আমেরিকায় গবেষণারত বাংলাদেশের প্রকৌশলী সৌগত সরকার হিল্লোল ক্যান্সার চিকিৎসার এমন একটি পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করছেন, যা দিয়ে দেহের সুস্থ কোষগুলোর কোনো ধরনের তিসাধন না করে পুরো ক্যান্সারে আক্রান্ত অংশটি স্থায়ীভাবে ধ্বংস করা যায়। ক্যান্সার থেরাপিতে কার্বন ন্যানোটিউব ব্যবহারের এ পদ্ধতি ক্যান্সার চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে চিকিৎসকরা মনে করেন।
বর্তমানে প্রচলিত ক্যান্সার রেডিও থেরাপি, কেমোথেরাপি এবং লেজার থেরাপির প্রধান সমস্যা হলো এদের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার সময় বহু সুস্থ কোষ এবং টিস্যু মারা যায়। এই পদ্ধতিগুলোর আরেকটি বড় সমস্যা, ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষগুলি থেরাপির কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পুনরায় বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষগুলোকে কয়েক মাস পর পর থেরাপি দেওয়া অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
দেহের সুস্থ কোষগুলোর কোনো ধরনের তিসাধন না করে পুরো ক্যান্সারে আক্রান্ত অংশটি স্থায়ীভাবে ধ্বংস করার ল্েয একটি কার্যকর ও অত্যাধুনিক লেজার ক্যান্সার থেরাপি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশী এই প্রকৌশলী, যা দিয়ে মাত্র একবার থেরাপি দেওয়ার পর ক্যান্সার কোষগুলো আর বৃদ্ধি পাবে না। এই থেরাপিতে কার্বন ন্যানোটিউব ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
কার্বন ন্যানোটিউব প্রচুর পরিমাণে লেজার লাইট আকর্ষণ করে এবং এদের তাপ পরিবাহী মতা প্রচুর। মূল গবেষণা শুরু করার আগে সৌগত প্রমাণ করেন যে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত ন্যানোটিউব শরীরে প্রবেশ করালে তা কোষের তি করে না, অর্থাৎ এটি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত নন-টক্সিক। এ ধরনের সফল প্রমাণ পাওয়ার পর টিউমারের ভিতরে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ন্যানোটিউব প্রবেশ করানো হয়। এই গবেষণার জন্য ইঁদুরের শরীরে মানবদেহের কিডনি ক্যান্সার এবং স্তন ক্যান্সারের টিউমার বৃদ্ধি করানো হয়েছিল। যেসব টিউমার চামড়ার নিচেই অবস্থান করছিল, সেগুলোতে সরাসরি ন্যানোটিউব ইঞ্জেক্ট করা সম্ভব হয়। কিন্তু কিছু টিউমারের অবস্থান আরো গভীরে ছিল। সেসব ক্ষেত্রে ন্যানোটিউবগুলো রক্তনালীতে ইঞ্জেক্ট করা হয়েছিল যাতে রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে ন্যানোটিউবগুলো নির্দিষ্ট গন্তব্যে অর্থাৎ ক্যান্সার কোষগুলোতে পৌঁছাতে পারে। ন্যানোটিউবগুলো যাতে শুধু ক্যান্সার কোষগুলোতে যুক্ত থাকতে পারে, তার জন্য ন্যানোটিউবগুলোকে কিছু নির্দিষ্ট এন্টিবডি দিয়ে যুক্ত করা হয় যা বিভিন্ন প্রকার ক্যান্সারকোষের পৃষ্ঠদেশের প্রোটিনের ওপর নির্ভরশীল। এদিকে সুস্থ কোষগুলোতে ন্যানোটিউবগুলো যুক্ত হতে পারে না, কারণ এদের পৃষ্ঠদেশে ওই উপযুক্ত প্রোটিনগুলো তৈরি হয় না। যখন ক্যান্সার টিউমারগুলো ন্যানোটিউব দ্বারা পূর্ণ থাকে, তখন তাদের নিয়ার-ইনফ্রারেড লেজার দিয়ে থেরাপি দেওয়া হয়। লেজার থেরাপির সময় কার্বন ন্যানোটিউবগুলো প্রবলভাবে লেজার লাইটকে আকৃষ্ট করে। এই আকর্ষণের ফলে আলোকশক্তি খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই তাপশক্তি শুধু টিউমারের ভিতরেই তৈরি হয়, কারণ ন্যানোটিউবগুলি শুধু টিউমারের ভেতরেই অবস্থান করে। এই রূপান্তরিত তাপশক্তি শুধু ক্যান্সার কোষগুলোকেই ধ্বংস করতে পারে, সুস্থ কোষগুলোর কোনো তিসাধন না করে।
কার্বন ন্যানোটিউবের মাধ্যমে লেজার থেরাপি দুইভাবে ক্যান্সার কোষগুলোকে ধ্বংস করে : ১. প্রচুর পরিমাণ তাপশক্তি তৈরি করে এবং ২. অত্যন্ত বিক্রিয়াশীল ফ্রি-র্যাডিকেল তৈরি করে। লেজার থেরাপির পর ইঁদুরগুলোকে কয়েক মাস পর্যন্ত পর্যবেণ করে দেখা যায় যে এদের মধ্যে কোনো ধরনের ক্যান্সারকোষ আর বৃদ্ধি পায়নি।
লেজার ক্যান্সার থেরাপি বর্তমানে প্রচলিত অন্যান্য ক্যান্সার চিকিৎসা পদ্ধতির তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর। কারণ এই পদ্ধতিতে সুস্থ কোষের কোনো তি না করে ক্যান্সার কোষগুলোকে স্থায়ীভাবে ধ্বংস করা যায়। এই থেরাপি একবার নেওয়াই যথেষ্ট, বার বার চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। এই থেরাপিতে একটি বড় আকারের টিউমার (২০ মিলিমিটার) ধ্বংস করতে খুবই স্বল্প লেজারশক্তির প্রয়োজন হয় (৩-৫ ওয়াট) এবং থেরাপিতেও খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না (৩০ সেকেন্ড)।
সৌগত আশা করেন এই ক্যান্সার থেরাপি অদূর ভবিষ্যতে ক্যান্সার চিকিৎসায় মানব সমাজের যুগান্তকারী কল্যাণ সাধন করবে।
বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ভার্জিনিয়া টেক থেকে মেকানিক্যাল ও বায়োমেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি সমাপ্ত করে সৌগত এখন জর্জিয়া টেক প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের বত্রিশ নিবাসী মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সমরেন্দ্র সরকার এবং ‘রতœগর্ভা মা’ চিত্রা সরকারের কনিষ্ঠ পুত্র।
প্রয়োজনে যোগাযোগ: [email protected]
বাংলাদেশ সময় ২১৫৫