হ্যাঁ রে সোনা, চাইলেই হারিয়ে যাওয়া যায় বুঝি! কত খুঁজে আজ পেলাম তোকে! মোবাইলটাও বন্ধ করে রাখলি। অথচ বাবা তোকেই বেশি ভালবাসত।
বুবুর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। বুবুকে আগে কাঁদতে দেখিনি। মা যখন মারত আমরা দৌড়ে পালাতাম কিন্তু সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খেত। পালাতনা আবার কাঁদতও না । এমনই একরোখা জেদি মেয়ে ছিল সে। আজ তাকে কাঁদতে দেখে আমার বুকের ভেতরে কি যেন হয়ে গেল।
বারবার তোকে দেখতে চাচ্ছিল। পাগলের মত বলেছে, সোনাকে ফিরিয়ে এনে পড়ালেখা করাবি তোরা । আর কটা দিন আগে তোকে যদি পেতাম
আমার ছাইবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে বুবু চুপ করে গেল । হাত টেনে বলল, বাড়ি চল ।
বাড়ি! কোন বাড়ি যাব আমি? যে বাড়িতে বাবা নেই সেটা তো আমার বাড়ি নয় । কয়েকটা ইট কাঠের দেয়াল দেখতে আমি কেন যাবো?
শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি এক সকালে দুই কন্যাসন্তানের পর আমার মা যখন তৃতীয় বার কন্যা সন্তানের জননী হয়েছিলেন শ্বশুর বা বাবার বাড়ির কেউই খুশি হলেন না । মুরুব্বীরা গম্ভীর মুখে ভাবতে লাগলেন, বংশের বাতি দেবে কে ! শুধু আমার নানু উৎফুল্ল হয়ে আমার বাবাকে বললেন,“দেখো, কেমন চাঁদের মত মুখ হইছে মেয়ের! এই মেয়ে তোমার ঘরে সোনার মোহর নিয়া আসবো। বড় ভাগ্যবান হইব এই মেয়ে”।
কালো মেয়েকে এত আহ্লাদ দেয়া দেখে কেউ কেউ নানুর দিকে বাঁকা হেসে তাকালেও মুখে কিছু বলার সাহস পায়নি। সত্যিই চন্দ্রের মত মুখ মেয়ের ।
তাঁর অল্প কিছুদিন পরেই আমার মা সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা পদের বহু আকাঙ্ক্ষিত চাকরিটি পেয়ে গেলেন। এত বছর শুধু ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছিলেন চাকরি আর হচ্ছিল না । আমার নানু বিজয়ীর ভঙ্গীতে বলেছিলেন, আমার কথা সত্যি হল তো ! আগেই বুঝেছিলাম এই মেয়ে বড় ভাগ্যবান।
গ্রামে থেকেও সেই আমলে লেখাপড়া জানা, বিজ্ঞ, আমার বৃদ্ধা নানুর কথা বাবা পুরোপুরি বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন। আস্তে আস্তে আমার নাম সোনার মোহর থেকে সোনাতে স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। পরে আমার দুটি ভাই জন্ম নিয়ে বংশের বাতি দেয়া সমস্যারও সমাধান করেছিল ।
কিছু কিছু মানুষ থাকেই পৃথিবীতে যাদের কাছে সমস্ত পার্থিব বিষয় একদিকে আর হৃদয়াবেগ আর একদিকে। আমার বাবা তেমনই একজন মানুষ। বাইরের দিক দিয়ে অত্যন্ত কঠিন ও বৈষয়িক তিনি। কিন্তু তাঁর সন্তান বাৎসল্য সব কিছুর ওপরে । সন্তানের জন্য করতে পারতেন না এমন কোন কাজ নেই । তবে তিনি সবার সম্মুখে স্নেহ প্রকাশে অনেকটা লজ্জা পেতেন ।
তার ভালবাসা ছিল গোপনে, অনেক গভীরে, নিভৃতে। মনে পড়ে, গ্রামে থাকতে বাবা আমাকে কাঁধে করে প্রায়ই খোকন ভাইয়ের লাগানো কৃষ্ণচূড়া গাছটির পাশে সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে থাকতেন চুপচাপ । পাগল হয়ে অসময়ে মারা যাওয়া আমার তরুণ চাচাত ভাইটিকে সেখানেই কবর দেয়া হয়েছিলো। বাবা খুবই ভালবাসতেন তাকে। সেই থমকে যাওয়া সময়ে কোথা থেকে ডাহুক ডেকে যেত অনবরত, জোনাকিরা ঝাঁক বেধে আলো জ্বালিয়ে আমাদের চারপাশে উড়ে বেড়াত, দু একটা বোকা জোনাকি অবশ্য পূর্ণিমার রাতে জোছনার বহর দেখে আলো নিভিয়েও ফেলত সঙ্গে সঙ্গে । কবরের পাশে আধো অন্ধকারে আমার গা ছমছম করত, বাবাকে ঋষিদের মত ধ্যানমগ্ন অনেক দূরের মানুষ মনে হত তখন । আমি অস্থির হয়ে উঠতাম ঘরে ফেরার জন্য । বাবা তবু দাঁড়িয়েই থাকতেন ।
আজ চোখ বন্ধ করে সেই হাজার বার দেখা দৃশ্যটি আমি আর একবার দেখতে চাইলাম । কিন্তু বুকের ভিতরটা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। এক ফোঁটা জলের জন্য চোখ দুটি মরুভূমির বেদুঈনদের মত হাহাকার করছে। এই পৃথিবীর কোথাও আমার বাবা নেই, এর চেয়ে অসম্ভব মিথ্যা আর কি হতে পারে ]! আমার অস্তিত্ব টলমল করে উঠল !
কিন্তু পৃথিবী আগের মতই চলছে ! বিপনি বিতানে ভিড় বাড়ছেই । ঈদের আর দেরী নেই বেশি । ক্রেতার সাথে বিক্রেতার দর কষাকষি হচ্ছে । পাশের দোকান থেকে কেউ বুবুকে ক্রেতা ভেবে ডাকছে,“ আসেন আপা, মাজাককলি, আনারকলি সব আছে আমার দোকানে । এই দোকানে আসেন । “
পাঁচ ভাই বোনের পড়ালেখা, দাদীকে টাকা পাঠানো, সংসার খরচ সব মিলিয়ে টানাটানি লেগেই থাকত আমাদের । বাবার অফিসের অবস্থাও তখন ভাল না । ক্রমাগত লসের কারণে যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে । এর মধ্যেও আমার বড় দু‘বোন সেইবার ঈদের জামা আদায় করল জোর করে । সেই অসম্ভব অর্থকষ্টের দিনে আমার কোন দাবীই ছিল না । নিজের অস্তিত্ব নিয়ে আমি বিব্রত ছিলাম সবসময় । কারো বিন্দুমাত্র সমস্যা আমি সৃষ্টি করতে চাইনি । কেউ আমার দিকে খেয়ালও করেনি । তবু মনের কোন একটা অংশ ঈদে নতুন জামা পাওয়া বোন, বান্ধবী বা অন্যদের আনন্দ দেখে নিশ্চয় কাঁদছিল । মা আমার হাতে পাঁচটা টাকা দিয়ে বলেছিলেন পরের ঈদে তোর জন্য সবার আগে জামা কিনব দেখিস । কিন্তু সেদিনই গভীর রাতে বাবা ফিরলেন নতুন জামা নিয়ে আমার জন্য । বলেছিলেন ,“দিন কি আর এমন থাকব সবসময় ! আমার সোনার মোহর অনেক বড় হইব। ওর নানীর কথা ভুল হইবনা । দেখনা শুকনা মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে তবু কাউরে কিছু বলেনা ! কত ধৈয্য মেয়ের । “পরে বুঝেছিলাম নিছক জামা নয় বাবা সেদিন জামার রুপ ধরা ভালবাসা নিয়ে এসেছিলেন তিনি আমার জন্য ।
আমার এস এস সির রেজাল্টের দিন গুরুগম্ভীর বাবা একেবারে ছেলেমানুষের মত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন । অসম্ভব ভাল ফল করায় টানাটানির সংসারেও বাবা বাইশ কেজি মিষ্টি কিনে বিলিয়েছিলেন। সব অবশ্য একদিনে কিনতে পারেননি তাই দুইদিন, চারদিন এমনকি সপ্তাহ, মাস পর পরও মিষ্টি কেনা হয়েছিল পড়শিদের জন্য। মা বলেছিল, বাবা আনন্দে কেঁদেছিলেন সবাইকে লুকিয়ে ।
মেয়েরে ঢাকা পাঠাইলে কলেজের, হোস্টেলের খরচ দিব ক্যামনে?
মায়ের প্রশ্নের উত্তরে বাবা বলেছিলেন, আমার রক্ত বিক্রি করে হইলেও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাব। ভাত রান্না, কাপড় ধোয়া, ঘর গুছানো এসব তো সবাইই পারে। বড় চাকরি করে টাকা রোজগার করে কাজের লোক রাখলেও এই কাজ করতে পারব। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সবাই হইতে পারেনা। যতদূর ও পড়তে চাই আমি পড়াব ।
মেয়েরা দেখতে বাবার মত হলে নাকি ভাগ্যবান হয় । আমি দেখতে তাঁর মত এবং আচরনেও তাঁরই মত হয়ে উঠতে লাগলাম । অন্তর্মুখী আমি কিছুতেই নিজের কথা কাউকে বলতে পারতাম না । তাই তো ভুল এক মানুষ কে ভালবাসলাম । ভুল যে তখনই জানতাম । আমার মনে হত বাবা মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ভাববে, সুনু , তুই এ কি করলি ! তাই বাবার সামনে সেই ভুলটুকু নিয়ে দাঁড়াবার সাহস পাইনি । মনে ছিল ভালবাসা দিয়ে অসুন্দরকে বদলে দেয়ার নাটকীয় বাসনা । সেই অশুভ মানুষটিকে শুদ্ধ করার সব দায়িত্ব যেন একা আমিই নেবার মত ছিলাম । তাই সব ছাড়লাম । সব । নিজ হাতে হত্যা করলাম বাবার বোনা স্বপ্ন মহীরুহটিকে । কিন্তু নীলকণ্ঠী বা মাদার তেরেসা না হয়ে অবশেষে হলাম দোকানের সেলস গার্ল ।
অনেকক্ষণ পর বুবু আবার কথা বললেন, খোকনের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচেই শুয়ে আছে। সেখানেই যাবি চল্।
আমার বুকের ভেতরের মরুভূমিটা এতক্ষণে উদ্দাম নদী হয়ে ছুটে চলেছে । দুকূল ভাসানো দুঃখ প্লাবন আমাকে বাবার আকাঙ্ক্ষার সত্যিকারের সোনায় পরিণত করে তবে থামুক । পোড়া চোখ দুটি বুঝি জীবনে এই প্রথম সমুদ্রের দেখা পেয়েছে । সমুদ্রের জল লোনা, চোখের জলও কি কম !