বুধবার (২৫ সেপ্টেন্বর) বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মাদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালতে সাক্ষীকে জেরা না করায় ২ অক্টোবর (বুধবার) মামলাটির পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন আদালত।
বিডিআর হত্যাকাণ্ড ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রাষ্ট্রপক্ষের ও দুদকের বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল এদিন ওসি মোয়াজ্জেমের পক্ষে এক সাক্ষীকে জেরার জন্য সাইবার ট্রাইব্যুনালে আসেন।
এদিন মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণের ধার্য দিনে সাক্ষী একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ফেনী প্রতিনিধি আতিয়ার হাওলাদার হাজির হন। গত ১৯ সেপ্টেম্বর এ সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করেন আদালত। ওইদিন ওসি মোয়াজ্জেমের নিয়মিত আইনজীবী ফারুক হোসেন জেরার জন্য সময় চাইলে বিচারক ২৫ সেপ্টেম্বর জেরার দিন ধার্য করেন।
সে অনুযায়ী সাক্ষী আতিয়ার হাওলাদার হাজির হলে আইনজীবী ফারুক হোসেন জেরা শুরু করেন। জেরা চলমান অবস্থায় এক পর্যায়ে দুদক মোশাররফ হোসেন কাজল ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হলে আইনজীবী ফারুক হোসেন সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে অবশিষ্ট জেরা মোশাররফ হোসেন কাজল করবেন বলে বিচারককে জানান। এরপর মোশাররফ হোসেন কাজল জেরা শুরু বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন তাকে ওকালতনামায় নাম ও স্বাক্ষর আছে কি না জিজ্ঞাসা করেন। তখন মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, আমি সিনিয়র হিসেবে এসেছি। আপনি অনুমতি দিলে জেরা করবো। তখন বিচারক বলেন, ওকালতনামায় আপনি (কাজল) স্বাক্ষর না করলে জেরা করার সুযোগ নেই। ওই সময় বিচারক ওই সংক্রান্তে ফৌজদারি কার্যবিধির সংশ্লিষ্ট ধারাও পড়ে শোনান। এরপর কাজল বলেন, সিনিয়র আইনজীবীরা ওকালতনামায় নাম না থাকলেও আদালতের অনুমতি নিয়ে মামলা পরিচালনা করতে পারেন। এটা নিন্ম আদালত থেকে শুরু করে হাইকোর্টেও হচ্ছে। তখন বিচারক বলেন, জেরা করতে হলে আইন অনুযায়ী ওকালতনামায় আপনাকে স্বাক্ষর করতে হরে। আপনার মতো সিনিয়র এ মামলা পরিচালনায় এলে আদালতও উপকৃত হবে। আপনি চাইলে এখনই আদালতের নথিতে যে ওকালতনামা দেওয়া আছে সেখানে স্বাক্ষর করে জেরা শুরু করতে পারেন। উত্তরে কাজল বিচারককে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, আমি এভাবে এখন ওকালতনামা দেবো না। আগামী তারিখে দেবো। আপনি পারলে একটা সময় দিয়ে দিন। তখন বিচারক সময় দেওয়া যাবে না বলে জানান। এরপর আইনজীবী ফারুক আহমেদ বলেন, আমরা এভাবেই সিনিয়রদের মামলা পরিচালনায় নিয়ে যাই। সিনিয়র আসবে তাই আমি প্রস্তুতি নেইনি। আমার জ্ঞানে যা ছিল তা জেরা করেছি। আপনি (বিচারক) সময় দিন। তখন বিচারক লিখিত সময় আবেদন নামঞ্জুর করে জেরা করতে বলেন। এরপর আইনজীবী ফারুক বলেন, নামঞ্জুর করেছেন, তা হলে আমাদের আর কিছু বলার নেই। তখন বিচারক সাক্ষী আতিয়ার হাওলাদার সাক্ষ্য সমাপ্ত ঘোষণা করে ২ অক্টোবর পরবর্তী সাক্ষীর দিন ধার্য করেন।
গত ১১ সেপ্টেম্বর (বুধবার) নুসরাতের মা শিরিন আক্তার ও ভাই রাশেদ হাসান রায়হান এবং ১৯ সেপ্টেম্বর আরও একজন সাক্ষ্য দেন। সাইবার ট্রাইব্যুনালের আদালতে এ নিয়ে মামলাটিতে ৬ জনের সাক্ষ্য শেষে হয়েছে। এসময় মামলার বাদী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন আদালতে হাজির ছিলেন।
এর আগে গত ১ সেপ্টেম্বর এ মামলায় দুইজন সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। তারা হলেন- অ্যাডভোকেট সবির নন্দী দাশ ও অ্যাডভোকেট সহকারী গোবিন্দ চন্দ দেব। গত ২০ আগস্ট একই আদালতে ব্যারিস্টার সুমনকে জেরা করেন সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের আইনজীবীরা।
চলতি বছরের ১৭ জুলাই আদালত আসামি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অভিযোগ গঠন করেন। একইসঙ্গে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ৩১ জুলাই দিন ধার্য করেন। এছাড়া ১৭ জুলাই আইনজীবী ফারুক আহম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেনকে নির্দোষ দাবি করে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৬৫ (গ) ধারায় মামলার দায় থেকে অব্যাহতির আবেদনসহ জামিনের আবেদন করেছিলেন। তখন মামলার বাদী ব্যারিস্টার সুমন ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ নজরুল ইসলাম শামীম এর বিরোধিতা করেন। দু’পক্ষের শুনানি শেষে বিবাদীপক্ষের উভয় আবেদন নামঞ্জুর করে সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন আদালত।
মোয়াজ্জেম হোসেনের অব্যাহতির আবেদনে বলা হয়, বাদী ক্ষতিগ্রস্ত নন। এছাড়া মামলায় ঘটনার সময় এবং ভিডিও ধারণের সময় উল্লেখ নেই। আসামি মোয়াজ্জেম হোসেনের মোবাইল থেকে তা প্রচার করা হয়নি। তবে ভিডিও করা হয়েছে। পরে তা থানা থেকে চুরি হয়ে গেছে।
এ দিন শুনানি শেষে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় করা অভিযোগ গঠন করেন মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে আদালত।
এর আগে ১০ জুলাই মোয়াজ্জেম হোসেনের অভিযোগ গঠন শুনানির দিন ধার্য ছিল। কিন্তু আসামিকে কাশিমপুর কারাগার থেকে আদালতে হাজির করতে না পারায়, তা পিছিয়ে ১৭ জুলাই নির্ধারণ করা হয়েছিল।
এর আগে ৯ জুলাই বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ মোয়াজ্জেম হোসেনের জামিন আবেদন উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দেন।
চলতি বছরের ১৬ জুন রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে আসামি মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর ১৭ জুন তাকে ফেনীর সোনাগাজী থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ওইদিনই ফেনী সোনগাজী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একটি টিম মোয়াজ্জেমকে আদালতে হাজির করে। পরে জামিন আবেদন করলে নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।
এরপর গত ২৪ জুন এক আবেদনে ট্রাইব্যুনাল কারাবিধি অনুযায়ী তাকে ডিভিশন দেওয়ার আদেশ দেন। কারাবিধি অনুযায়ী প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে মর্যাদা ভোগ করছেন তিনি।
মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে ‘অসম্মানজনক’ কথা বলায় ও তার জবানবন্দির ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় গত ১৫ এপ্রিল সাইবার ট্রাইব্যুনালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় করা অভিযোগটি পিটিশন মামলা হিসেবে গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে তদন্ত করে ৩০ এপ্রিল প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
গত ২৭ মে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রীমা সুলতানার পক্ষে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার প্রতিবেদন জমা দেয় পিবিআই। একইদিন মামলার তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১৭ জুন দিন ধার্য করেন আদালত। ওইদিনই তাকে আদালতে হাজির করা হয়।
পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বাদীসহ ১৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে সোনাগাজী থানার চার পুলিশ সদস্যও রয়েছেন।
চলতি বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ-উদ দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন ভুক্তভোগী নুসরাতের মা। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
যৌন হয়রানির অভিযোগ করতে যাওয়ার পর থানার ওসির কক্ষে ফের হয়রানির শিকার হতে হয় নুসরাতকে। ‘নিয়ম না মেনে’ জেরা করতে করতেই নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেন ওসি। মৌখিক অভিযোগ নেওয়ার সময় দু’জন পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেলেও সেখানে নুসরাত ছাড়া অন্য কোনো নারী বা তার আইনজীবী ছিলেন না।
গত ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার আগ মুহূর্তে বান্ধবীকে মারধরের কথা বলে নুসরাতকে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে চাপ দেয় দুর্বৃত্তরা। মামলা তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানালে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় তারা।
ওইদিন নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল এবং পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে গত ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাতের মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৯
এমএআর/জেডএস