যাবে (বিবি চৌধুরী:১৯৮৩)। কর্ণওয়ালিশ তাই 'কর্ন-ভালো-হোস' এর আশা জাগালেন।
১৭৯৩ সালে জমিদারী আইনের মাধ্যমে তিনি রায়তদের কাছ থেকে জমিতে তাদের 'কাছ-তোমারি'(customary) অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে জমিদারদের হাতে 'স্থায়ীভাবে' অর্পণ করলেন। আর ইংরেজ চশমায় দেখা ভূমির 'প্রাইভেট রাইটস' তত্ত্ব বাংলায় অনুপ্রবেশ করালেন। যেটা হলো তাকে বলা যায় আইনের 'মিসপ্লেসমেন্ট'। তার নামে ওযা প্রতিকী-- 'wallis' থেকে আপনি যদি 'li' বাদ দিয়ে বিপরীত থেকে উচ্চারণ করেন তবে তা হয় 'laws'! সুতরাং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইন বাংলার চাষীদের ১৫৭ বছরের 'দুঃখ গাঁথা' হিসেবেই রয়ে গেলো (লুত্ফুল কবীর: ১৯৬৯)।
শুধু কি ১৫৭ বছর, এখনো নয় কি? ২০১৪ সালে এসে দেখতে পাচ্ছি "প্লান্ট ভ্যারাইটি এন্ড ফার্মার'স প্রটেকশন" আইনের খসড়ায় ভাগ-চাষীরা 'কৃষক'
হিসেবেই স্বীকৃতি পাননি! চাষাদের আবার মেধাস্বত্ত্ব কি? কি জমিদারী মানসিকতা!
কর্ণওয়ালিশ-এরই বা দোষ কি? রনজিত গুহ (১৯৬৩) জানাচ্ছেন সমসাময়িক 'ফিজিওক্রাট' চিন্তা দ্বারা কর্ণওয়ালিশ আবিষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর সামনে তখন 'কলোনিয়াল তত্ত্বের' নানান আইনি ও অর্থনৈতিক দর্শন ঘুরপাক খাচ্ছে। তাঁদের নামগুলো-ও লোহা-আকরিকের সাথে মিল, কৃষির সাথে নয়---ব্লাক'স্টোন', আদম 'স্মিথ', ফিলিপ ফ্রান্সিস (লোহার বৈজ্ঞানিক নাম ফেরাস), হেনরি পাতুল্য (পাতিল এর কথা মনে আনুন), আলেকজান্দার 'দাও', উইললিয়াম পিট্ (দ্য ইয়ংগার)ইত্যাদি।
ব্লাকস্টোনের কমেন্টারি-তে (১৭৬৯) বলা ছিল মালিকানা যোগ্য জিনিসকে সুনির্দিষ্ট মালিক দাও। পাতুল্য এবং দাও ১৭৭০ দশকে স্থায়ী ভূমি রাজস্ব নীতির পক্ষে রচনা লিখে রেখেছিলেন। ফ্রান্সিস ১৭৭৬ সালে কোম্পানি'র আয়ের উৎস নিশ্চিত করতে বিশাল রূপকল্প দিয়েছিলেন। একই সময় আদম স্মিথ-এর পলিটিক্যাল ইকোনমির তখন জয়জয়াকার [দ্য ওয়েলথ অব নেশন (১৭৭৬)]।
তরুণ প্রধানমন্ত্রী পিট আর তার উপদেষ্টা হেনরী 'ডান্ডা'স(!) ১৭৯০ সালে একদিন পার্কে বসে গল্প করতে করতে কর্ণওয়ালিশ-এর আইডিয়া অনুমোদন করে ফেলেন। এতসব পাথর-লোহা-পাতিল-পিট-ডান্ডা প্রসূত ক্যাপিটালিজম থেকে 'শস্য' বিপ্লব আর হয়ে ওঠেনি। তবুও কর্ণওয়ালিশ তার স্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য অনেক সুরক্ষা ক্লজ রেখেছিলেন (সিরাজুল ইসলাম: ১৯৭৯)। তার উত্তরসূরী 'মার্জিত গভর্নর জেনারেল' জন শোর
(১৭৯৩-১৭৯৮) আর যুদ্ধবাজ ওয়েলেসলী-র আমলে (১৭৯৮-১৮০৫) সব ওয়েলফে আর মাঠে মিশে যায়।
সুতরাং, শস্যওয়ালা (কর্ণওয়ালিশ) আবার আসেন ১৮০৫ সালে। তবে এবার টেকেন মাত্র দুই মাস। ভারতের উত্তর প্রদেশের গাজীপুরে একদিন নৌকায় যেতে যেতে তিনি পীড়িত হয়ে পড়েন। তার কথা ছিলো "গাছ যেখানে পড়ে যায়, সেটিকে সেখানেই পাটায় থাকতে দাও" (থম্পসন:১৯৯৯)। কর্ণওয়ালিশ সেখানেই শুয়ে আছেন। বোধ হয় তিনি-ই একমাত্র ব্রিটিশ গভর্নর-জেনারেল যিনি ভারতে 'পার্মানেন্টলি' সমাহিত হয়েছেন।
কর্ণওয়ালিশ-এর 'শস্য' 'রাইপেনড ' হয়েছে রিপন-এর আমলে। আমাদের মনে রাখতে হবে ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহে ইংরেজরা প্রায় হারতে বসেছিলো।
রানী ভিক্টোরিয়া তাই পর্দার আড়াল থেকে সামনে আসেন ১৮৫৯ সালে। ঝড় অবশ্য চলেছে পরের বিশ বছর ধরেও । পাবনার কৃষক বিদ্রোহের (১৮৭৩) কথা মনে আছে? পুষ্পকমল 'ইম্পেরিয়াল' ঢাল নিয়ে রিপন তাই ভারতে আসেন ১৮৮০ সালে। আসেন অনেক জনমুখী সংস্কারের ডালা নিয়ে। প্রেস স্বাধীনতা, স্থানীয় স্বশাসন, রায়ত অধিকার নিয়ে তার চিন্তায় তিনি বিজেতা বনে যান। তার ইম্পেরিয়াল নীতি ছিলো: ইংল্যান্ড-কে ভারত শাসন করতে হবে ভারতের প্রয়োজনে, ইংল্যান্ড-এর প্রয়োজনে নয়।
মিষ্টি কোথায় চিড়ে ভেজে! সুতরাং ভারতে তিনি হিরো হলেন, কিন্তু ভারতীয় ইংরেজ ও দেশীয় ইংরেজদের কাছে অনাকাঙ্খিত। বড় সমস্যা দেখা দিল
কৃষকদের অধিকার তিনি ফেরত দেবার চাইলেন। কিন্তু কর্ণওয়ালিশ-এর জমিদাররা এতদিনে ভারতের রাজনীতির বড় কন্ঠ। তাই তাদের বাধায় পারলেন না।
তিনি পদত্যাগ করে মেয়াদের খানিক আগেই ভারত ত্যাগ করলেন। আনন্দিত প্রধানমন্ত্রী 'গ্লাড'স্টোন তাই ছাড়লেন তার পরবর্তী তাস লর্ড দাফেরিন-কে।
দাফেরিন তাই জমিদারদেরকে ফেরান স্ব-মর্যাদায় ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্ব আইনে। বলাই বাহুল্য আইনটি যতোটা না ছিলো রায়তদের অধিকার দেবার, তার চেয়ে বেশি ছিলো 'পলিটিক্যাল প্যাকেজ'। তাই এটি 'ভূমি আইন' হ লনা, হলো 'টেন্যান্সি'আইন।
ভারত থেকে যাওয়ার আগে রিপন একটা লংমার্চ করেন -অমৃতসর থেকে বোম্বে। মানুষ প্রদীপ জ্বেলেছিল, গেয়েছিল, পথের পাশে দাঁড়িয়ে ফুল দিয়েছিলো। রিপন কি তাহলে হিরো ছিলেন? হয়ত তাই! উপনিবেশের ধরণ পাল্টানোর হিরো। গ্লাডস্টোনের ভারত নীতির হিরো' যার বিদায়ের পরবর্তী কলোনিয়াল দিনগুলোতে আর কোনো তিতুমীর-শরীয়তুল্লাহ-দুদু মিয়ার জন্ম হয়নি। একজন ঐতিহাসিক বলেন: "ইংল্যান্ড-এর উপনিবেশ বিপদে পড়লে, সেখানে একজন রিপন পাঠালে তার চিন্তা থাকার কথা নয়" (এস. গোপাল: ১৯৫৬)।
এর পরের গল্প অনেক লম্বা। কর্ণওয়ালিশ ও রিপনের ভূমি নীতি আজও আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। ১৯৫০-এ জমিদারী অধিগ্রহণ হয়েছে। কিন্তু তা ছিলো ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে। সেই ক্ষতিপূরণের টাকা রাষ্ট্রকে দিতে হয়েছে। রাষ্ট্র সেই টাকা সাধারণ কৃষক থেকেই নিয়েছিলো। স্বাধীন দেশে সংসদে প্রণীত কোনো ভূমি আইন নেই। কতগুলো অধ্যাদেশ দিয়ে জমির মালিকানার সর্বোচ্চ পরিমাণ বারবার পরিবর্তন হয়েছে বটে, কিন্তু এখনো বাংলাদেশের ৫৩ ভাগ দরিদ্রদের দুই-তৃতিয়াংশ মানুষ ভূমিহীন দরিদ্র (বারকাত:২০০৪)। কৃষকদের মধ্যে এখনো ৮৬ লক্ষ ভাগ-চাষী। এখনো গ্রামের ১০ ভাগের দখলে ৮০ ভাগ কৃষি জমি। তাই কর্ণওয়ালিশ আর রিপন এখনো আমাদের দেশে বাস করেন। শুধু ভূমিতে নয়, ভূমিকায়, নামে নয়, আইনি মানসিকতায়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। পিএইচডি গবেষক, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি ওয়েলিংটন।
ইমেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১৪