শত ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটে মানুষের। আর ঢাকাবাসী হলে তো কথাই নেই, কাজের চেয়ে যেন জ্যামেই কাটে জীবনের বেশির ভাগ সময়।
সেন্টমার্টিনের গভীর নীল পানি, কিংবা জাফলং-এর স্বচ্ছ পানির গল্প অনেকই শুনেছেন, কিন্তু সবুজ আর নীলের মিশেলে অদ্ভূত-রঙের পানি দেখতে কেমন লাগবে একটু ভাবুন তো।
বিরিশিরির মূল আকর্ষণ হচ্ছে এ পানি। চীনামাটির পাহাড়, যার বুক চিরে জেগে উঠেছে এই নীলচে-সবুজ পানির হ্রদ। সাদা মাটির মাঝে রঙটাকে যেন আরও বেশি গাঢ় করে দিয়েছে।
তবে বিরিশিরি গিয়েই আপনি এ সুন্দর দৃশ্য আপনি দেখতে পারবেন না। আপনাকে যেতে হবে আরেকটু দূর বিজয়পুর চীনা মাটির পাহাড়ে।
এ ক্ষেত্রে আপনাকে ভাড়া করতে হবে একটি রিকশা (অবশ্য বেশি মানুষ থাকলে আরও বেশি)। রিকশাওয়ালাই আপনার গাইড হিসেবে কাজ করবে। তবে মোটর সাইকেলে করেও যেতে পারেন। এতে সময় কম লাগলেও, পয়সা বেশি লাগবে। তার মধ্যে বেশিক্ষণ ঘুরতে পারবেন না। তাছাড়া রিকশায় করে যেতে যেতে আপনি প্রকৃতির যে মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে পারবেন তা মোটরসাইকেলে গেলে পারবেন না।
যেতে পথে পড়বে সেন্ট যোসেফের গীর্জা। গীর্জাটা বেশ সাজানো গোছানো, নীরব আর খুব সুন্দর।
সোমেশ্বরী নদী পার হতে হবে। নদীর খুব সামান্য অংশতেই পানি আছে। নদীটা অনেকটাই জাফলং এর নদীর মতো। স্বচ্ছ পানি, তলদেশ স্পষ্ট। পার্থক্য শুধু জাফলং এর পাথর। অবশ্য নদীর বেশিরভাগ অংশ সবাই হেটেই পার হয়। অল্প একটু জায়গা নৌকায় পার হতে হবে। ভয় নেই! আপনার রিকশাকেও নৌকায় করে পার করা হবে।
এবার একটু জেনে নিন সোমেশ্বরী নদীর ইতিহাস: উত্তরের গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা সোমেশ্বরী নদীর আদি নাম ছিলো ‘সমসাঙ্গ’। ওই নদীর তীরে বসবাস করত ধীবররা। তাদের বলা হতো ‘পাটুনি’। বাইশা গারো নামের এক গারো তখন ওই অঞ্চল শাসন করতেন।
কিন্তু বাইশা গারোর ওপর ধীবররা সন্তুষ্ট ছিল না। তবে শক্তির অভাবে তারা তাকে মেনে নিতে বাধ্য।
১২৮০ খ্রিস্টাব্দে সোমেশ্বর পাঠক কামরূপ কামাখ্যাসহ বিভিন্ন তীর্থ দর্শন শেষে গারো পাহাড়ে আসেন। এখানকার সৌন্দর্য আর সুমসাং নদী তীরের নীরবতা সোমেশ্বর পাঠক মুগ্ধ হয়ে যান। সিদ্ধিলাভের জন্য উত্তম স্থান হিসেবে তিনি এটিকে বেছে নেনে। এলাকার জেলেদের সঙ্গে ক্রমেই তার যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
সোমেশ্বর ছিলেন অসামান্য বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও বলিষ্ঠ। ধীবররা তাকে দেবতা এবং ত্রাতা মনে করতে থাকে। তাকে ঘিরেই গড়ে ওঠে দুর্গাপুর গ্রাম (যা বর্তমানে নেত্রকোণার একটি উপজেলা)। সোমেশ্বর পাঠক সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন সঙ্গে করে নিয়ে আসা লক্ষ্মীনারায়ণের বিগ্রহ।
পরে তিনি আগের বাসস্থান কান্যকুব্জ থেকে স্বজনদের নিয়ে এসে বসতি গড়েন সেখানে। এতে তার শক্তি আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। এক সময় সুযোগ বুঝে ওই এলাকার অত্যাচারী শাসনকর্তা বাইশা গারোকে পরাজিত করে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সুসং রাজ্য’।
ওই এলাকার ধীবররা সোমেশ্বর পাঠককে সাক্ষাৎ দেবতা মনে করত। তারা ভাবত, জেলেদের উন্নতির জন্যই সোমেশ্বর ঠাকুর নিজ হাতে সুসং রাজ্য গড়েছেন। তারা এও মনে করত, সুসংয়ের মানুষের পানিকষ্ট দূর করতেই প্রভু সোমেশ্বর নিজ হাতের ‘ভৃঙ্গার’ থেকে পানি ঢেলে দেওয়ায় সৃষ্টি হয় সোমেশ্বরী নদী।
তবে অনেকেরই ধারণা, উত্তর পাহাড়ের ঝর্ণাধারা ‘সমসাং’ এর গতিপথ পরিবর্তন করে সোমেশ্বর পাঠক তা নিয়ে এসেছিলেন সুসংয়ের রাজধানী দুর্গাপুরের কাছে। এ কারণেই ওই নদীর নাম হয় সোমেশ্বরী নদী।
নদী পার হতে গেলে দেখবেন বিভিন্ন রঙের পানি সোমেশ্বরীর বুক ছিড়ে চলে গেছে বহুদূর। অবশ্য এর কারণ হলো স্বচ্ছ পানির নিচে বাহারি রঙের বালু।
নৌকায় সোমেশ্বরী নদী পাড়ি দিয়ে ওপারে গিয়ে শুরু হবে আরও দীর্ঘ রিকশা ভ্রমণ। পথের ধারে দেখতে পারবেন পাহাড়ি বিভিন্ন ধরনের ফুল।
এরপর এসে পৌঁছবেন বিজয়পুরের চীনামাটির পাহাড়ে। ছোট বড় টিলা-পাহাড় ও সমতল ভূমি জুড়ে প্রায় ১৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৬০০ মিটার প্রস্থ এই খনিজ অঞ্চল। খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৭ সালে এই অঞ্চলে সাদামাটির পরিমাণ ধরা হয় ২৪ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন, যা বাংলাদেশের ৩শ’ বৎসরের চাহিদা পুরণ করতে পারে। খনিগুলো থেকে মাটি খনন করায় এসব হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে।
পাহাড়ের ওপর থেকে তাকালেই দেখবেন তলদেশে বেশ কয়েকটি হ্রদ। আর এসব হ্রদের পানিতে চোখ পরতেই দেখবেন আসার সকল কষ্টগুলো নিমিষেই মিলিয়ে গেছে। নিরিবিলি কোলাহলবিহীন ছিমছাম শান্ত পরিবেশ মনে প্রশান্তি এনে দেয়। এমন পরিবেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেও আপনার খারপ লাগবে না। এছাড়া দু’চোখ যেদিকে যাবে দেখবেন শুধুই পাহাড়। তবে এগুলোর বেশির ভাগই ভারতে।
আপনি একটু ইচ্ছা করলেই ইতিহাস থেকে ঘুরে আসতে পারেন। কারণ টংক আন্দোলন ও এই আন্দোলনের নেত্রী রাশমনি হাজং এর স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধটি সেখান থেকে অল্প একটু দূরে।
কালচারাল একাডেমি
বিরিশিরি কালচারাল একাডেমিতে উপজাতীয় সংস্কৃতি চর্চা করা হয়। এখানে প্রতি বছর উপজাতীয়দের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। প্রতিটি অনুষ্ঠানে বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রচুর জনসমাগম হয়।
রাণীখং মিশন
দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদ থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তরে সীমান্তে সোমেশ্বরী নদীর কোল ঘেঁষেই রানীখং মিশনটি একটি উচু পাহাড়ে অবস্থিত। ১৯১০ সালে এ রাণীখং মিশনটি স্থাপিত হয়। যেখান থেকে প্রকৃতিকে আরও নিবিড়ভাবে উপভোগ করা যায়।
কমলা রাণী দিঘী
বিরিশিরি ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই কমলা রাণী দিঘী। এই কমলা রাণী দিঘী সাগর দিঘী নামেও পরিচিত। দিঘীটি পুরোপুরি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও এর দক্ষিণ পশ্চিম পাড় এখনও কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে। ১৫ শতকের শেষ দিকে সুসং দুর্গাপুরের রাজা জানকি নাথ বিয়ে করেন কমলা দেবী নামে এক সুন্দরী নারীকে। রাণী কমলা দেবী যেমনি রূপেগুণে সুন্দরী ছিলেন তেমনি ছিলেন পরম ধার্মিক। রাজা জানকি নাথও ছিলেন পরম প্রজা হিতৈষী। রাণীর গর্ভে একপুত্র সন্তান জন্ম নেয়। পুত্রের নাম রাখা হয় রঘুনাথ। রাজা জানকি নাথ প্রজাদের মঙ্গলার্থে পানির অভাব নিবারণের জন্য একটি পুকুর খনন করেন। কিন্তু পুকুরে আর পানি উঠল না। রাজা পড়লেন মহা চিন্তায়। একরাতে রাজা স্বপ্নে দেখেন রাণী কমলা দেবী যদি পুকুরের মাঝখানে গিয়ে পূজো দেন তাহলে পুকুরে পানি উঠবে। রাণী কমলা দেবী প্রজাদের মঙ্গলার্থে পুকুরের মাঝখানে গিয়ে পূজোয় বসলেন। সহসা চারিদিক দিয়ে পানি উঠতে শুরু করল। কিন্তু রাণী আর পানি থেকে উঠে এলেননা। পানিতে একাকার হয়ে মিশে গেলেন তিনি।
থাকার জায়গা:
বিরিশিরি কালচারাল একাডেমির নিজস্ব রেস্ট হাউজ ও জেলা পরিষদ ডাক বাংলো, ওয়াইএমসিএ ও ওয়াইডব্লিউসি নামক প্রতিষ্ঠানের গেস্ট হাউজ আছে। এছাড়া উপজেলা সদরে বিভিন্ন হোটেল রয়েছে।
যোগাযোগ:
ঢাকা থেকে বাসযোগে ময়মনসিংহ, ময়মনসিংহ ভায়া শ্যামগঞ্জ বিরিশিরি অথবা ঢাকা থেকে বাসযোগে নেত্রকোণা, নেত্রকোণা থেকে বিরিশিরি। তারপর বিরিশিরি থেকে রিকশাযোগে বিভিন্ন গন্তব্য।