তবে এ রায়ে কিছুটা সন্তুষ্ট আসামিপক্ষ। এর বিরুদ্ধে আপিলেরও ঘোষণা দিয়েছেন ঐশীর আইনজীবী সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী।
আবার রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করবেন কি-না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অপেক্ষা করবেন পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে আসা পর্যন্ত বলে জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির।
সোমবার (০৫ জুন) বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ ঐশী রহমানের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ে বাবা-মাকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে ঐশী রহমানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। একইসঙ্গে জরিমানা ২০ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ৫ হাজার টাকা করা হয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেন, ‘আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদণ্ডকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে মৃত্যুদণ্ড কমানোর কোনো গাইডলাইন নেই। এমনকি তা বিলুপ্ত করার পরিবেশ আসেনি। শিক্ষার হার বেড়েছে। জনসংখ্যাও বেড়েছে। ফলে অপরাধ প্রবণতাও বাড়ছে। এ অবস্থায় মৃত্যুদণ্ড রহিত করা যুক্তিসঙ্গত নয়’।
‘মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নয়। এটি কার্যকর করলেই যে সমাজ থেকে অপরাধ দূর হয়ে যাবে, তা নয়। কম সাজাও অনেক সময় সমাজ থেকে অপরাধ কমাতে সুস্পষ্টভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বা সাহায্য করে’।
রায়ে আদালত বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ড রহিত করতে সমাজের প্রতিটি স্তরে সুশাসন ও মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শুধু রাষ্ট্রের মধ্যে নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে’।
বিচারিক আদালতে ঐশীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিষয়ে হাইকোর্ট বলেন, ‘নিম্ন আদালত সামাজিক অবক্ষয় বিবেচনায় নিয়ে কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে এ রায় দিয়েছেন। যেখানে বলা হয়েছে, একটি মেয়ে তার বাবা-মাকে নিজের হাতে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার সাহস দেখিয়েছেন। কিন্তু সাজা নির্ধারণ ও বিচারের ক্ষেত্রে এ ধরনের আবেগ প্রদর্শনের সুযোগ নেই। আদালত আইনগত তথ্যাদি ও প্রমাণাদি বিবেচনায় নেবেন। যেখানে একজন নারী হিসেবে ১৯ বছর বয়সে এ ধরনের অপরাধ করেছেন’।
ঐশীকে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই দেওয়ার ৫টি কারণ উল্লেখ করে হাইকোর্ট বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জোড়া খুনের ঘটনা ঘটিয়েছেন সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়া এবং মানসিকভাবে বিচ্যুতির কারণেই। এ আসামি অ্যাজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত’।
‘বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদন অনুসারে তার দাদি ও মামা অনেক আগে থেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। তার পরিবারে মানসিক বিপর্যস্ততার ইতিহাস রয়েছে’।
‘ঘটনার সময় তার বয়স ছিল ১৯ বছর। তিনি এ ঘটনার সময় সাবালকত্ব পাওয়ার মুহূর্তে ছিলেন’।
‘তার (ঐশী) বিরুদ্ধে অতীতে ফৌজদারি অপরাধের নজির নেই’।
‘ঘটনার দু’দিন পরই স্বেচ্ছায় থানায় আত্মসমর্পণ করেন তিনি’।
উদ্ভূত পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সাজা কমানো হয় বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়।
হাইকোর্ট আরও বলেন, ‘তার বাবা পুলিশে ও মা ডেসটিনিতে চাকরিরত এবং জীবন-জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ঐশীকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেননি। তারা যখন উপলব্ধি করছিলেন, ঠিক সে সময় তার জীবন আসক্তিতে ও উচ্ছন্নে চলে গেছে’।
রায়ে বলা হয়, ‘তবে সন্তানদের জন্য বাবা-মা ও অভিভাবকই হলেন প্রাথমিক শিক্ষক। এটি হিসেবে তাদের জন্য ভালো পরিবেশ ও সময় দেওয়া প্রয়োজন’।
রায়ের পরে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির সাংবাদিকদের বলেন, উচ্চ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ ৩০২ ধারায় ঐশীর অপরাধ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং আদালত ৩০২ ধারার দণ্ডটিকে বহাল রেখেছেন। তবে আদালত ঐশীর বাস্তব ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন দিয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে- এ রায়ের বিরুদ্ধে আপলি করা হবে কি-না।
২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট রাজধানীর মালিবাগের চামেলীবাগে নিজেদের বাসা থেকে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (পলিটিক্যাল শাখা) ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় করা মামলায় ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর নিহতদের একমাত্র মেয়ে ঐশী রহমানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন বিচারিক আদালত। পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক বছরের কারাদণ্ড দেন।
মামলার অন্য আসামি ঐশীর বন্ধু মিজানুর রহমান রনিকে খুনের ঘটনার পর ঐশীদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে দু’বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও একমাস কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অপর আসামি ঐশীর বন্ধু আসাদুজ্জামান জনিকে খালাস দেন আদালত।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, জুন ০৫, ২০১৭
ইএস/এএসআর