ঢাকা: ‘ইকোনমিতে কে কী করেছেন, সেটা আদালতের বিবেচনার বিষয় নয়। দক্ষিণ কোরিয়ার হোন্ডা, যারা সারা পৃথিবীতে দেশকে পরিচিতি দিয়েছিল।
ফাঁসির রায়ের পুনর্বিবেচনা চেয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর রিভিউ আবেদনের শুনানিতে রোববার (২৮ আগস্ট) শুনানিতে আইনজীবী তার ‘সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবদানের’ কথা উল্লেখ করলে এ মন্তব্য করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
রিভিউ শুনানির এক পর্যায়ে মীর কাসেম আলীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য তিনি (মীর কাসেম) ইবনে সিনা ও ইসলামি ব্যাংক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। এছাড়া অর্থনীতিতেও তিনি অবদান রেখেছেন। তিনি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় ছিলেন’।
এ সময় আদালত বলেন, ‘ইকোনমিতে কে কি করেছেন, সেটা আদালতের বিবেচনার বিষয় নয়। একটা উদাহরণ দেবো, দক্ষিণ কোরিয়ার হোন্ডা, যারা সারা পৃথিবীতে দেশকে পরিচিতি দিয়েছিল। তার চেয়ারম্যানের কিন্তু ৩ বছরের সাজা হয়। সুতরাং অর্থনীতির অবদান আমরা দেখবো না’।
মীর কাসেমের ওই রিভিউ আবেদনের আদেশের দিন আগামী মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) ধার্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চে এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। অন্য বিচারপতিরা হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও মোহাম্মদ বজলুর রহমান।
শুনানি শেষে আদালত থেকে বের হওয়ার পরও খন্দকার মাহবুব সাংবাদিকদের বলেন, ‘মীর কাসেম আলী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। সেবার ক্ষেত্রে ইবনে সিনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন হাসপাতাল করেছেন। একইভাবে গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত থেকে তিনি টিভির কর্মকর্তা ছিলেন। তার সামাজিক কর্মকাণ্ড ছিল’।
‘এই আসামির মনে যদি বিন্দুমাত্র কোনো আশঙ্কা থাকতো, তাহলে এই মামলার যখন তদন্ত চলছিলো, তিনি বিদেশে গিয়েছেন, বিদেশ থেকে ফিরেও এসেছেন’।
শুনানিতে খন্দকার মাহবুব আরও বলেন, ‘সাক্ষীদের বক্তব্য অনুসারে তাকে সর্বোচ্চ দণ্ড দেওয়ার কোনো সুযোগ নাই। সেখানে বলা হয়েছে, ডালিম হোটেলে তিনি অনেকের মধ্যে একজন ছিলেন। অনেকের মধ্যে একজন হলে তাকে প্রিন্সিপাল অফেন্ডার বলা যায় না। সেক্ষেত্রে কিভাবে তাকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া যেতে পারে? জসীমকে (কিশোর মুক্তিযোদ্ধা) কোথায় হত্যা করা হয়েছে, চাক্ষুস সাক্ষীদের বক্তব্যে সেটা কোথাও নেই। তাহলে কিভাবে এ হত্যার জন্য তাকে ফাঁসি দেওয়া যেতে পারে?’
এ সময় আদালত বলেন, ‘ডালিম হোটেল ওয়াজ দ্য কিলিং সেন্টার, টর্চার সেন্টার। ১৯৭১ সালে রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ড সেনাবাহিনীর হাতে থাকলেও ডালিম হোটেলের বিষয়টা ভিন্ন ছিল। মীর কাসেম আলী এ সেন্টারের কমান্ডার ছিলেন। চট্টগ্রামের গুডস হিলেও সেনাবাহিনীর কমান্ড ছিল না। একটা (অভিযোগ) ছাড়া অন্যগুলোতে সেনাবাহিনী ছিল না’।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। পরে তিনি সাক্ষীদের বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আসামিপক্ষ বলেছেন, একটি চার্জের জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। অথচ তিনি (মীর কাসেম) যে মুক্তিযোদ্ধা জসীমকে হত্যা করেছেন, এর কোনো চাক্ষুষ সাক্ষী নাই। আমি আদালতকে দেখিয়েছি, জসীম যে ডালিম হোটেলে বন্দি অবস্থায় ছিলেন, এটা প্রমাণিত। মীর কাসেম আলীর যে সেখানে সব নিয়ন্ত্রণ ছিলো, জসীমকে যখন নির্যাতন করে ফেলে দেওয়া হয়, তখনও সেখানে মীর কাসেম ছিলেন- তা শফিউল আলম ২ নম্বর সাক্ষীকে বলেছেন। অন্য কয়েকজন সাক্ষী মীর কাসেমের উপস্থিতি ও অত্যাচার এবং জসীমকে ফেলে দেওয়া, সেই সময়ে তার উপস্থিতির বিষয়ে সাক্ষ্যে বলেছেন’।
তিনি আরও বলেন, ‘সাক্ষী নাই বলে আসামিপক্ষের বক্তব্য ঠিক না। কারণ, মীর কাসেম যে ডালিম হোটেলের হর্তা-কর্তা ছিলেন, জসীম ওখানে মারা গেছে, তা তারা নিজেরাই অস্বীকার করেন নাই। যারা অত্যাচারিত হয়েছেন, প্রত্যেকেই মীর কাসেম আলীর কথা বলেছেন। ১২ নম্বর চার্জেও মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড হতো, যদি প্রসিকিউশন ঠিকমতো মামলাটি পরিচালনা করতেন’।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে গত ০৮ মার্চ মীর কাসেম আলীর মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার সংক্ষিপ্ত আকারে চূড়ান্ত রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। রায়ে শহীদ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনসহ ছয়জনকে হত্যা-গণহত্যার দায়ে ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল রাখা হয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা মীর কাসেম আলীর।
গত ০৬ জুন ২৪৪ পৃষ্ঠার পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন আপিল বিভাগ। গত ১৯ জুন ৬৮ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদন করেন মীর কাসেম আলী। এতে ফাঁসির রায় বাতিল করে খালাস ও অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আরজি জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে আলবদর বাহিনীর তৃতীয় এই শীর্ষনেতা।
রিভিউ আবেদনে সর্বোচ্চ সাজার বিরুদ্ধে মোট ১৪টি যুক্তি দেখানো হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০১৬
ইএস/এএসআর