প্রতি অঙ্গ কাঁদে তব প্রতি অঙ্গ - তরে ।
প্রাণের মিলন মাগে দেহের মিলন ।
হৃদয়ে আচ্ছন্ন দেহ হৃদয়ের ভরে
মুরছি পড়িতে চায় তব দেহ -` পরে ।
তোমার নয়ন পানে ধাইছে নয়ন ,
অধর মরিতে চায় তোমার অধরে ।
দেহমিলন নামে চতুষ্পদী কবিতার শুরুতে কবিগুরু ওপরের যে চরণগুলো লিখেছেন, তা যেন প্রেম ভালবাসার একেবারে মোদ্দা কথা -‘অধর মরিতে চায় তোমার অধরে’! সত্যই তো। চুমু বিহীন প্রেম - যেন অনেকটা লবণহীন খিচুড়ির মতোই বিস্বাদ!
তাই ভালবাসার কথা বললে অবধারিতভাবেই চুমুর কথা এসে পড়বে। ভালবাসা প্রকাশের আদি এবং অকৃত্রিম মাধ্যমটির নাম যে চুম্বন - সেই বিষয়ে সম্ভবতঃ কেউই দ্বিমত করবেন না। কাজেই কেন কবিগুরুর কথামত আমাদের অধর মরিতে চায় অন্যের অধরে - তার পেছনের বিজ্ঞানটি না জানলে আমাদের আর চলছে না। গতবছর (২০১২ সালে) আমি একটা বই লিখেছিলাম ‘ভালবাসা কারে কয়’নামে। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল শুদ্ধস্বর থেকে। ডারউইনীয় বিবর্তন এবং বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা বাংলায় সম্ভবত প্রথম বই ছিল এটি। বইটিতে চুম্বনের বিজ্ঞান নিয়েও অনেক প্রাসঙ্গিক তথ্য ছিল, যা হয়তো পাঠকদের চিন্তার খোরাক জোগাবে।
বাঙালি, আফগানি, জাপানিজ, মালয় থেকে শুরু করে পশ্চিমা সংস্কৃতি - সব জায়গাতেই প্রেমের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চুম্বন পাওয়া যাবে। সংস্কৃতি ভেদে চুম্বনের তারতম্য আর ভেদাভেদ আছে ঠিকই - কোথাও প্রেমিক প্রেমিকাকে কিংবা প্রেমিকা প্রেমিককে চুমু খায় গোপনে, কোথাও বা প্রকাশ্যে। কিন্তু চুম্বন আছেই - মানব সভ্যতার সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে মিশে। তাই চুম্বনের বিবর্তনীয় উৎসটি আমাদের জানা চাই।
আর শুধু মানুষই নয়, অনেকে জেনে হয়তো অবাক হবেন, চুমুর অস্তিত্ব রয়েছে এমনকি অন্যান্য অনেক প্রাণীর মধ্যেই[৩]। ইঁদুর, কুকুর, বিড়াল, পাখি থেকে শুরু করে শিম্পাঞ্জি, বনোবো সহ বহু প্রাণীর মধ্যেই চুম্বনের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা গেছে। এ সমস্ত প্রাণীদের কেউ বা চুমু খায় খাদ্য বিনিময় থেকে শুরু করে আদর সোহাগ বিনিময় এমনকি ঝগড়া-ফ্যাসাদ মেটাতেও। বিজ্ঞানী বিজ্ঞানী ফ্র্যান্স ডি ওয়াল তার প্রাইমেট সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণায় দেখিয়েছেন চুম্বনের ব্যাপারটা মানব সমাজেরই কেবল একচেটিয়া নয়, আমাদের অন্য সকল জ্ঞাতিভাই প্রাইমেটদের মধ্যেও তা প্রবলভাবেই দৃশ্যমান।
কিসিং গোরামি নামে এক ধরণের মাছ আছে, যাদের মধ্যেও চুম্বন ব্যাপারটা বেশ প্রচলিত। যারা অ্যাকুরিয়ামে গোরামি মাছ পালেন, তারা প্রায়শই এদের চুম্বনলীলা দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন ।
তবে কিসিং গোরামিদের চুম্বন আসলে ‘সত্যিকার’চুম্বন নয়। এদের চুম্বন আসলে এক ধরণের দ্বন্দ্বযুদ্ধের স্বরূপ, যার মাধ্যমে তারা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে; আর সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপারটা চুম্বন হিসেবে প্রতিভাত হয়। কুকুর, বিড়াল এবং পাখিদের মধ্যে মুখ দিয়ে অবলেহন এবং পরিচ্ছন্নতানির্দেশক অনেক কিছু করতে দেখা যায়, যা অনেক সময়ই অনেকের কাছে ভুলভাবে চুম্বন বলে মনে হতে পারে। সেই দিক থেকে চিন্তা করলে মানুষের মধ্যে চুম্বনের ক্ষেত্র অনেকটাই ভিন্ন।
তাহলে মানব সমাজে চুম্বনের শুরুটা কোথায়, আর কীভাবে? বলা আসলেই মুশকিল। তবে, ১৯৬০ সালে ইংরেজ প্রাণীবিজ্ঞানী ডেসমণ্ড মরিস প্রথম প্রস্তাব করেন যে, চুম্বন সম্ভবতঃ উদ্ভূত হয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষ প্রাইমেট মায়েদের খাবার চিবানো আর সেই খাবার অপরিণত সন্তানকে খাওয়ানোর মাধ্যমে। শিম্পাঞ্জি মায়েরা এখনো এভাবে সন্তানদের খাওয়ায়, আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যেও ব্যাপারটা ঠিক এভাবেই এবং এ কারণেই তৈরি হয়েছিল। মনে করা হয় খাদ্যস্বল্পতার সময়গুলোতে যখন সন্তানকে খাবার যোগাতে পারত না, তখন অসহায় সন্তানকে প্রবোধ দিতে এভাবে মুখ দিয়ে খাবার খাওয়ানোর ভান করে সান্ত্বনা দিত স্নেহবৎসল মায়েরা। এভাবেই একটা সময় চুম্বন মানব বিবর্তনের একটি অংশ হয়ে উঠে, এর পরিধি বৃদ্ধি পায় সন্তানের প্রতি ভালবাসা থেকে প্রেমিক প্রেমিকার রোমান্টিকতায়, যার বহুবিধ অভিব্যক্তি আমরা লক্ষ্য করি মানব সমাজের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে আনাচে কানাচে, নানাভাবে।