ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

লন্ডন

শাস্তি হিসেবে ফিরতেই হলো পূর্বপুরুষের দেশে!

সৈয়দ আনাস পাশা, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৫
শাস্তি হিসেবে ফিরতেই হলো পূর্বপুরুষের দেশে! ছবি: প্রতীকী

লন্ডন: শেষ পর্যন্ত ব্রিটেন ছাড়তেই হলো সেই ছেলেটিকে। গত বছরের ১ মে ‘তিন পুরুষ বাসের পরও ব্রিটেন ছাড়তে হচ্ছে এক বাংলাদেশিকে’ শিরোনামে বাংলানিউজে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।



এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ২৯ বছর বয়স্ক একটি ছেলে ব্রিটিশ হোম অফিসের ডিপোর্টেশনের শিকার হয়ে তিন পুরুষের বসবাস সত্ত্বেও ব্রিটেন ছাড়তে হচ্ছে এমনই একটি কাহিনী ছিল ও প্রতিবেদনে।

২০১৪ সালের ১ মে ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অনেকেই নিউজটি শেয়ার করেন এবং যার যার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন।

অনেকে দুঃশ্চিন্তা করেছেন, ছেলেটির অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। কেউ কেউ অপরাধের সঙ্গে জড়িত হওয়ার সমালোচনাও করেছেন তার।

প্রতিবেদন প্রকাশের পর এক বছরে অনেকেই মাঝে-মধ্যে ফোন করে জানতে চেয়েছেন ছেলেটির সর্বশেষ অবস্থা।

গত বছরের আগস্ট মাসে ‘অসহায়’ ছদ্মনামে (নাম-ঠিকানা প্রকাশে ছেলের মায়ের আপত্তি) ওই ছেলেটির দীর্ঘ আট বছরের সাজাভোগ শেষ হলেও গত সপ্তাহ পর্যন্ত সে আটক ছিল ব্রিটেনের একটি ডিটেনশন সেন্টারে। আদালতের রায়ে সাজাভোগ শেষে তাকে নিজ দেশে (বাংলাদেশ) ফেরত পাঠানোর নির্দেশ থাকায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ‘অসহায়’কে আটকে রাখা হয় ওই ডিটেনশন সেন্টারে।

বাংলাদেশে ছেলেটির কেউ নেই এমন কারণ দেখিয়ে দেশে ফেরত পাঠানোর আদালতের নির্দেশের বিরুদ্ধে ছেলেটির পক্ষ থেকে আপিল করা হয়। সাজা ভোগ শেষ হওয়ার পরেও তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়নি ব্রিটিশ হোম অফিস কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগে আপিল করা হয়।

তবে এক বছর ধরে লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে ‘অসহায়’ যে বাংলাদেশি নাগরিক, এ মর্মে একটি স্বীকৃতিপত্র আদায়ের বিরামহীন চেষ্টা করে ব্রিটিশ হোম অফিস।

সাজা শেষ হওয়ার পরও দীর্ঘ ১১ মাস ডিটেনশন সেন্টারে আটকে রাখার পর অবশেষে গত সপ্তাহের প্রথম দিকে হোম অফিস কর্মকর্তারা ঢাকার উদ্দেশে কুয়েত এয়ার ওয়েজের একটি ফ্লাইটে তুলে দেয় ‘অসহায়’কে।   সর্বশেষ সুনামগঞ্জে চাচার আশ্রয়ে গিয়েছে উঠেছে ভালো করে বাংলা না জানা বর্তমানে ৩০ বছর বয়সী তরুণ ‘অসহায়’।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রান্তিক জেলা সুনামগঞ্জে ‘অসহায়ে’র পূর্বপুরুষের বসবাস। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে তার দাদা প্রথম ব্রিটেন আসেন। এরপর একে একে আসেন দাদি, বাবা, চাচা ও ফুফুসহ সবাই।   ব্রিটেনেই এখন ‘অসহায়’-এর একান্নবর্তী পরিবারের বসবাস।

১৯৮৯ সালে চার বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে প্রথম ব্রিটেন আসে ‘অসহায়’। এরপর হাঁটি হাঁটি পা করে ৩০ বছরে পদার্পন করে সে। কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণের মুহূর্তে ‘অসহায়’ জড়িয়ে পড়ে কিছু বখে যাওয়া ছেলের সঙ্গে। এর পরিণতি আজ ভোগ করছে সে।

আট বছরের সাজা নিয়ে কারাগারে যাওয়ার কিছুদিন পরই একমাত্র ছেলের চিন্তায় রোগ-শোকে মারা যান  ‘অসহায়ে’র বাবা। সেই থেকে বিধবা মা-ই নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন কারাগারে অন্তরীণ ছেলের।

একমাত্র ছেলের ভবিষ্যত এখন অনিশ্চিত। সবাইকে ছেড়ে দেশে ফিরে যেতে হলো, এ চিন্তায় মাও এখন অনেকটা শয্যাশায়ী।

চার বছর বয়সে ব্রিটেনে আসা ‘অসহায়’ ভালো করে বাংলাও বলতে পারতো না। দেশে ফিরে যাওয়ার পর ‘অসহায়’-এর মায়ের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি আবারও তার ছেলে ‘পরিস্থিতির শিকার’ বলে দাবি করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, যে ঘটনায় আমার ছেলেকে শাস্তিভোগ শেষে দেশে ফিরে যেতে হলো, সেই ঘটনার সঙ্গে সে জড়িত ছিল না। একটি পাকিস্তানি ছেলে আরেকটি বাংলাদেশি ছেলেকে মারধর করলে এর প্রতিশোধ হিসেবে বাংলাদেশি ছেলেটি আরেকদিন ওই পাকিস্তানি ছেলেটিকে বাগে পেয়ে তার বাসায় ধরে এনে মারধর করে।

ওই বাংলাদেশি ছেলেটির সঙ্গে আমার ছেলের বন্ধুত্ব। পাকিস্তানি ছেলেটিকে আটকে রেখে বাংলাদেশি ছেলেটি আমার ছেলে ও তার আরেক বন্ধুকে ফোনে তার বাসায় যাওয়ায় অনুরোধ করলে তারা ওই বাংলাদেশি ছেলেটির বাসায় যায়।

আর এর কিছুক্ষণ পরেই পুলিশ অভিযান চালায়। বাংলাদেশি ছেলেটি পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও বন্ধুসহ আমার ছেলেটি পুলিশের হাতে আটক হয়। এরপর পাকিস্তানি ছেলেটির অপহরণের সব দোষ ঘাড়ে চাপে আমার ছেলে ও তার বন্ধুর ওপর।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ওই সব অপকর্মের মূল হোতারা আজ মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে; আর আমার সহজ-সরল ছেলেটি শুধু শাস্তিই ভোগ করেনি, দেশেও ফিরে যেতে হলো।

তিনি বলেন, আমার তো আর কারো কাছে বিচার চাওয়ার নেই। সৃষ্টিকর্তার কাছেই শুধু চাইছি, আমার ছেলেটি যেন ভালো থাকে। আবার যেন সে তার সেই হাসিখুশি জীবনে ফিরে আসে।

ব্রিটেনের হোম সেক্রেটারি থেরেসা মে’ প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে ‘অসহায়’-এর মা সিলেটি ভাষায় বলেন,  ‘যত কড়া কড়া আইন ওই বেটি বুলে করছে, তাইর ওই আইনর লাগি আমার পুয়া আজ আমরারে ছাড়িয়া যাইতে হইলো। আল্লাহ-ই তাইর বিছার করবো’’ (যত কঠিন কঠিন আইন ওই নারীই করেছে। তার ওই আইনের কারণেই আমার ছেলেকে আজ আমাদের ছেড়ে যেতে হলো। আল্লাহ ওই নারীর বিচার করবে)।  

তিনি বলেন, ছেলেটি আমার ভালো করে বাংলাও বলতে পারে না। দেশে এক চাচার কাছে গিয়ে উঠেছে। কিন্তু কীভাবে সে যে কী করবে, আল্লাহই জানেন!

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৫
এবি/

** তিন পুরুষ বাসের পরও ব্রিটেন ছাড়তে হচ্ছে এক বাংলাদেশিকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

লন্ডন এর সর্বশেষ

welcome-ad