ঢাকা: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. শাহজাহান। ব্যক্তিগত কারণে টাকা ধার দিয়েছিলেন মাসুদা বেগম নামে একজনকে।
মামলাটি বিচারের জন্য প্রস্তুত হলে বদলি হয়ে আসে ঢাকার মহানগর তিন নম্বর যুগ্ম জেলা জজ আদালতে। সেখানেও একদফা সময় নেওয়ার পর গত ১০ অক্টোবর ছিল অভিযোগ গঠনের দিন। তবে ওই আদালতের বিচারক অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে এর আগেই বদলি হয়ে যান। যে কারণে ভারপ্রাপ্ত আদালত থেকে চার্জ গঠনের জন্য পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হয়েছে আগামী বছরের ৭ আগস্ট।
শুধু এই মামলা নয়, ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের অধীন সাতটি যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতের চিত্র প্রায় একই। নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও এসব আদালতে এখন বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৭০ হাজারের বেশি বলে জানা গেছে। যে কারণে চেক প্রতারণার মামলায় এখন বিচার পাওয়া দুরূহ ব্যাপার হয়ে গেছে।
ব্যক্তিগত লেনদেন থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণের সিকিউরিটি হিসেবে দেওয়া হয় ব্যাংক হিসাবের চেক। আর সেই লেনদেনে যখন অঙ্গীকার ঠিক থাকে না, তখন চেকের বিপরীতে হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন (এনআই অ্যাক্ট) ১৮৮১ এর ১৩৮ ও ১৪০ ধারা অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়। বিচার সংক্ষিপ্ত পদ্ধতির হলেও চেক প্রতারণার মামলা এখন পাওনাদারদের জন্য যেন এক মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের মামলায় বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা দিনে দিনে বাড়ছেই। এমনকি ঢাকার বেশির ভাগ আদালতে এখন চেক প্রতারণার মামলায় বছরে একটির বেশি তারিখই পড়ছে না।
শুধু ব্যক্তি নয়, এসব মামলা নিয়ে চরম বিপাকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও। বাংলাদেশ ফাইন্যান্স লিমিটেড নামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ঋণখেলাপি প্রাইম এ এম আর এক্সচেঞ্জ এবং প্রাইম কম্যুনিকেশন নামে দুটি প্রতিষ্ঠান। দুটি প্রতিষ্ঠানেরই স্বত্বাধিকারী রাশেদুল আলম মামুন। যার কাছে প্রতিষ্ঠানটির পাওনা প্রায় ৪২ কোটি টাকা। এসব টাকার বিপরীতে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের করা ঢাকা ও চট্টগ্রামের আদালতে এনআই অ্যাক্টের মামলা সংখ্যা ৮টি। সবগুলো মামলাই ২০১৯ সালে করা হলেও এখনো দায়রা আদালতে মামলাগুলোর চার্জ গঠনের মাধ্যমে বিচারই শুরু হয়নি।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান আইন কর্মকর্তা ব্যারিস্টার ইব্রাহীম খলিল বাংলানিউজকে বলেন, একজন ঋণখেলাপি ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। আইনি সুরক্ষা না পেলে এ ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ঋণ প্রদান ও তা উত্তোলন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ঋণখেলাপি ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিতকরণ এবং আমানতকারীদের আর্থিক সুরক্ষার জন্য অবশ্যই এই আইনি প্রক্রিয়া আরও দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হওয়া আবশ্যক।
চেক ডিজঅনার হলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে দেনাদারকে লিগ্যাল নোটিশ দিয়ে পাওনা টাকা চাইতে হয়। নোটিশে ৩০ দিনের সময় দেওয়া হয় পাওনা পরিশোধে। সেই সময়ের মধ্যে পাওনা পরিশোধ না করলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে চিফ মেট্রোপলিটন বা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এখতিয়ার সম্পন্ন বিচারকের কাছে নালিশী মামলা করতে হয়। সেই মামলায় প্রথমে সমন দেওয়া হয়। প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে মামলা দায়রা আদালতে বদলি করা হয়। আগে অতিরিক্ত ও যুগ্ম দুই ধরনের দায়রা আদালতেই পরবর্তী বিচার সম্পন্ন হতো। তবে ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে হাইকোর্টের এক রায়ে শুধু যুগ্ম দায়রা আদালতে মামলা বিচারের নির্দেশ দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, আপিল এখতিয়ার দেওয়া হয় জেলা বা মহানগর দায়রা আদালতকে। সেই থেকে এনআই অ্যাক্টের সকল মামলা যুগ্ম দায়রা আদালতে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকার মহানগর এলাকায় এই ধরনের অপরাধের ব্যপ্তি অনেক। কিন্তু মাত্র সাতটি আদালতে বিচার হওয়ায় এই মামলাগুলোর বিচারে জট দেখা দেয়।
জানতে চাইলে ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ এহসানুল হক সমাজী বাংলানিউজকে বলেন, হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন ১৮৮১ এর অধীনে চেক ডিজঅনারের মামলা দায়রা আদালতে বিচার্য এবং দায়রা আদালতকে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৩ অধ্যায়ে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী বিচার পরিচালনা করতে হবে। এই অধ্যায়ের অধীনে পরিচালিত মামলা বিচারকার্য কোনোরূপ বিরতি ছাড়াই দৈনন্দিন ভিত্তিতে হতে হবে। উপযুক্ত কারণ ছাড়া দায়রা মামলায় মুলতবি রাখার আইনগত কোনো সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু ফৌজদারি কার্যবিধি আইনে ৩৩৯ এর ‘সি’ ধারায় দায়রা আদালতে বিচার নিষ্পত্তির সময়সীমা ৩৬০ দিন উল্লেখ আছে। সুতরাং সেই ক্ষেত্রে বিজ্ঞ দায়রা আদালতকে দায়রা মামলার বিচার পরিচালনার ক্ষেত্রে মহামান্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়মিতভাবে অব্যাহত রাখা এবং বিধিবদ্ধ সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য সচেষ্ট হতে হবে বলে আমি মনে করি। সেইক্ষেত্রে মামলায় বিবদমান পক্ষদ্বয় এবং রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবীদের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতকে সহায়তা করতে হবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, এনআই অ্যাক্টের মামলার চাপে ঢাকার যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতের এজলাসগুলোতে দিনের শুরুতেই উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। এমনকি কোনো কোনো আদালত একদিনে অর্ধশত মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ করে থাকেন। এই সুযোগে আসামিপক্ষ মামলা বিলম্বিত করতে নানা কৌশল ব্যবহার করে থাকে। ফলে দায়রা আদালতে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হতে ক্ষেত্র বিশেষে চার-পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
এত দীর্ঘ সময় আইনি লড়াইয়ের পর রায় পেয়েই শেষ নয়, তারপর আপিল নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। অনেকে আবার রায়ের আগে আপসের কথা বলে, টাকা দেওয়ার কথা বলেও মামলাকে বিলম্বিত করেন। তাই এত দীর্ঘ সময় আইনি লড়াই করে শেষ পর্যন্ত টাকা উদ্ধার হলেও বিচারপ্রার্থীরা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন।
জানতে চাইলে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল বাংলানিউজকে বলেন, এনআই অ্যাক্টের মামলার বর্তমান যে অবস্থা তা খুবই ভয়াবহ। আগে যেভাবে যুগ্ম ও অতিরিক্ত দায়রা আদালতে বিচারত হতো সেটা আবার চালু করা দরকার। অন্তত বড় অঙ্কের চেকের মামলাগুলো অতিরিক্ত দায়রা আদালতে বিচার করা উচিত। অন্যথায় এই অবস্থা আরও খারাপ হবে। আমার মনে হয় এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে হয়তো দেড় থেকে দুই বছর পর মামলার তারিখ পড়বে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০২২
কেআই/এমজেএফ