ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

আইন ও আদালত

সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া

এস. এম. মাসুম বিল্লাহ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৫
সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া

আমি আইনের ছাত্র। কিন্তু আইনের ছাত্রকে কি গান ভালবাসতে নেই! আইন ও সঙ্গীত নিয়ে একসাথে কথা পাড়া বিপজ্জনক।

কারণ দুটি বিষয় দুই মেরুর। খানিক আতলেমির আভাসও পাওয়া যায় এতে।

কিন্তু আমরা যখন 'সোশ্যাল হারমনি' খুঁজছি, তখন এই স্বম্বন্ধের সম্ভাবনা গানের 'হারমোনি'য়াম-এ বাজিয়ে দেখা দরকার। আইনের তালবেলেমরা এর 'হার্মনীয়াস ইন্টারপ্রিটেশন' সম্পর্কে জেনে থাকবেন। সংঘাতপূর্ণ একাধিক স্বার্থের মধ্যে সর্বোচ্চ সমন্নয় করে আইনের একটা  ঐক্যতান সৃষ্টি করাই এই 'ইন্টারপ্রিটেশন' (আসলে দৃষ্টিভঙ্গি)-এর লক্ষ্য।

মিউজিক-এর বেলাতেও একটা 'ইন্টারপ্রিটেশন' আছে--তার নাম দিলাম, ধরা যাক--মিউজিক্যাল ইন্টারপ্রিটেশন। ভিন্নধর্মী ও দরের অনেক অর্থপূর্ণ শব্দকে কন্ঠস্বরের উঠানামা  ও কারুকাজের মাধ্যমে একটা সুরের ঐক্যতান ('তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে') সৃষ্টি করাই সঙ্গীতের উদ্দেশ্য। তাই এই ঐক্যতান-এর ওপর ভর করে আইন কে সাঙ্গীতিক ভাবে চেখে দেখলে ক্ষতি কি?!

তবে স্বীকার করি বিষয়টি নদীর জলে মায়ের হারিয়ে যাওয়া নাকের নোলক খোঁজার মতো।   

আমাদের সবচেয়ে বড় আইন সংবিধান। সেখানে সবচেয়ে বড় সঙ্গীত--জাতীয় সঙ্গীত--এর কথা বলা আছে।   অন্যদেশের সংবিধানে এমনটি তেমন চোখে পড়েনা। তাহলে জাতীয় সঙ্গীতের সাংবিধানিক আইনী ব্যাখ্যা কি হবে? আইনী ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় 'ভালোবেসে' 'স্নেহ-মায়া' দিয়ে এমন একটি দেশ গড়া, যেখানে স্বদেশের 'বদনখানি মলিন হলে 'নয়ন জলে ভাসবে', সুখের সময় 'প্রাণে বাঁশি' বাজবে। বিকিরিত মানবতাবাদ দিয়ে আমরা একসাথে সুর মেলাবো--'মরি হায়, হায়রে...'।

কিম্বা সংবিধানে যে লিখেছি আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা, তাহলে আমি এমন কোনো পরিবেশ বিরোধী কাজ করতে পারবনা যেটাতে পানিতে ফোটা শাপলার অবলুপ্তি ঘটে! তবেই না এন্ড্রু কিশোর গাইতে পারবেন: "স্বপ্ন আমার কাজল পুকুর তুমি হাজার শাপলা যেখানে ফুটেছে আজ"! আইন সঙ্গীতের সমর্থক, বৈরী তো নয়! প্লেটো বলেন: সঙ্গীত শিক্ষার চূড়ান্ত অর্থ হলো এমন পরিবেশ (এবং আবেশ) সৃষ্টি করা যেখানে সব মানুষ একই সুরে গাইবেন, গল্প করবেন, কথা বলবেন।

এতে করে একটা সামজিক আত্মা তৈরী হবে (কল্পনা করুন: ছবিতে বিয়ে বাড়ির দৃশ্যে প্রথমে নায়ক-নায়িকা তারপর একে একে সবাই সুরে ও ছন্দে যোগ দেন) । এমনি করে এই সুধা ছড়িয়ে পড়ে সবখানে......সবখানে ---সবখানে।

অন্যদিকে, একটা আদর্শ আইন ব্যবস্থার কাজ হলো দেশকে এমন একটা সরন্দীপ-এ পৌঁছে দেয়া --যার নাম ধরা যাক 'সোনার বাংলা' । কিম্বা 'নিতাইগঞ্জ' । কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে 'নিতাইগঞ্জ' যাব কিভাবে? মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা যদি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত-টার মানেও  ঠিকঠাক ধরতে পারতাম, তাহলে আমাদের রুখত কে?!
আইন ও সঙ্গীতের প্রধান মেলবন্ধন হলো--অভেদ কল্পনার ব্যবহার-মেটাফরিক্যাল ইউজ। অভেদ কল্পনার ব্যবহার আইনকে মানবিক করে, সঙ্গীতকে দরদপ্রবণ  বানায়। যেমন একটা লোকগানের কথা এরকম: "যেমন শিমুলের তুলা বাতাসে ওড়ে  গো, তুমি তেমনি উড়াও আমার প্রাণ"...অন্য একটা গানে আছে: " ওরে বোবায় যেমন স্বপনরে দেখে, মনের কথা মনে থাকে, কালা সেই দশা আমারও রে"....।

কিম্বা লালনের গানটা খেয়াল করুন: "চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করবো কি"!! (সন্তানসম্ভবা নারীর পেট পূর্ণ চাঁদের মতো, আর বাচ্চা ভ্রুণ ফালি চাঁদের মতো, তাই বলা হচ্ছে চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে)।

আইনেও মেটাফোর-এর ব্যবহার প্রচুর। বিচারপতি হাবিবুর রহমান সংবিধানের প্রস্তাবনাকে "দিকনির্দেশক তারকা" নামে আখ্যা দেন।   অথবা 'নদীর একুল-ভাঙ্গে ওকুল গড়ে এইতো নদীর খেলা' গানটিকে তিনি রসিকতা করে আমাদের সংবিধান ঘনঘন পরিবর্তন করার সাথে তুলনা করে কোথাও বলেছিলেন "সংবিধানের সিকস্তি-পয়স্তি" ! তেমনিভাবে, জজ সাহেবরা বলেন মৌলিক অধিকার যদি 'হৃদয়' হয়, তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হলো 'শরীর'।

 চুক্তি আইনে 'প্রস্তাবনা' ও 'গ্রহণ ' সংক্রান্ত উইলিয়াম এনসন-এর বলা রূপকটি এরকম: আগুন জ্বালাতে ম্যাচ-বক্সের সংস্পর্শে বারুদের কাঠি যেমন, চুক্তি করার ক্ষেত্রে প্রস্তাবনার পিঠে গ্রহণ করাটাও তেমন! স্বাক্ষ্য আইনে মেটাফরিক্যাল পান-এর ব্যবহার আমরা বাংলা ছবিতে প্রায়শ: দেখি।

আইনে চরিত্র অনেক। একজন লেখে (সংসদ), একজন  মিলায় (আইনজীবি), একজন রায় দেয় (জজ), একজন রায় বাস্তবায়নে সাহায্য করে (নির্বাহী)।

সঙ্গীতেও ব্যপারটি তাই। গীতিকার লেখেন, সুরকার সুর দেন, শিল্পী পরিবেশন করেন, যন্ত্রীরা পরিবেশনে সাহায্য করেন! প্রয়োগ ও পরিবেশন ছাড়া আইন ও সংগীতের কোনো দাম নেই!

আইন একদিক দিয়ে স্ফটিকীকৃত রাজনীতি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে রাখাও রাজনীতি, না রাখাও রাজনীতি! সংগীতে রাজনীতি নেই একথা বলা যাবেনা। বিপ্লবী রাজনৈতিক গান তো দেশ স্বাধীনের অস্ত্র: "মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি"।   কিম্বা রাজনীতিতে টিকে থাকার মন্ত্র: "জয় বাঙলা বলে আবার বাড়ো ..."।

আইনের আদি উৎস-- প্রথাগত আইনের জন্ম মানুষের অভ্যাসে। সমাজের ভেতরে। মানুষের চেতনায়। আইনবিজ্ঞানে যার নাম 'volksgiest'--'ফোক'স জিস্ট' বা মানুষের চেতনা (হেগেল: ১৮০১)। আর লোকগানের জন্মটাও মানুষের ভেতরে। শাহ আব্দুল করিম যখন বলেন: "গ্রামের নও-জোয়ান, হিন্দু-মুসলমান, মিলিয়া বাওলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা ...!" এতো সেক্যুলার লিগ্যাল ফিলোসফি! তাই আইনের পরিশুদ্ধায়ন করতে হলে মানুষের কাছে ফিরে যেতে হবে!

আইন ও সঙ্গীত এক অর্থে সমানভাবে পর্দানশীন। কারণ এদের লিখিত রূপ--টেক্সট--কেবলমাত্র কিছু মানুষ দেখতে পায়। তাই দীপ্ত আলো হয়ে এদের সৌন্দর্য ঠিকরে বেরুনোর কথা।   কিন্তু তা হলো কই ? এতো হয়ে যাচ্ছে অসহ্য সুন্দর বা অসুন্দর।

আইনেরও একটা সৌন্দর্য আছে, না কি? ভাষা শৈলী ও সৌকর্য আছে। সঙ্গীতের মুরীদেরা সেই সৌন্দর্য দেখতে পান। তাই কোনো জাতি সংগীত পিপাসু হলে তার আরো সহিষ্ণু হবার কথা, আইন মানার কথা, আইনের সৌন্দর্যে অবগাহন করার কথা। আফসোস হয়, যে জাতির রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল আছে, সে জাতি কেমন করে একে অপরকে জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দেয়? যেখানে একজন আগুনকে 'পরশমনি' করে, প্রাণে জ্বালিয়ে, জীবন 'পূণ্য' করার কথা বলেছেন, আরেকজন জাহান্নামের আগুনে বসে 'পুষ্পের হাসি' হাসতে চেয়েছেন?!

আসুন আইনের মানে যদি 'কি স্নেহ, কি মায়াগো' হয়, তাহলে আসুন আমরা সঙ্গীত দরদী হই। চারিদিকে গান হচ্ছে, সঙ্গীত হচ্ছেনা.....সব 'সঙ্গীত' যেন 'ইঙ্গিতে' থেমে গেছে। তবুও আমাদের 'নিতাইগঞ্জে' যেতে হবে। তাই বিহঙ্গের পাখা বন্ধ করলে চলবেনা। রবি ঠাকুর বলেন:
যদিও সন্ধ্যা নামিছে মন্দ মন্থরে
সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া
মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে
দিক দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা
তবু বিহঙ্গ ওরে বিহঙ্গ মোর
এখনি অন্ধ বন্ধ করোনা পাখা।
 
লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি ওয়েলিংটন। ইমেইল: [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।