ঢাকা: ব্রিটিশ শাসন থেকে উপমহাদেশ মুক্ত হয় সাতচল্লিশে। সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্র।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরেই সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন সভার জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়েই গঠন করা হয় গণপরিষদ। সেই গণপরিষদের মাধ্যমেই ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়। সেই থেকে ৫০ বছরে সব সংকটে জাতিকে পথ দেখিয়েছে এ সংবিধান। শাসকের প্রয়োজনে বা সময়ের প্রয়োজনে ১৭ বার সংশোধন হয়েছে সংবিধান। তা সত্ত্বেও ১৯৭২ সালের সংবিধানটি পাকিস্তানের মতো একেবারে বাতিল করা হয়নি কখনও। খুঁড়িয়ে চলেছে তবে থমকে দাঁড়ায়নি কখনও।
বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে ফের রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। তারপর অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়েছে। দীর্ঘ দেড় দশকের সামরিক শাসনের ফলে শাসনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বিনষ্ট হয়। সংবিধানে কিছু মৌলিক বিধানের পরিবর্তনও করা হয়। সংকট সত্ত্বেও ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় এ সংবিধানই পথ দেখিয়েছে জাতিকে। যখন জেনারেল এরশাদ বিদায় নেবেন তখন পদ্ধতিগত জটিলতা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত উপ-রাষ্ট্রপতি পদে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। আর উপ-রাষ্ট্রপতি পদ থেকে শাহাবুদ্দিন আহমেদ রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন। এভাবে সংকট নিরসন হয়।
১৯৯১-৯৬ মেয়াদে বিএনপি শাসনামালে আওয়ামী লীগসহ অন্য বিরোধীদলগুলো নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করে। কিন্তু তৎকালীন বিএনপি সরকার সেই দাবি মেনে নেয়নি। তাই ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর আন্দোলনরত আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর ১৪৭ জন সংসদ সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন। এতে দেশে একটা সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির উপক্রম হয়। তবে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন করে সেই সংসদে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পাস করে। এরপর খালেদা জিয়া বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে সাংবিধানিকভাবেই সংকট নিরসন হয়।
এরপর ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতা গ্রহণ করলে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ করে সেই সরকার। তাতে সবশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে কে এম হাসান জোট সরকারের মেয়াদের শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পথ তৈরি হয়। তবে পছন্দের ব্যক্তিকে নির্বাচনকালে সরকারের দায়িত্ব দিতে বিচারপতিদের অবসরের বয়স বাড়ানো হয়েছে বলে তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে। এরপর ২০০৬ সালের অক্টোবরে বিরোধীদলের কঠোর আন্দোলনের মুখে কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন। তাই রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের দায়িত্ব নিলে সংকট আরও ঘনীভূত হয়। সংকটের জেরেই ২০০৮ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি করে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। সেই সরকারের দুই বছরের শাসনামলে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি। তবে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে ড. ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করলে সংকটের অবসান হয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা, কার্যকর সংসদীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন, বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আছে। পঞ্চাশে এসে সেই সংস্কারে আবারও পথ দেখাতে পারে ১৯৭২ সালের সংবিধানই। সংবিধানকে ভিত্তি ধরেই আগামী দিনে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে, সুবর্ণজয়ন্তীতে এটাই সবার প্রত্যাশা।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০২২
কেআই/আরবি