ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

ঘরে ফেরার কাল

এসএম কুঞ্জ বিহারী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১২
ঘরে ফেরার কাল

তোমার নাম কী?
আমার !
হ্যাঁ, তোমার । কেন মনে পড়ছে না ?
আমার নাম...

ভালো, ভালো।

নিজের নামটাই ভুলে গেছ। অন্য কারও নাম মনে আছে, আপন কিম্বা কাছের কেউ ?

কাগজ, মাঝে-মাঝে একটা রহস্যময় ডাক আর মিথের পাখিরা।
কারা তারা, কোথায় সে সব ?

জানি না। মনে পড়ছে না। শুধু একটা জিনিস মনে পড়ছে। কতদিন যেন আমি কিছু লিখছি না !
ও. . . .। তুমি তাহলে লেখক!

না না আমি  লেখক নই।
তাহলে?

মনে হয় ঈশ্বর. . .
চমৎকার, চমৎকার, তুমি ঈশ্বর !
আমার নাম মনে পড়েছে। চিন্ময়. . .

আগে পিছে কিছু নেই ?
কেন ?
না, মানে সবারই তো থাকে।
জানিনা। শুধু জানি আমার একটা বিড়াল আছে।

বিড়াল ! কোথায় ?
আমার সাথে।

বাহ ! বেশ চকচকে কালো রঙের. . .
হ্যাঁ। অ্যালানপোর বিড়াল।

এডগার অ্যালানপো ?

হ্যা। ও অ্যালানপোর কালো বিড়াল। খুব সন্তর্পণে এগিয়ে এসে থাবা গেঁড়ে বসে। আ”ছা, আপনি কে ?

তুমি কি হারিয়ে গেছো ?
মনে হয়।

ভালো করে ভেবে দেখো ।

হ্যাঁ হারিয়ে গেছি। আপনার বিশ্বাস হ”েছ না! কেউ একজন আমাকে ডেকেছিলো। আমি আমার বন্ধ ঘরের দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি আলোর সমুদ্র। সে আমাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিলো চন্দনের বনে। সুগন্ধি সেই বনে হাঁটছিলাম আমরা।

সে কে?
একটা মেয়ে।
নাম কী তার ?

নাম মনে নেই। শুধু তার গায়ের গন্ধ আর চুলের গন্ধ মনে আছে।
তারপর কী হলো ? তোমরা হাঁটছিলে . . .

আমরা চন্দনের বন পেরিয়ে চম্পা পারুলের বন পেরুলাম। আমি তাকে বলেছিলাম- আমি ঈশ্বর ! আমি তোমার নিয়তি পাল্টে দেব।

উফ, আবারো সেই ঈশ্বর, ঈশ্বর । কিসের এবং কোন নিয়তি ?
আমার মনে নেই। একটা আয়না ছিলো জানেন। একদম আমার লেখার টেবিল বরাবর। ওটার ভেতরে বাগান ছিলো, ফুল, পাখি, লতাগুল্ম।   মনে পড়েছে - ওর নাম ঈভ। ও আমার গল্পের প্রথম মানবী।

ঈভ ! তোমার গল্প ? কিš‘ তুমি না বলল্লে তুমি লেখক ।
আমি জানি না। আমি কিছু জানি না ।      
কেন জান না ? বল, সব কিছু বল ।

কী বলবো?
তোমার কথা । ঈভের কথা ।
আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম অর আর আদমের স্বর্গবিচ্যুতি ঘটবে না । আমি পাল্টে দেব সেই সব মিথ।
তারপর?

আর ছিলো ফলবতি গন্ধম বৃক্ষ । লোভ আর লালসার টুকটুকে লাল আপেল।
ঈভ সেটা ছিঁড়েছিলো ?

আমি বারবার কলম ধরেছি জানেন। আমি নিয়তি পাল্টে দিতে চাই। কিš‘ কলম থেমে গেছে বারবার । আমি পারিনি ।
কেন ?

আমি যে ঈশ্বর। আমার কলমেই তৈরি হয় এক একটি  রক্ত মাংসের চরিত্র। ওদের সুখ, দঃখ, হাসি, কান্না, প্রেম, বিরহ, মৃতু সব আমি নির্ধারন করি। কলমে আমি সর্বশক্তিমান।

তাহলে ?
কী ?

নতুন নিয়তি লিখতে পারলে না কেন?
আমি ভুলে গিয়েছিলাম , আমার মাঝেও কেউ একজন কোন কিছু তৈরী করে।

কে সে ? প্রকৃত ঈশ্বর ?
আমি জানি না।
তোমার এই নিয়তি কি তবে তিনিই বেঁধে দিয়েছেন?
উফ ! আপনি কি একটু চুপ করবেন !
ঈভের কী হলো ? আদম সহ স্বর্গচ্যুতি !

আমি তা চাইনি ।
তবে কি চেয়েছিলে ?
ওরা ভালো থাক । আমি যে কোনো মূল্যে ওদের নিয়তি পাল্টে দিতাম ।
কিš‘ কী হলো ?

স্রষ্টা যখন সৃষ্টির প্রেমে পড়ে, সে প্রেম হয় আত্মঘাতী ।
তোমারও কি তাই হয়েছিলো ?

হ্যাঁ, আমি সব কিছু জেনে বুঝে আমার সৃষ্টির প্রেমে পড়েছিলাম। আমি আমার কবিতায় ঈভের শরীর গড়েছি। প্রতিটি ছন্দ, গন্ধ, উপমা দিয়ে ওর ঠোঁট, চোখ, মুখ, চুল, হাত, এঁকেছি । আমার প্রতিটি গল্পে বর্ণনা করেছি ওর মন ও মানস । এ ছিলো আমার প্রম ও পূর্ণাঙ্গ  সৃষ্টি।

তাহলে আদম?
সে ছিলো ঈভের জন্যই সৃষ্টি। তার চিরকালীন প্রেমিক। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম; কিš‘ সে কথা রাখতে পারেনি।
কেন ?

আমি জানি না। আমি মনেপ্রাণে পাল্টে দিতে চেয়েছিলাম গন্ধম নিয়তি। কিš‘...

কিš‘ কী ?
একটি জায়গায় এসে বারবার আটকে গেছে কলম। কোনো অদৃশ্য শক্তি আমাকে লিখতে দেয়নি নতুন ইতিহাস। আমি নিজের অজান্তে সত্যিই চাইতাম ঈভ যেন না ছেঁড়ে সেই গন্ধম বৃক্ষের ফল। তাহলে আমি শুধু তার একার জন্য লিখবো আরেক স্বর্গীয় উদ্যান। সেই উদ্যানে আদম নেই । থাকবো শুধু আমি আর ঈভ। আজন্ম স্রষ্টা ও সৃষ্টি।   কিš‘...
সেসব তুমি পারোনি ।

হ্যাঁ, আমি নিয়তি বদলাতে পারিনি। আমার নিয়তি গ্রাস করেছে আমার সৃষ্টিকে। ঈভ ছিঁড়েছিল সেই ফল। আর কোনো এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে দিয়ে পূনর্বার লিখিয়ে নিলো সেই একই ইতিহাস। আদমের গন্ধম ফল ভক্ষণ ও স্বর্গচ্যুতি ।

আমি শুধু পড়ে রয়েছি আমার নিজের বানানো স্বর্গে। ঈভের জন্য বানানো স্বর্গে। একা এবং একা...

তারপর ?
তারপর একদিন নিজের বানানো স্বর্গে কোথায় যে হারিয়ে গেলাম। নিজের গড়তে চাওয়া নিয়তির অভিশাপে নিজেই এখন বন্দি কাঠগড়ায়। ভাবুন, স্রষ্টা যখন বন্দি হয় সৃষ্টির শেকলে তখন পরিণতি কী ভয়াবহ হয় !

কিসের অভিশাপ ?
ওদের। আমার সকল সৃষ্টির। আদম, ঈভ, স্বর্গীয় উদ্যান, চন্দনের বন, চম্পা পারুলের বন, ফলবতি গন্ধম বৃক্ষ, সব সব ।   সবাই ওরা একে একে ছেড়ে যা”েছ আমায়। শুধু কবে কখন যেন ঘাপটি মেরে ছায়াসঙ্গী হয়ে গেছে এই বিড়াল।

অ্যালানপোর বিড়াল। এই দেখুন, আমার আহত হৃদপি-ের রক্ত এখনও লেগে আছে ওর কালো থাবায়। কেমন চাটছে ওটা নিজের থাবা !

তোমার সৃষ্টির অভিশাপ ?
হ্যা, আমার লেখার আয়নায় গভীর রাত হলে ওরা প্রায় আসে। আমাকে বিদ্রুপ করে। শুন্য সাদা খাতা আর নিষ্ফলা কলম নিয়ে হাসাহাসি করে। কানের সামনে ফিসফিস করে বলে- তুমি বাদ, তুমি বাদ আমাদের এই আসর থেকে। আমরা তোমাকে বয়কট করলাম।

ঈভ ?
সে দুঃখময় হতাশ চোখে আদমের হাত ধরে দেখতে থাকে স্রষ্টার পরিণতি। ফলবতি গন্ধম বৃক্ষ আমাকে অভিশাপ দেয় ঈভ যখন ছিঁড়েছিল তার ফল, তখন স্বর্গ উদ্যানে গড়িয়ে পড়া রসের প্রতিশোধে মাসে একবার রক্ত ঝরবে ঈভের গর্ভমূল থেকে। আমি কলমে বারবার লিখি না, না। গন্ধম বৃক্ষ তবুও অভিশাপে অবিচল।

তুমি কী করলে ?
ঈভ মাথা পেতে নিয়েছিলো ওই অভিশাপ। আমিও তাই নিজের জন্য চেয়ে নিয়েছি একই অভিশাপের ডালা।

মানে?
এখন আর আমি লিখতে পারি না। আমার আর সৃষ্টির কোনো ক্ষমতা নেই। শুধু মাসে একবার যখন আকাশে পূর্নিমার চাঁদ ওঠে, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে চন্দন চম্পা পারুলের ঘ্রাণ,০ তখন আমার কলম রজঃস্বলা হয়। আমি আবার লিখি ঈভের কথা। আমার সৃষ্টি আমার প্রেম।

কিš‘ সত্যিই কি কোনো লেখক না লিখে থাকতে পারে? তুমি কি সত্যিই আর লেখ না !
না। আমি লিখিনা।

আমি আসলে তোমার গল্পটা বুঝিনি ।
এটা গল্প নয়। আর কেউ বুঝবেও না। শিল্পীর মন ও মানস বইয়ের পাতা নয়, যা পড়ে বুঝে নেবে। শুধু বলি, আমি আমার সৃষ্ট স্বর্গের একমাত্র বন্দি।

কিš‘ তুমি ঘরে ফিরবে না? তোমার লেখার টেবিল, আয়না, কলম, কাগজ . . .
জানিনা। আমি আমার ঘর ভুলে গেছি।

কিš‘ চিন্ময়, আমার মনে হয় এটা তোমার ঘরে ফেরার কাল। বল, তোমার ঘর কোন দিকে ?
কে জানে ? হতেও পারে এটা ঘরে ফেরার কাল। কিš‘ পথের ঠিকানা যে নেই !  যে আমাকে হাত ধরে নিয়ে এসেছিল এই স্বর্গে তার জন্যতো এখন নির্ধারিত ধুলো মাটির পৃথিবী। আর দুইয়ের মাঝে সীমার অসীম দূরত্ব !

তাহলে কী হবে ?
তাও জানিনা। সৃষ্টি যখন স্রষ্টাকে ছেড়ে যায়, তখন ব্রহ্মা-লোকে পড়ে থাকে শুধুই হতাশা । আমিও ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, বিষাদগ্রস্ত ও হতাশ।

এমনতো তুমি একা নও। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছেন, যারা নীরবে নিভৃতে হারিয়ে গেছেন সৃষ্টির অতল গভীরে। কেউ কেউ বেছে নিয়েছে আত্মধংসের পথ। অনেকে ধুকে ধুকে মরছে অন্ধকোণে। আবার অনেকে কিš‘ নিজের প্রজ্ঞা, জ্ঞান, সাহস আর মনোবল নিয়ে ঘুরেও দাঁড়িয়েছে।

হ্যাঁ, জানি। হয়তো! আমিও হয়তো চেষ্টা করবো ঘরে ফেরার। প্রজ্ঞা সাহস আর মনোবলের এই ভগ্ন¯‘পে নয়তো অ্যালানপোর এই বিড়ালটাকে সাথে নিয়েই নতুন করে দেখবো আত্মধংসের জটিল বিজ্ঞান।

কিš‘ কেন ? কেন তুমি ঘুরে দাঁড়াবে না ?

আপনাকে ধন্যবাদ। আমার সব মনে পড়ছে এখন। এই সময়, আমি, আমার সৃষ্টি, পরিণতি সব।
তুমি বলো না- কেনো আয়ত্বে নিতে চাও আত্মধংসের পথ?
পৃথিবীর সব কিছু যেমন ভিন্ন, নানা রঙ, নানা আকারের, তেমনি মানুষের অনেক মিলের মাঝে কেউ কেউ থাকে অমিল।  

যেমন ছিলেন মানিক বন্দোপাধ্যায়।
এটা নিছক পাগলামি।

হয়তো। সু¯’ মানুষের ভিড়ে অসু¯’ পাগলামির বীজ সবাই চাষ করে না। আবার কেউ কেউ গোলাভরা ফসল ফলায় নবান্নের হাসিতে। কলমে আমি ঈশ্বর ছিলাম। কিš‘ আমি নিজের সৃষ্টির নিয়তি লিখতে পারিনি। সৃষ্টির না হোক, নিজের নিয়তি তো  লিখতে পারি।

না, তুমি পারো না ।
পারি, অবশ্যই পারি। নিজের ঈশ্বর আমি নিজেই। এ এক দুর্দমনীয়  আনন্দ ।
তবে ঘরে ফেরা ?

ঘরে আমি ফিরবো শেষবার। শেষ লেখার টেবিল, শেষ আয়না, শেষ সৃষ্টি ।
কবে ? কবে  ফিরবে সেই ঘরে ?
সে কাল হয়নি এখনো। হয়তো আজ, এখনই। নয়তো কোনদিনই নয় . . .

যেদিকে ই”েছ পালাও দু’পায়ে, এইটুকু থাক জানা
চারদিকে আমি
কাঁটাতারে ঘিরে শাস্ত্রী বসিয়ে পেতে আছি জেলখানা।
(হুমায়ুন আজাদ)


বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।