ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

রোমাঞ্চকর বান্দরবান(২য় পর্ব)

মুনজুরুল করিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১১
রোমাঞ্চকর বান্দরবান(২য় পর্ব)

যাত্রা শুরু করতে করতে বেলা সাড়ে বারোটা বেজে গেল। এবার আমরা যাবো বাংলাদেশের এক সময়ের সর্বোচ্চ পর্বত কেওক্রাডং।

বগা লেক থেকে হাঁটা শুরু করতেই বাম পাশে চোখে পড়লো রেষ্ট হাউজ তৈরির জন্য দুটি ভিত্তিপ্রস্তর। অর্থাৎ এই নির্মল আর বুনো সৌন্দর্য প্রকৃতিকে গ্র্রাস করবে ইট-পাথর এর রুক্ষতা।

কিš‘ না বগালেক পাড়ার বাসিন্দারা এটা চায়না। আমরাও চাই না, এর মাধ্যমে পাহাড়ে বসবাসকারীদের মধ্যে এতটাই আধুনিকতা ঢুকে যাক যে, তা তাদের দীর্ঘ এতিহ্যবাহী স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে। আমাদের পা চলতে থাকলো ওপরের দিকে। বগালেক পাড়া পড়ে রইলো পেছনে। আগের রাতের ভয়ংকর যাত্রার পর মূলত শরীরের জোরে নয়, মনের জোরে চলতে থাকলো পা। অবশ্য সবার ক্ষেত্রে এমনটা নয়। আমাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর আর মামুন তখন হাঁটতে সুবিধার জন্য লাঠি নিয়েছে হাতে।

পাহাড় আসলে একটা অবোধ্য রহস্যই বটে! এটা আরো বেশি করে বুঝলাম এবার। একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে, পিচ্ছিল পাহাড়ি পথ। সাবধানে উঠে যাচ্ছি ওপরে। উচু উচু পাহাড়গুলো তখন নিচে পড়ে যাচ্ছে। ওপর থেকে দেখলে মনে হয় পায়ের কাছে এক মেঘ-পাহাড়ের রাজ্য ফেলে আকাশে উঠে যাচ্ছি। একটু পরেই আড়াল হয়ে যায় সে দৃশ্য। মনোযোগ বাড়ে পায়ে চলা পিচ্ছিল পথের ওপর। মনে হয়, সামনের অংশটুকু উঠে গেলেই শেষ, আর উঠতে হবে না, এত বড় পাহাড় আর ডিঙ্গাতে হবে না।

সে উচ্চতা পেরোনোর পর দেখা যায় সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরও বড় উ”চতার চ্যালেঞ্জ। ঘেমে-নেয়ে শরীর আর জামা-কাপড় ভিজে যায়, শরীরের সব জমানো শক্তি যেন শেষ হয়ে আসে। কিš‘ চোখের সামনে বারবার ফিরে আসে মেঘ-পাহাড়ের সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য। মনে হয় একই জায়গায় বারবার ঘুরছি, এ পথ বুঝি শেষ হবে না। আর এত উচু থেকে নিচের পৃথিবীকে যতটা অবাক করা সুন্দর দেখায়, হাতে ততটা সময় থাকে না একটু বসে সে দৃশ্য উপভোগ করার। কারণ, আমাদের গন্তব্য আরো দূরে, আরো ওপরে। কিš‘ যত কষ্টই হোক, সময়ের সাথে যত যুদ্ধই করতে হোক সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে মানুষকে বিরত রাখে সাধ্য কার। তাইতো না দেখা রঙের প্রজাপতি, বুনো ফুল দেখে অবাক হয়ে যাওয়া শহুরে চোখ থমকে দাঁড়ায়। সাথে সাথে পা-ও। এভাবেই ৮ জনের মধ্যে পিছিয়ে পড়ে কেউ কেউ। তারপর দ্র“ত পা ফেলে আবারো দলের অন্যদের ধরে ফেলার চেষ্টা। এই কঠিন পথের মাঝে মাঝে আছে শান্তি আর শরীর-মন জুড়িয়ে দেয়ার প্রাকৃতিক ব্যবস্থা।

একটু পর পরই চোখে পড়ে সুউ”চ পাহাড় থেকে অবিরাম ঝরে পড়া ঝর্ণার জল। আর পথে পথে বয়ে চলা ক্ষীণ পাহাড়ি জলের ধারা। সেই স্ব”ছ জলধারাই পথের ক্লান্তি দূর করে আমাদের, দূর করে তৃষ্ণা।

চলতে চলতে আর যখন পা উঠছিল না ঠিক তখনি...পুরো পাহাড় জুড়ে অনেক উচু থেকে পানি পড়ার শব্দ পাওয়া গেলো। মনে হলো আশপাশের সবগুলো পাহাড়েই শব্দের প্রতিধ্বনি হচ্ছে। সেই শব্দের মধ্যেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, এভাবে আরও কিছুটা পাহাড়ি পথ। তারপর যে দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো তা দেখলে নিমিষেই চলে যায় সব ক্লান্তি। অঝোর ধারায় পাহাড়ে নিজের পথ করে নিয়ে ছুটে চলেছে জলধারা। পাথরের সাথে সেই জলের ধাক্কায় যে শব্দের মাধুরী সুরের মতো সেটাই আমরা শুনতে পেয়েছিলাম অনেক আগে থেকেই। সে পথে ছড়িয়ে থাকা বড় বড় পাথরগুলো যেন কতশত বছর আগের। ভিজে থাকতে থাকতে হয়েছে ভয়ানক পিচ্ছিল। কিš‘ ক্রমাগত পা চালানোর ক্লান্তিগুলো তখন যেন উবে গেল নিমেষেই।

নতুনভাবে উজ্জ্বিবিত অভিযাত্রী তখন সবাই। দুই হাতের পাতা ভরে স্ব”ছ ঝর্ণার জল ঢক ঢক করে গিলতে থাকলো সবাই। এরপর সকল ঝুঁকি উপেক্ষা করে পাথরে খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে কখনো পাথর ধরে কখনো হেলে থাকা গাছের ডাল ধরে বলতে গেলে বুনো ঝর্ণা বেয়ে ওপরে উঠে যেতে থাকলো সবাই। লাঠিতে ভর দিয়েও অনেক কষ্টে যারা হাঁটছিলো সেই মামুন আর জাহাঙ্গীরকেও ঠেকানো গেলো না। ঝর্ণার সৌন্দর্য উ”ছাস তখন উত্তেজনার পর্যায়ে চলে গেছে। কোন সতর্কতাতেই ঠেকানো গেলো না কাউকে। ওহ, এই ঝর্ণার নামটাই তো বলা হলো না। নাম চিংড়ি ঝর্ণা। একটা সময় আবার মনে পড়লো, নাহ, এটা আমাদের গন্তব্য নয়। যেতে হবে বহুদূর-কেওক্রাডং। ততক্ষণে ভিজে-নেয়ে একাকার সবাই। আবার সেই আরও  ওপরের দিকে শুরু হলো হাঁটা। এরমধ্যে কিছুক্ষণ পর পর পায়ের সাথে চুম্বকের মতো আটকে থাকা জোঁক দেখে লাফালাফি করেছে সবাই। ক্রমাগত ওপরের দিকে উঠতে উঠতে আবারও পাহাড় জুড়ে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট আর জোড়ালো হয়ে উঠতে লাগলো। একটা সময় আবারো চোখ আটকে গেলো সামনের দিকে দুরের একটা পাহাড়ে। অনেক দুর থেকে দেখা গেলো, আরো বড় আকারের জলের পতন। হাতে থাকা হ্যান্ডি ক্যাম থেকে জুম করে দেখে বুঝলাম চিংড়ির চেয়ে আরও বড়, আরও বিস্ময়কর, আর অনিন্দ্য সুন্দর কিছু অপেক্ষায় আছে আমাদের। ধীরে ধীরে আরো স্পষ্ট আর জোড়ালো হয়ে আমাদের কান দখল করে নিলো জলের পতন-শব্দ। চেমা ঝর্ণা। হ্যাঁ, আমরা পৌঁছে গেলাম সেই পাহাড় নিংড়ে ঝরে পড়া জলধারার কাছে।

এর সামনে দাঁড়িয়ে আগের মুগ্ধ হয়ে দেখা চিংড়ি ঝর্ণাকে আর কিছু মনে হলো না। চিংড়ি ঝর্ণার একটা রহস্য ছিল যে, ঠিক কোন দিক দিয়ে ঝরে ঝরে পড়ছে পানি তা ষ্পষ্ট ছিল না। কিš‘ চেমা ঝর্ণা খুলে রেখেছিল সব রহস্য আর সৌন্দয্যের দ্বার। সরাসরি ঠিক যেন মাথার ওপর থেকে ঝরে পড়ছে। জলের ঝরে পড়ার গতির কোন রকমফের নেই। মনে হয়, এই জলের ধারা বুঝি অনন্তকাল ধরে পাথুরে পাহাড় থেকে পড়ছে নিচে।

প্রকৃতি এভাবেই নিজের কিছু গুপ্তধন আড়াল করে রেখেছে লোকচক্ষু থেকে। এ সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে সাহসী হতে হয়, কষ্ট স্বীকার করতে হয়, রোমাঞ্চপ্রিয় হতে হয়। এবার দলের সদস্যদের উচ্ছাস আগের অন্য সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গেল। টিপু পিচ্ছিল পাথরের ওপর খুব সাবধানে পা ফেলে চলে গেল উ”ছল তরুণী ঝর্ণার জল যেখানে ঝরে পড়ছে সেখানে। তারপর নিজেকে যেন হারিয়ে ফেললো। নাহ, শুধু ছবি তুললেই হবে না। এমন অবাক করা সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে হবে। আমিও চলে গেলাম সেখানে। ঢুকে পড়লাম সে ঝর্ণার ভেতর। শীতল জলে স্নিগ্ধ হলো ক্লান্ত শরীর। নাহ, এখান থেকে কোথাও যাবো না...

http://www.banglanews24.com/LifeStyle/detailsnews.php?nssl=2721

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।