ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

ঋণ কেলেঙ্কারি: প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিল সোনালী ব্যাংক

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৯
ঋণ কেলেঙ্কারি: প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিল সোনালী ব্যাংক

ঢাকা: ১৮ কোটি ৪৭ লাখ ২০ হাজার টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় আট কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থার কথা জানালো সোনালী ব্যাংক। এ ঘটনায় পাটকল শ্রমিক জাহালমকে জড়ানো হয়েছিলো।

এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের করা এক প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য জানা গেছে। আর ওই প্রতিবেদনযুক্ত করে হাইকোর্টে হলফনামা করেছে সোনালী ব্যাংক।

এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান শনিবার (২৪ আগস্ট) বাংলানিউজকে জানান, গত ২২ আগস্ট বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে সোনালী ব্যাংকের হলফনামা আকারে এ প্রতিবেদনটি পেয়েছি। যেখানে ওনাদের তদন্তে ৮ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার কথা বলা আছে। তাই তারা ‘এ ঘটনায় দায় এড়াতে পারে না’ মর্মে আদালতের কাছে এমন বক্তব্য তুলে ধরবো। আগামী বুধবার (২৮) এ বিষয়ে শুনানির জন্য দিন ধার্য আছে।

তবে সোনালী ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার শেখ মো. জাকির হোসেন বলেন, আমাদের (সোনালী ব্যাংক) ১৮ কোটি ৪৭ লাখ ২০ হাজার টাকা আত্মসাতের ঘটনায় আমরা ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। এরসঙ্গে জাহালমের গ্রেফতারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কারণ জাহালম গ্রেফতার হয়েছিলেন ২০১৬ সালে। আর ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় সোনালী ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়েছিল ২০১১ কিংবা ২০১২ সালের দিকে। সুতরাং জাহালম গ্রেফতার কিংবা জেলা খাটার সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের দায় নেই।

গত ২১ আগস্ট পাটকল শ্রমিক জাহালমকে আসামি করে ঋণ জালিয়াতির মামলার ১১ তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করেছে বলে হাইকোর্টকে জানায় দুদক। এরপর আদালত কর্মকর্তাদের তালিকা চেয়ে কী কারণে ওইসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে তা ২৮ আগস্ট জানাতে নির্দেশ দেন।

এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের করা হলফনামায় তারা তাদের একটি তদন্ত প্রতিবেদন যুক্ত করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সংঘটিত জালিয়াতির ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকা/দায়িত্ব অবহেলার জন্য মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট শাখা ও স্থানীয় কার্যালয় ঢাকার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন তারিখে অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণী জারি করা হয়। জারিকৃত চার্জশিট নিষ্পত্তিপূর্বক সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।  

১৭ কোটি ৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যাংক হিসাবটি খোলার ক্ষেত্রে যথাযথভাবে পরিচিতি গ্রহণ করা হয়নি। এছাড়া সার্বিক তত্ত্বাবধানে অবহেলার জন্য সোনালী ব্যাংকের মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট শাখার প্রাক্তন শাখা ব্যবস্থাপক আজিজুল হকের বেতন বৃদ্ধি এক বছরের জন্য স্থগিত করা হয়। ২০১২ সালের ৯ মে এ সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। পরে ২০১৩ সালে পর্ষদের ৩১৪তম সভায় তাকে শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

অস্তিত্বহীন মোবাইল মেলা নামের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ১ কোটি ৩৭ হাজার ৮০ হাজার টাকার জালিয়াতি হয়েছে। এ ব্যাংক হিসাবটি খোলার ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ না করায় এবং ক্লিয়ারিং সংক্রান্ত কাজে অননুমোদিত ব্যক্তির  সম্পৃক্ততারোধে ব্যর্থতা ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট শাখার প্রাক্তন শাখা ব্যবস্থাপক আখলাফুন নাহারকে একটি বেতন বৃদ্ধি এক বছরের জন্য স্থগিত করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ২৮৩তম সভায় এ শাস্তি থেকে তাকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়।

হিসাবের লেনদেনের প্রবণতা লক্ষ্য না করে এবং চেকের ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে ৫টি চেক বই ইস্যু করা হয়েছিল; যা ৯৬টি জালিয়াতিতে ব্যবহার করা হয়। এ অভিযোগে ব্যাংকটির মিরপুর ক্যান্টমেন্ট শাখার প্রাক্তন সিনিয়র অফিসার নিজাম উদ্দিনকে এক বছরের জন্য নিম্নস্তরের মাসিক বেতন দেওয়া হয়। শাস্তির মেয়াদকালে তার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বন্ধ রাখা হয়। অবশ্য শাস্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এই কর্মকর্তা মূল বেতনও পান।

অননুমোদিত ভাউচার আনা-নেওয়া, কম্পিউটার প্রিন্ট ও ভাউচার পরিবর্তন করা ও হিসাব খোলায় সহযোগিতা, ভূয়া/জাল স্বাক্ষর এবং স্ট্যাম্প ব্যবহার করার দায়ে ক্যান্টনমেন্ট শাখার সাপোর্টিং সাব স্টাফ মো. মাইনুল হককে ২০১৪ সালে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি ও অর্থপাচারের মামলা হয়। মামলাগুলো বিচারাধীন।

মো. মাইনুল হককে প্রধান কার‌্যালয় থেকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করার দায়ে ২০১৪ সালে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কার‌্যালয়ের সাপোর্টিং সাব স্টাফ মো. মিজানুর রহমানের বার্ষিক দু’টি প্রবৃদ্ধি দুই বছরের জন্য স্থগিত রাখা হয়।

অননুমোদিত ক্লিয়ারিং ভাউচার লেখা ও মাইনুল হককে সহযোগিতা করার দায়ে ২০১৪ সালে স্থানীয় কার‌্যালয়ের সাপোর্টিং সাব স্টাফ আজিজুল হককে কঠোরভাবে সতর্ক করে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে চাকরিতে পুর্নবহাল করা হয়।

শাখা থেকে ফেরত আসা নিকাশ ঘরের লাল ভাউচার টিআরএ নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষা না করা ও সার্বিক ক্লিয়ারিং সংক্রান্ত কার্যাবলী তদারকিতে অবহেলার কারণে ২০১৪ সালে স্থানীয় কার‌্যালয়ের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মো. লুৎফর রহমানকে তিরস্কার করা হয়।

এছাড়া শাখা থেকে ক্লিয়ারিং ভাউচারের স্বাক্ষর যাচাই না করে ভাউচার পাস করে দায়িত্বে অবহেলার কারণে ২০১৪ সালে স্থানীয় কার‌্যালয়ের নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহতাব উদ্দিনের বার্ষিক এক বছরের জন্য স্থগিত করা হয়।

গত ১৭ এপ্রিল জাহালমকাণ্ডে কে বা কারা দায়ী তা দেখার জন্য এ বিষয়ে দুদকের প্রতিবেদন চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। সে অনুসারে দুদকের পরিচালক (লিগ্যাল) এবং এ সংক্রান্ত দুদকের তদন্ত কমিটির প্রধান আবুল হাসনাত মো. আব্দুল ওয়াদুদের দেওয়া প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়।

আবুল হাসনাত মো. আব্দুল ওয়াদুদ প্রতিবেদনে বলেন, ‘সার্বিক বিবেচনায় আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, জাহালমকে আবু সালেকরূপে চিহ্নিত করার যে ভুলটি হয়েছে তা দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কারণেই ঘটেছে। আর তাদের ভুল পথে চালিত করতে সহায়তা করেছে ব্র্যাক ব্যাংক ও অন্য ব্যাংকের কর্মকর্তারা এবং অ্যাকাউন্টের ভুয়া ব্যক্তিকে পরিচয়দানকারীরা। তবে সঠিক ঘটনা তথা সত্য উদঘাটন করে আদালতের কাছে তা উপস্থাপন করাটাই তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব। ’ 

পরে এমন প্রতিবেদনের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কী সিদ্ধান্ত নেবেন তা দেখতে চেয়েছিলেন হাইকোর্ট।

একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিষয়েও জানতে চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। সে অনুসারে সোনালী ব্যাংক এ হলফনামা করে।

গত জানুয়ারিতে একটি জাতীয় দৈনিকে ৩৩ মামলায় ‘ভুল’ আসামি জেলে ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না...’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত।

এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা, মামলার বাদীসহ চারজনকে তলব করেন হাইকোর্ট বেঞ্চ। এছাড়া রুলও জারি করেন আদালত।

পরে ৩ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্টরা হাজিরের পর হাইকোর্ট জাহালমকে মুক্তির নির্দেশ দেন এবং দুদকের কাছে ঘটনার বিষয়ে হলফনামা আকারে জানতে চান। সে আদেশ অনুসারে দুদক হলফনামা আকারে তা উপস্থাপন করে।

পরে জাহালম প্রশ্নে ব্যাংক ঋণ জালিয়াতির ৩৩ মামলার এফআইআর, চার্জশিট, সম্পূরক চার্জশিট এবং সব ব্যাংকের এ সংক্রান্ত নথিপত্র দাখিল করতে দুদককে নির্দেশ দেন।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৯
ইএস/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।