চিনি অনেকদিন ধরেই ক্যান্সারসহ নানা প্রাণঘাতী রোগের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। যদিও অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ যে ক্ষতিকর, তা অস্বীকার করার উপায় নেই, তবুও সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে—স্বাস্থ্যকর বলে বিবেচিত অনেক সাধারণ খাবারও দীর্ঘমেয়াদে শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
তবে এটি কোনো খাবারকে দোষারোপ করার বিষয় নয়। বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে সচেতনতা বাড়ানো। বিজ্ঞানীরা যখন ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধির পেছনের কারণগুলো গভীরভাবে অনুসন্ধান করছেন, তখন পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে— নিয়মিত যেসব খাবার আমরা গ্রহণ করি, সেগুলোরই বড় ভূমিকা রয়েছে।
গবেষণা বলছে, ক্যান্সার কোষ সত্যিই সাধারণ কোষের তুলনায় বেশি গ্লুকোজ গ্রহণ করে, তবে সম্পূর্ণ চিনি বাদ দিলেই ক্যান্সার থেমে যাবে—এমন ধারণার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। গ্লুকোজ মানবদেহের সব কোষের জন্যই প্রয়োজনীয় শক্তির উৎস।
আসল উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে আমাদের সামগ্রিক খাদ্যাভ্যাস। দীর্ঘদিনের প্রদাহ, স্থূলতা এবং ইনসুলিন প্রতিরোধের মতো সমস্যা—যেগুলো অতিরিক্ত চিনি, প্রক্রিয়াজাত খাবার ও লাল মাংসের সঙ্গে যুক্ত এবং ক্যান্সারের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।
এদিকে চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে ডিমের ক্ষেত্রেও। সাধারণভাবে ডিমকে উচ্চমানের প্রোটিন ও পুষ্টির উৎস হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু উরুগুয়েতে ১৯৯৬ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত পরিচালিত এক বড় গবেষণায় দেখা গেছে, অতিমাত্রায় ডিম খাওয়ার সঙ্গে কয়েক ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ার সম্পর্ক রয়েছে।
৩,৫০০-এর বেশি ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তি এবং ২,০০০-এর বেশি নিয়ন্ত্রণ দলের (হাসপাতালে থাকা সাধারণ রোগী) উপর চালানো এই গবেষণায় ধরা পড়ে, যারা নিয়মিত বেশি পরিমাণে ডিম খেতেন, তাদের মধ্যে কোলন, ফুসফুস, স্তন, প্রোস্টেট, মূত্রাশয়, মুখগহ্বর এবং উপরের শ্বাসনালী ও খাদ্যনালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল।
গবেষকরা ধূমপান, অ্যালকোহল গ্রহণ এবং সার্বিক খাদ্যাভ্যাসের মতো উপাদানগুলোর হিসাব করে ফলাফল বিশ্লেষণ করেছেন। তারপরও ডিমের সাথে ক্যান্সারের ঝুঁকির সংযোগ রয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি সরাসরি কারণ নয় বরং একটি পরিসংখ্যানভিত্তিক সম্পর্ক। তবে এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলছে— অতিরিক্ত ডিম গ্রহণ কি ধূমপান, খারাপ খাদ্যাভ্যাস বা দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহের মতো অন্যান্য ঝুঁকির সাথে মিলে ক্যান্সার প্রবণতা বাড়াতে পারে?
এই বিষয়ে গবেষকরা আরও মানবভিত্তিক গবেষণার ওপর জোর দিচ্ছেন, যাতে এই সংযোগের প্রকৃত কারণ আরও ভালোভাবে বোঝা যায়।
ডিম নিয়ে সব গবেষণা কিন্তু নেতিবাচক নয়। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ডিমের প্রোটিন ও পেপটাইড—বিশেষ করে বিশুদ্ধভাবে তৈরি হলে—অ্যান্টি-ক্যান্সার এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর সম্ভাবনা রাখে। তবে সমস্যা হলো, এই ফলাফলগুলো মূলত ল্যাবরেটরিতে কোষের উপর (ইন ভিট্রো) করা পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে। মানবদেহে এগুলো কতটা কার্যকর হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তাই পর্যাপ্ত মানবভিত্তিক গবেষণা ছাড়া ডিমের এই স্বাস্থ্যগুণ এখনও শুধুই প্রতিশ্রুতির পর্যায়ে রয়েছে।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, চিনির পরে যদি কোনো খাদ্যাভ্যাস সত্যিকারের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তা হলো অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবারের বেড়ে চলা প্রবণতা। প্যাকেটজাত স্ন্যাকস, তৈরি খাবার, কোমল পানীয় এবং ফাস্টফুড—এইসব খাবার আধুনিক খাদ্যাভ্যাসের বড় একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বব্যাপী গবেষণা বলছে, অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবারের উচ্চমাত্রায় গ্রহণের ফলে, দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ, অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্যহীনতা, স্থূলতা এবং ইনসুলিন প্রতিরোধ-এর মত সমস্যা তৈরি হয় এগুলো সবই ক্যান্সার সৃষ্টির বড় কারণ হিসেবে কাজ করে।
তাহলে আসলে গুরুত্বপূর্ণ কী?
স্বাস্থ্য সচেতনতার ক্ষেত্রে অনেকেই একটি 'সুপারফুড' খুঁজে নেন বা কোনো 'খারাপ' খাবার পুরোপুরি এড়িয়ে চলতে চান। কিন্তু বাস্তবতা হলো, একক কোনো খাবারই আপনার স্বাস্থ্য গড়তেও পারে না, ভাঙতেও পারে না। আসল গুরুত্ব রয়েছে সামগ্রিক খাদ্যাভ্যাসে—আপনি কতটা বৈচিত্র্যময় এবং সুষম খাবার খান, সেটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে, ফলমূল, সবজি, সম্পূর্ণ শস্য, বাদাম, বীজ এবং জলপাই তেল, অ্যাভোকাডো ও মাছের মতো স্বাস্থ্যকর চর্বিতে সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার ওপর জোর দেওয়া উচিত। এসব খাবার উচ্চমাত্রায় ফাইবার ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সরবরাহ করে, যা শরীরে প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে। প্রদাহ কমানো মানেই দীর্ঘমেয়াদি রোগের (যেমন হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সার) ঝুঁকি হ্রাস করা।
এছাড়া, সুস্থ থাকা মানে আপনার প্রিয় খাবার একেবারে ছেড়ে দিতে হবে—এমন নয়। মাঝেমধ্যে কেকের টুকরো খাওয়া ঠিক আছে, যদি আপনার প্রতিদিনের খাবারের বড় অংশ হয় সতেজ ও পুষ্টিকর উপাদানে ভরা। ডিমও খাদ্যতালিকায় থাকতে পারে, তবে অতিরিক্ত গ্রহণ এবং প্রদাহ সৃষ্টিকারী অন্য খাবারের সাথে অতিরিক্ত সংমিশ্রণ ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া
বাংলাদেশ সময়: ১২২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২৫
এমএম