ঢাকা: মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলজুড়ে নানা মাত্রায় নানা ধরনের নৃশংসতম মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। চট্টগ্রামে গড়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বিরোধিতাকারী জামায়াতের কিলিং স্কোয়ার্ড আলবদর বাহিনী, পরে হয়েছেন এ বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষনেতা।
তিনি মীর কাসেম আলী।
চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও বাঙালিদের নির্যাতনের বীভৎস পৈশাচিকতায় মেতে উঠেছিলেন তিনি। এ নৃশংসতার মাত্রা এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে তাকে সে সময় থেকেই ডাকা হয় ‘বাঙালি খান’ নামে। ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খানদের যোগ্য এই দোসর এ নামেই কুখ্যাত।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। হত্যা ও নির্যাতনে পারদর্শিতার পুরস্কার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তাকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। তখন মীর কাসেম আলী এ বাহিনীর তিন নম্বর ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পান। এ সময় আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সভাপতি মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি কার্যকর হওয়া মতিউর রহমান নিজামী। দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সভাপতি ফাঁসি কার্যকর হওয়া আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।
একাত্তরের সেই ঘাতক, চট্টগ্রাম তথা সারা দেশে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধানতম সহযোগী এবং শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলী এখন ফাঁসির দড়ির মুখোমুখি। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) তার ফাঁসি বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ফাঁসির রায়ের পুনর্বিবেচনা চেয়ে তার রিভিউ আবেদন সর্বোচ্চ আদালত খারিজ করে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রায় কার্যকরের বিষয়টিও চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছেছে। সর্বশেষ ধাপে এখন কেবলমাত্র অপরাধ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারবেন তিনি। প্রাণভিক্ষা না চাইলে বা চাওয়ার পর নাকচ হলে আইন অনুসারে তখন সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যেকোনো সময় ফাঁসির রায় কার্যকর করবে কারা কর্তৃপক্ষ।
দেশের এই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হচ্ছে চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলের নির্যাতনকেন্দ্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শহীদ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনকে হত্যার দায়ে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে মীর কাসেম আলী নগরীর নন্দন কানন টিঅ্যান্ডটি অফিসের পেছনে হিন্দু মালিকানাধীন ‘মহামায়া ভবন’ দখল করে নেন। ভবনটি আলবদর বাহিনী নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর এর নামকরণ করা হয় ‘ডালিম হোটেল’।
কথিত এ ডালিম হোটেলে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন বাঙালিকে ধরে এনে রড ও বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হত। হোটেলে নির্যাতনের শিকার লোকজন যখন পানি চাইতেন তখন রাজাকাররা প্রস্রাব করে তা পান করতে দিতো। যখন তারা প্রস্রাব পান করতে চাইতেন না, তখন নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে প্রস্রাব পান করতে বাধ্য করতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন পরও ডালিম হোটেলের আশ-পাশের এলাকায় অসংখ্য মরদেহ পড়েছিল।
শুধু ডালিম হোটেলই নয়, আছদগঞ্জের দোস্ত মোহাম্মদ পাঞ্জাবির বিল্ডিংস্থ চামড়ার গুদাম, পাচলাইশ থানার সালমা মঞ্জিল, মদিনা হোটেল ও প্রবর্তক মোড়ে আরও চারটি নির্যাতনকেন্দ্র গড়ে তোলেন মীর কাসেম। স্বাধীনতাকামীদের নির্যাতনের জন্য গড়া এ পাঁচটি নির্যাতনকেন্দ্রের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয় ডালিম হোটেলে।
মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে এবং নিয়ন্ত্রণে ডালিম হোটেলের নির্যাতন কেন্দ্র পরিণত হয় জল্লাদখানায়। আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম আলবদর বাহিনীর প্রধান ও কমান্ডার মীর কাসেম আলীকে ভিকটিমদের সামনে কখনও ‘কমান্ডার’ আবার কখনও ‘কমান্ডার খান’ আবার কখনো ‘বাঙালি খান’ নামে ডাকতো। ডালিম হোটেলের নির্যাতন কেন্দ্রে কাসেমের নেতৃত্বেই অমানবিক নির্যাতনে হত্যা করা হয় কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সন্দ্বীপের জসিম, রঞ্জিত দাস লাতু, টুন্টু সেন এবং আরও পাঁচজনকে।
মীর কাসেম আলী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রামে বাঙালি কিলিং স্কোয়াডের প্রধান হিসেবেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ জন্য সহযোগী যুদ্ধাপরাধীরা তাকে ‘টর্চার আইডল’ নামেও ডাকতেন।
নিউজের বাকি অংশ পড়তে ক্লিক করুন- নরকে পরিণত করেন ‘ডালিম হোটেল’