ঢাকা: ‘প্রকাশ্য দিবালোকে জনসভাস্থলে সংঘটিত এই আক্রমণ পরিচালনায় অভিযুক্তরা কোনো মুখাবরণও (মাস্ক) ব্যবহার করেনি। এটি অভ্রান্ত ভাবে ইঙ্গিত করে যে, অপরাধ সংঘটনকারী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কোনো ভয় বা শঙ্কা তাদের ছিল না’।
টঙ্গীর জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ে এমন কথা বলেছেন হাইকোর্ট।
গত ১৫ জুন আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল মামলার রায় দেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
বুধবার (০৭ সেপ্টেম্বর) সকালে ওয়েবসাইটে ১৮২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
রায়ে হাইকোর্ট বলেন, ‘অপরাধ সংঘটনের ধরন, স্থান ও সময় এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা দ্বিধাহীনভাবে এই ইঙ্গিত দেয় যে, তারা (আসামিরা) নিশ্চিত ছিল যে, চিহ্নিত হলেও দলীয় সুরক্ষায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় তারা আইনের বাইরেই থেকে যাবে। তাদের এ আচরণ প্রমাণ করে যে, তারা কতোটা বেপরোয়া ও সহিংস ছিল। চরম বেপরোয়া উশৃঙ্খল রাজনৈতিক দুর্বত্তরাই কেবল এ ধরনের শক্তির ধারণ ও চর্চা করতে পারে’।
‘প্রতিটি হত্যাকাণ্ডই অমানবিক যা সমাজে ক্ষত সৃষ্টি করে, জনমানুষের নিরাপত্তাবোধে চরম আঘাত হানে। সুসংগঠিত আক্রমণের ফলশ্রুতিতে সংঘটিত যে হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে এই ডেথ রেফারেন্স আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে জঘন্যতম ও কাপুরুষোচিত ঘটনা। এই নির্মম ঘটনা কেবল ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের প্রাণ কেড়ে নেয়নি, রক্তাক্ত করেছে সভ্য সমাজকে, মানুষের সুস্থ চেতনাকে, মানবতাকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের পৈশাচিক সুসংগঠিত হত্যাকাণ্ড অতীতে খুব কমই সংঘটিত হয়েছে। এ ঘটনায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের স্পষ্ট চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে’ বলেও রায়ে উল্লেখ করেন হাইকোর্ট।
আদালত আরও বলেন, ‘টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ স্কুল প্রাঙ্গনে অসংখ্য জনমানুষের উপস্থিতিতে পরিচালিত সুসংগঠিত আক্রমণের মাধ্যমে যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয় তা থেকে এটি সম্যক উপলব্ধি করা যায় যে, রাজনীতিতে দুর্বত্তায়ন কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে’।
হাইকোর্টের রায়ে আরও বলা হয়, ‘উদ্বিগ্নতার সঙ্গে লক্ষ্য করা যায় যে, আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ প্রকৃতির বর্বর উশৃঙ্খলতার অপচর্চাকারী দলীয় কর্মীদের পরিহার করার প্রবণতা দেখা যায় না। বরং, অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলগুলো এই প্রকৃতির উশৃঙ্খল কর্মীদের ওপরই নির্ভরশীল যা কি-না দেশে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চার পথে এক বিরাট অন্তরায়। এরুপ রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত থাকলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা দেখা দেবে। সামাজিক সুরক্ষা হুমকির মুখে পড়বে। মুখ থুবড়ে পড়বে জনমানুষের প্রত্যাশিত গণতন্ত্র’।
‘এ মামলায় শুধু বর্বর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রতিফলিত হয়নি, রাজনীতি কিভাবে দুর্বত্তায়িত হয়েছে এবং এমন দুর্বৃত্তায়ন কিভাবে অপরাধ সংঘটনকারীদের শক্তি ও সাহস জোগায় সেটিও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। অথচ এটি অস্বীকার করা যায় না যে, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন দেশকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ধ্বংস করে দেয়। গণতন্ত্রের লক্ষ্যই হলো জনকল্যাণ ও মানবাধিকার নিশ্চিত করা। আর সুস্থ গণতন্ত্র আসে কেবল সুস্থ রাজনৈতিক ধারা ও চর্চার পথ ধরে, কোনোভাবেই এর দুর্বৃত্তায়নের পথ ধরে নয়’।
আদালত রায়ে বলেন, ‘দেশ যখন ক্রমেই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সকলেরই যখন নিবিষ্ট হওয়া উচিত, সেই সময়ে রাজনীতিতে এ ধরনের দুর্বৃত্তায়ন কোনোভাবেই কাঙ্খিত নয়। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি দেশকে ধ্বংস ছাড়া অন্য কোনো গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারে না’।
‘আহসান উল্লাহ মাস্টার বেঁচে থাকলে আইন সভায় অবদান রাখার মাধ্যমে জনকল্যাণে নিবেদিত হওয়ার আরো সুযোগ পেতেন, করতে পারতেন আরো অনেক সুকর্ম। সমাজ ও জাতি হতে পারতো আরো উপকৃত । সাজাপ্রাপ্ত অভিযুক্তরা আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যার মধ্য দিয়ে সমাজ, জাতি ও এলাকার মানুষকে সমৃদ্ধির পথে হাঁটার সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। ব্যক্তিকে হত্যার পাশাপাশি হত্যা করা হয়েছে আদর্শকে, নৈতিক উদ্যমকে। আজকের সমাজে আহসান উল্লাহ মাস্টারের মতো আদর্শবান রাজনীতিকের বড়ই অভাব’।
রায়ে ১১ জনকে খালাস এবং বিচারিক আদালতের দেওয়া বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারসহ অন্য ছয়জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন উচ্চ আদালত। বিচারিক আদালতে দণ্ড পাওয়া জীবিত ২৬ আসামির মধ্যে ৮ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। আগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত একজন পলাতক থাকায় তার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি আদালত।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৬
ইএস/এএসআর