ঢাকা: গাজীপুর থেকে গত সপ্তাহে ঢাকার আদালতে রেশমা আক্তার এসেছিলেন জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংশোধনের হলফানামা (এফিডেভিট) করতে। দিনভর বসে থেকে তিনি হাতে পাননি হলফনামা।
গুলশান থেকে ঢাকার আদালতে দিনভর চেষ্টা শেষে মায়ের নাম সংশোধনের হলফনামা তবু হাতে পেয়েছেন এজিএম সালেহ নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক যুবক।
এমন শত শত মানুষ ঢাকার আদালতে প্রতিদিন আসেন বিভিন্ন ধরনের হলফনামার জন্য। বিশেষ করে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট বা শিক্ষা সনদে ভুল সংশোধন বা তথ্য পরিবর্তনের জন্য প্রথম শ্রেনির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হলফনামা দিতে হয়। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বিভিন্ন তথ্যগত বিষয়ে হলফনামা চেয়ে থাকে। এর বাইরে আম-মোক্তারনামা, অংশীদারিত্ব চুক্তি, ধর্মান্তরসহ নানা কারণে করতে হয় হলফনামা। দিন দিন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাওয়া এই হলফনামার পরিসর বাড়ছে।
যতোই বাড়ছে প্রয়োজনীয়তা ততোই এ নিয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তিও বাড়ছে। সাধারণত আদালতে মামলা শুনানির একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। তবে, হলফনামার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই তেমন কোনো সময়সীমা মানা হয় না। দুপুর একটার মধ্যে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের তিনতলায় নেজারত শাখায় হলফনামা ও এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয়। দুপুর দুইটার দিকে সংশ্লিষ্ট আদালতে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হয়ে থাকে নেজারত শাখা থেকে। তবে, নির্ধারিত সময়ে হলফনামার কাজ সাধারণত হয় না। সেসময় পেছাতে পেছাতে অনেক সময় সন্ধ্যা পর্যন্ত গড়িয়ে যায়।
ভুল সংশোধনের হলফনামার ক্ষেত্রে ৩০০ টাকার নন জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে বিবরণসহ হলফ করতে হয়। একজন আইনজীবী হলফকারীকে শনাক্ত করে থাকেন। এরপর নোটারি পাবলিকের সামনে হলফনামা দেওয়ার পর তা জমা দিতে হয় সিএমএম আদালতের নেজারত শাখায়। পুরো কাজটি করার জন্য এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগার কথা। কিন্তু একজন ব্যক্তিকে হলফনামার জন্য আদালতে প্রায় সারাদিন তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকতে হয়। তাছাড়া বিপুল সংখ্যক মানুষ দীর্ঘক্ষণ একসঙ্গে জটলা পাকিয়ে আদালতে অপেক্ষা করায় কোভিডকালে তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও।
হলফনামা নিয়ে এই ভোগান্তি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আইনজীবীরাও। অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ আদালতের নিয়ম না বুঝতে পারায় আইনজীবীকেও থাকতে হয় সঙ্গে। একটি কাজের জন্য দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয়। এমতাবস্থায় ভোগান্তি কমাতে এফিডেভিটের জন্য সারাদিন একটি আদালতকে দায়িত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সেটি সম্ভব না হলেও দিনের নির্দিষ্ট সময়ে এজলাসে উঠে হলফকারীর উপস্থিতিতে হলফনামা নেওয়া হলে এই ভোগান্তি কমবে বলে তারা মনে করেন।
ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী ফাহাদ হোসেন জনি বলেন, এফিডেভিট সংক্রান্ত কাজ আইনজীবীর জন্যও একটি বিড়ম্বনা। তবে, নানা কারণে এসব কাজ করতে হয়। বিশেষ করে জুনিয়র আইনজীবীরা আর্থিক কারণে এসব কাজ করে থাকেন। সেক্ষেত্রে মোয়াক্কেলরা সঙ্গে না থাকলে অসহায়ত্ব বোধ করেন। অনেক ক্ষেত্রে পড়ে যান দালালের খপ্পড়ে। আবার দেখা যায় একটা হলফনামা করতে চলে যায় সারাদিন। কিন্তু ক্লায়েন্টরা সেই তুলনায় টাকাও দেন না। তাই এ নিয়ে একটা উভয় সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
একই আদালতের আরেক আইনজীবী মো. পারভেজ বলেন, সাধারণত আদালতে সিআর, জিআর মামলা, বিচারাধীন মামলা, প্রডাকশন ইত্যাদির একটা নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রে হয়তো কিছুটা হেরফের হয়। তবে, যে পরিমাণ মানুষ হলফনামা করতে আসে সেই হিসেবে এক্ষেত্রে কোনো নিয়ম শৃঙ্খলা নেই। নেজারত শাখা থেকে দুপুর দুইটায় সাধারণত হলফনামার সময় দেওয়া হয়। কিন্তু আদালত থেকে সেই কাজ শেষ করতে ক্ষেত্রে বিশেষে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় লেগে যায়। শত শত মানুষের এই ভোগান্তির সুযোগে দালালরা অনেক ক্ষেত্রেই ভুয়া হলফনামা তৈরি করে দেয়। তখন সাধারণ মানুষ আরেক দফা ভোগান্তিতে পড়ে। তাই আইনজীবী ও সাধারণ মানুষের হয়রানির জন্য হলফনামার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া জরুরি।
জানতে চাইলে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আব্দুল বাতেন বাংলানিউজকে বলেন, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে হলফনামা নিয়ে ভোগান্তির বিষয়টি শুনেছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা সিএমএম সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। একটা নির্দিষ্ট সময়ে এজলাসে বসেই যাতে হলফনামার কাজগুলো করে দেওয়া হয় সেটা বলব। তাছাড়া এখন কোভিডের কারণে এমনিতেই জনসমাগমে নিরুৎসাহিত করা হয়। সাধারণ মানুষ ও আইনজীবীরা যাতে ভোগান্তি ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে না পড়েন। সেই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে সিএমএম সাহেবকে আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে অনুরোধ করব।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২২
কেআই/এএটি