৫ আসামির মধ্যে অন্যজন পলাতক সেলিম চৌধুরী ওরফে সেলিম আহমেদকে হাইকোর্টের মতোই সর্বোচ্চ আদালত থেকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।
দু’দফা শুনানি নেওয়ার পর বুধবার (০১ নভেম্বর) হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের মোট চারটি আপিলের চূড়ান্ত এ রায় দেন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার নেতৃত্বে তিন বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাইফুল বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার মধ্য খোন্তাকাটা গ্রামের মৃত আব্দুল মোতালেব হাওলাদারের ছেলে। যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আল আমিন পটুয়াখালীর হাজিখালী গ্রামের ফারুক ঘরামীর ছেলে, লালু শরিয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার গোয়ালকোয়া গ্রামের আব্দুল জলিলের ছেলে এবং খোকন ময়মনসিংহ নগরের নাটকঘর বাইলেনের আব্দুস সালামের ছেলে। খালাসপ্রাপ্ত সেলিম ভোলার শশীভূষণ থানার উত্তর চরমঙ্গল গ্রামের সিদ্দিক আহমেদ চৌধুরীর ছেলে।
এ মামলায় পাঁচ আসামিকেই মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন বিচারিক আদালত। আর হাইকোর্ট তাদের মধ্যে সাইফুলের মৃত্যুদণ্ড বহাল, আল আমিন, লালু ও খোকনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সেলিমকে খালাস দেন।
এর আগে গত ১০ অক্টোবর ধার্য দিনে রায় না দিয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাইফুলের পক্ষে পুনরায় শুনানির আদেশ দেন আপিল বিভাগ।
সেদিন অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড মাহমুদা বেগম জানিয়েছিলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাইফুলের পক্ষে আগে আইনজীবী নিয়োগ করা হয়নি। এখন তার পক্ষে একজন আইনজীবী নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপর সর্বোচ্চ আদালত পুনঃশুনানির সিদ্ধান্ত জানান।
এর প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) পুনঃশুনানি শেষে বুধবার রায়ের দিন ধার্য করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার নেতৃত্বে তিন বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাইফুলের পক্ষে পুনঃশুনানি করেন আইনজীবী সিকদার মকবুল হক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
অ্যাটর্নি জেনারেল পরে বলেন, ‘আমরা অন্তত তিনজনের মৃত্যুদণ্ড ও খালাসপ্রাপ্ত আসামির কারাদণ্ড চেয়েছিলাম। রাষ্ট্রপক্ষে তিনটি ও আসামিপক্ষে একটি আপিল হয়েছিল। আদালত সবগুলোই খারিজ করে দিয়েছেন। সরকার চাইলে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন জানাবো। তবে রিভিউ আবেদন করে কোনো লাভ হবে না’।
সাইফুলের আইনজীবী সিকদার মকবুল হক বলেন, ‘আদালতকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। আদালত রায় বহাল রেখেছেন। আমার মক্কেল যদি বলেন, তাহলে রিভিউয়ের আবেদন জানাবো’।
২০১২ সালের ০৫ মার্চ রাত ০১টার দিকে রাজধানীর গুলশান কূটনৈতিক এলাকার ১২০ নম্বর সড়কের ১৯/বি নম্বর বাসার সামনে গুলিবিদ্ধ হন খালাফ আল আলী (৪৫)। ০৬ মার্চ ভোরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
ওই বছরের ০৪ জুন দক্ষিণখান থানার গাওয়াইর এলাকা থেকে চার ছিনতাইকারী সাইফুল, লালু, আল আমিন ও খোকনকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশের ডাকাতি, দস্যুতা ও ছিনতাই প্রতিরোধ টিম।
এ সময় তাদের কাছ থেকে কালো রঙের একটি বিদেশি পয়েন্ট ২২ বোরের রিভলবার জব্দ করা হয়। অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে ওইদিনই তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা দায়ের করা হয়।
আসামি সাইফুল ও আল আমিন আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে স্বীকার করেন যে, ০৫ মার্চ দিবাগত রাতে ছিনতাই করতে বাধা দেওয়ায় তারা চারজনসহ পলাতক সহযোগী সেলিম খালাফ আল আলীকে এ অস্ত্র দিয়ে গুলি করে হত্যা করেন।
তবে আল আমিন তার জবানবন্দিতে সাইফুল গুলি করেন বলে উল্লেখ করেন। তিনি জানান, সাইফুলসহ বাকি চারজন ওই রাতে খালাফকে ঘিরে ধরেন এবং তার কাছে ডলার চান। ডলার না দেওয়ায় তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। পরে সাইফুল তার হাতে থাকা রিভলবার দিয়ে খালাফকে গুলি করে পালিয়ে যান।
পরে সাইফুল, আল আমিন, লালু ও খোকনকে খালাফ হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখায় (শ্যো’ন অ্যারেস্ট) পুলিশ।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার মো. ওবায়দুল হক ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ওই চারজনসহ পলাতক সেলিমকে আসামি করে এ মামলায় অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন।
একই বছরের ৩১ অক্টোবর পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করে এ মামলার বিচার শুরু করেন ঢাকার ৪ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মোতাহার হোসেন।
রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলায় মোট ৩৩ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন।
গ্রেফতারকৃত চার আসামি ৩৪২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজেদের নির্দোষ দাবি এবং ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন।
উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন শেষে ২০১২ সালের ৩০ ডিসেম্বর খালাফ আল আলীকে হত্যার দায়ে ৫ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।
রায়ের পর কারাগারে থাকা আসামিরা হাইকোর্টে জেল আপিল ও জামিনের আবেদন জানান। অন্যদিকে বিচারিক আদালত থেকে ডেথ রেফারেন্স আসে এবং কারা কর্তৃপক্ষ নিয়ম অনুসারে দণ্ড কার্যকর করতে হাইকোর্টের অনুমতি চান।
২০১৩ সালের ০১ আগস্ট থেকে ডেথ রেফারেন্স ও সবগুলো জেল আপিলের শুনানি একসঙ্গে শুরু হয়ে ০৩ নভেম্বর শেষ হয় বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের হাইকোর্ট বেঞ্চে।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. খোরশেদুল ইসলাম।
অন্যদিকে কারাগারে থাকা চার আসামির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খবীর উদ্দিন ভূঁইয়া ও আমিনুর রশিদ রাজু। পলাতক আসামি সেলিমের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মাহমুদা খাতুন।
২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর আসামি সাইফুলকে বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন হাইকোর্ট। মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত অন্য তিনজন আল আমিন, লালু ও খোকনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন এবং পলাতক সেলিমকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। ২০১৪ সালের ২৩ জুলাই আপিলটি মঞ্জুর করেন আপিল বিভাগ।
বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের দুই নম্বর বেঞ্চে গত ০৯ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের এ আপিলের শুনানি শুরু হয়। ২০ আগস্ট উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের দিন ১০ অক্টোবর ধার্য করেছিলেন সর্বোচ্চ আদালত।
আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হেলাল উদ্দিন মোল্লা। রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিত দেবনাথ।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১৭
ইএস/জেডএস/এএসআর