ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২৬ জিলহজ ১৪৪৫

আইন ও আদালত

যৌন হয়রানির মামলায়ও সিরাজের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৯
যৌন হয়রানির মামলায়ও সিরাজের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি

ফেনী: ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন হয়রানির অভিযোগে দায়ের করা মামলাও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন নুসরাতের পরিবার। গত ২৮ মার্চের এ মামলার জের ধরেই নুসরাত হত‌্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। 

রোববার (২৭ অক্টোবর) এ মামলায় বাদীর সাক্ষ‌্য দেওয়ার দিন নির্ধারিত ছিলো। কিন্তু ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতের অধিবেশন না থাকায় তা পিছিয়ে চলতি বছরের ১৩ নভেম্বর সাক্ষ‌্য দেওয়ার জন্য দিন নির্ধারণ করছেন আদালত।

 

মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী শাহজাহান সাজু বলেন, চলতি বছরের ২৭ মার্চ আলিম পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানের দিন মাদ্রাসার অধ‌্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা মাদ্রাসার পিয়ন নুরুল আমিনকে দিয়ে তার কক্ষে নুসরাতকে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর সিরাজ নুসরাতকে বলে ‘তুই মাদ্রাসার অন‌্য ছেলেদের সঙ্গে প্রেম করিস, আমার সঙ্গে প্রেম করলে কি হয়? ওরা তোকে কি দেয়, আমি তোরে পরীক্ষার প্রশ্ন দিবো’ এমন প্রস্তাবে নুসরাত রাজি না হলে সিরাজ নুসরাতকে জড়িয়ে ধরে এবং স্পর্শ কাতর স্থানে হাত দেয়। পরে নুসরাত কাঁদতে কাঁদতে অধ‌্যক্ষ সিরাজের কক্ষ থেকে বের হয়। যা নুসরাতের অপর সহপাঠীরা দেখতে পায়।

এর পরদিন ২৮ মার্চ নুসরাতের মা স্থানীয় ২নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইয়াসিনকে নিয়ে মাদ্রাসায় যায় এবং সিরাজের কক্ষে গিয়ে তাকে তার বেত দিয়ে বেত্রাঘাত করেন। এক পযর্ায়ে বিষয়টি মাদ্রাসা কমিটিকে জানানো হয়। পরে মাদ্রাসা কমিটি পুলিশ তলব করে। পুলিশ গিয়ে সিরাজকে আটক করে এবং সেদিনই নুসরাতের মা শিরিন আখতার সিরাজকে একমাত্র আসামি করে মামলা দায়ের করেন। পুলিশ ওইদিনই সিরাজকে জেল-হাজতে পাঠায়।

একইদিন নুসরাতের মা শিরিন আখতার ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম‌্যাজিস্ট্রেট এসএম ইমরানের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সেদিন নুসরাতও ২২ ধারায় জবানবন্দি দেয়। সেই জবানবন্দিতে নুসরাত বর্ণনা করে সিরাজ তার কোন জায়গায় কিভাবে স্পর্শ করে।

এরপর পুলিশের তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক শাহ-আলম ৮ জুলাই ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি জমা দেন। পরদিন অভিযোগ গঠনের শুনানি হয় এবং অপরাধ আমলে নেন আদালত। আদালত নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২০০৩ এর ১০ ধারায় ১৭ জুলাই অভিযোগ গঠন করেন। রোববার ২৭ অক্টোবর মামলাটির সাক্ষ‌্য দেওয়ার দিন ধার্য‌্য ছিলো। আদালতের অধিবেশন না থাকায় তা পিছিয়ে ১৩ নভেম্বর পরবর্তী দিন ধার্য‌্য করা হয়েছে।

নুসরাতের মা শিরিন আখতার বলেন, এক মামলায় তো কুলাঙ্গার সিরাজের ফাঁসি হয়েছে। এই মামলায়ও যেন তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুঁলি ফেনী জজ কোর্টের পিপি হাফেজ আহম্মদ বাংলানিউজকে জানান, নারী শিশু আইন ২০০৩ এর ১০ ধারায় এ মামলায় আসামির ১০ বছরের শাস্তি হতে পারে। অপরাধের সব তথ‌্য প্রমাণ আছে। আমরা আশা করবো, ধারা অনুযায়ী এ মামলাও সিরাজের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে।

বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) সোয়া ১১টায় ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মামুনুর রশিদ নুসরাত হত্যা মামলায় ১৬ আসামির ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন।
নুসরাত জাহান রাফির মা, ছবি: বাংলানিউজঘটনার সূত্রপাত হয় চলতি বছরের ২৭ মার্চ। পরের দিন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করেছিলেন নিহত নুসরাতের মা শিরিন আখতার। সেদিনই অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর তার অনুগত কিছু ক্যাডার জনমত গঠন করে সিরাজকে জেল থেকে বের করে আনার জন্য। তারা সিরাজকে মুক্ত করতে রাস্তায় আন্দোলনও করে।

৩ এপ্রিল খুনিরা সিরাজের সঙ্গে জেলখানায় পরামর্শ করে এসে ৪ এপ্রিল মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে নুসরাতকে খুন করার পরিকল্পনা নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৬ এপ্রিল নুসরাত মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে খুনিরা পরিকল্পিতভাবে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে নুসরাতকে হত্যার চেষ্টা চালায়।  

ঘটনাস্থল থেকে নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। এরপর তাকে স্থানান্তর করা হয় ফেনী ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় সেখান থেকে নুসরাতকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানেই চিকিৎসা হয় নুসরাতের।

এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল ৮ জনকে আসামি করে ও অজ্ঞাতপরিচয় বোরকা পরা চারজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) হস্তান্তর করা হয় ১০ এপ্রিল। সেদিন রাতেই মারা যান নুসরাত। মৃত্যুর আগে ডাইং ডিক্লারেশন দিয়ে যায় সে- তার সেই ডিক্লারেশনের ক্লু ধরেই এগোতে থাকে মামলা। এক এক করে গ্রেফতার করা হয় আসামিদের।

১১ এপ্রিল নুসরাতকে আনা হয় তার বাড়িতে। সোনাগাজী সাবের পাইলট হাইস্কুল মাঠে নামাজে জানাজার পর সমাহিত করা হয় কবরে। সেদিন নুসরাতের জানাজাটি ছিল লোকে লোকারণ্য। লাখো মানুষ তার জানাজায় অংশ নিয়ে খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে।

এরপর একে একে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করা হয় ২১ জনকে। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন ১২ জন। ২৮ মে চার্জশিট দাখিল করা হয়। আদালত পাঁচজনকে বাদ দিয়ে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করে ১৬ জনকে। নুসরাত হত্যায় পুলিশের অবহেলার অভিযোগে ১৩ মে প্রত্যাহার করা হয় ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে। নুসরাতের থানায় হেনস্থা হওয়ার ভিডিওটি প্রকাশ হওয়ার পর ৮ মে সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি ) মেয়াজ্জেমসহ পুলিশের দুই এসআইকে বহিষ্কার করা হয় ৮ মে। এরপর তার নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। ১৬ জুন তাকে রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

১০ জুন অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। এরপর ২০ জুন চার্জ গঠন হয়। ২৭ জুন থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়, ৯০ জন সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্য দেন মোট ৮৭ জন। দীর্ঘ ৪৭ দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষে গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছিল যুক্তিতর্ক। চলে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ৩০ সেপ্টেম্বর আদালত রায়ের জন্য ২৪ অক্টোবর নির্ধারণ করেন। মামলাটিতে মাত্র ৬১ কার্য দিবসে ৮৭ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তি-তর্ক গ্রহণ করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৯
এসএইচডি/ওএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।