ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

যেভাবে নিষ্পত্তি হলো ১ বছর সাজার ৩৫ বছর বয়সী মামলা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১২ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০২১
যেভাবে নিষ্পত্তি হলো ১ বছর সাজার ৩৫ বছর বয়সী মামলা

ঢাকা: ১৯৮৬ সালে গাজীপুরে তুচ্ছ ঘটনার জেরে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে মারামারি। এর জেরে মামলা।

বিচার শেষে অর্থদণ্ডসহ এক বছরের সাজা। এর বিরুদ্ধে আপিলের ধারাবাহিকতায় মামলাটি সবশেষ আপিল বিভাগে আসে।

চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি মামলাটি নিষ্পত্তি করে সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন—এই ঘটনা ঘটেছিল দুই প্রতিবেশীর মধ্যে তুচ্ছ একটা ঘটনার জের ধরে। এইসব ক্ষেত্রে আসামিকে এক বছরের জন্য জেলে না পাঠিয়ে প্রবেশনে রাখা সমীচীন ছিল।

আপিল বিভাগ আরও বলেন, যেহেতু দণ্ডবিধির ৩২৩ এবং ৩২৫ ধারা আপসযোগ্য অপরাধ এবং যেহেতু দুই পক্ষ পরস্পর আত্মীয়/প্রতিবেশী; কাজেই মামলাটি আপস মীমাংসা করা যুক্তিযুক্ত ছিল।

‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ এর বিধানাবলী বিচারিক আদালত, আপিল আদালত এবং হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক প্রয়োগযোগ্য। অথচ আগের আদালতসমূহের তিনটি রায় থেকে বোঝা যাচ্ছে না যে, বিচারকগণ এই আইনের বিষয়ে আদৌ অবগত আছেন কিনা। যদি এই আইন প্রয়োগের বিষয়ে ধারণা থাকতো তাহলে রায়ের মধ্যে বলা থাকতো কেন এই আইন প্রয়োগ করা সমীচীন নয় এবং যদি এই আইন সঠিকভাবে বিচারিক আদালতে প্রয়োগ করা হতো তাহলে এই ধরনের মামলা আপিল বিভাগ পর্যন্ত আসতো না, বলে রায়ে মন্তব্য করেন সার্বোচ্চ আদালত।

আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ রায় দেন। রায়ের অনুলিপি মঙ্গলবার (২ মার্চ) সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

রায়ে আদালত বলেন, বাংলাদেশের শতকরা ৬২ ভাগের অধিক লোক গ্রামাঞ্চলে বাস করে। যেখানে মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক শহরের তুলনায় বেশি এবং তাদের মধ্যে ছোট-খাটো ঝগড়া-বিবাদও বেশি হয়। এই মামলার ঘটনা শুরু হয়েছিল খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে। ১৯৮৬ সালের ১৪ জুলাই সন্ধ্যায় আসামি আব্দুল মতিনের সাথে বাদী আহমদ আলীর ১০/১২ বছরের নাতি আব্দুল বাকির কথা কাটাকাটি হয়। ওই দিনই সন্ধ্যায় এই ব্যাপারে সালিশ হয় এবং মতিনকে সালিশে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ফলে আসামিপক্ষ প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দেয় এবং পরের দিন সকাল ছয়টায় আসামি মতিনের ভাই আসামি নুর মোহাম্মদ বাদীর ছেলে আব্দুল জব্বারকে আক্রমণ করে এবং একটি ফালার চ্যাপ্টা অংশ দিয়ে মাথায় আঘাত করে জখম করে এবং তার বাম হাতের কব্জি ভেঙে দেয়। মোট ৬ (ছয়) জন আসামি বাদী পক্ষের ৪ (চার) জনের শরীরে বিভিন্ন আকারের জখম করে। এর মধ্যে আব্দুল জব্বার সবচেয়ে গুরুতরভাবে আহত হন।

বিচার শেষে ১৯৯৪ সালের ৩১ জানুয়ারি বিচারক বর্তমান আবেদনকারী নুর মোহাম্মদকে দণ্ডবিধির ৩২৫ ধারার অপরাধের জন্য এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৩২৩ ধারার অপরাধের জন্য দুই হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। অন্যান্য আসামিদের দণ্ডবিধির ৩২৩ ধারার অপরাধের জন্য যথাক্রমে দুই হাজার টাকা এবং পাঁচশত টাকা জরিমানা করেন।

এর বিরুদ্ধে আসামিরা অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন। যেটি ২০০৫ সালের ৭ জুলাই খারিজ হয়ে যায়। পরবর্তীতে আসামিরা হাইকোর্ট বিভাগে আবেদন করেন। শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ২ মার্চ আবেদনটি খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।

হাইকোর্ট বিভাগের ওই খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আসামি নুর মোহাম্মদ আপিল বিভাগে আবেদন করেন।

রায়ে আপিল বিভাগ বলেন, আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি, বিচারিক আদালতের বিচারক ও আপিল আদালতের বিচারক সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছেন যে, আমাদের দেশে ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ নামে একটি আইন আছে এবং বর্তমান মামলার প্রেক্ষাপটে সেই আইনের ৫ ধারা প্রয়োগযোগ্য। যখনই বিচারক ৩২৫ ধারার অপরাধে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করলেন তখনই ওনার উচিত ছিল ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ এর ৫ ধারা বিবেচনা করা। মামলার বিষয়বস্তু থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এই ঘটনা ঘটেছিল দুই প্রতিবেশীর মধ্যে তুচ্ছ একটা ঘটনার জের ধরে। এইসব ক্ষেত্রে আসামিকে এক বছরের জন্য জেলে না পাঠিয়ে প্রবেশনে রাখা সমীচীন ছিল। এমনকি, যেহেতু দণ্ডবিধির ৩২৩ এবং ৩২৫ ধারা আপসযোগ্য অপরাধ এবং যেহেতু দুই পক্ষ হচ্ছে পরস্পর আত্মীয়/প্রতিবেশী কাজেই মামলাটি আপস মীমাংসা করা যুক্তিযুক্ত ছিল। আমরা আরো দুঃখের সাথে বলতে চাচ্ছি যে, এ ধরনের মামলার ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ প্রয়োগ না করা শুধু দুঃখজনকই নয়, প্রচলিত আইনের পরিপন্থী।

নিম্ন আদালতের দুই জন বিচারক এবং হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক কেউই ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ অথবা আপস-মীমাংসার ব্যাপারে চিন্তা করেননি এবং দণ্ড ও সাজা বহাল রাখেন। ইতোমধ্যে আবেদনকারী নুর মোহাম্মদ ৩১ দিন কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। আবেদনকারী নুর মোহাম্মদের দোষী সাব্যস্তের আদেশ এবং জরিমানা বহাল থাকবে। তবে তিনি যতদিন কারাদণ্ড ভোগ করেছেন ততদিনই তার দণ্ড হিসেবে গণ্য হবে উল্লেখ করে নুর মোহাম্মদের আবেদন নিষ্পত্তি করে দেন আপিল বিভাগ। সংশোধন করে দেন হাইকোর্ট বিভাগের রায় ও আদেশ।

বাংলাদেশ সময়: ১৮১০ ঘণ্টা, মার্চ ০২, ২০২১
ইএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।