ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়ায় পাসপোর্ট জিম্মি করে শিক্ষা ব্যবসা টিএমসির

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৪
মালয়েশিয়ায় পাসপোর্ট জিম্মি করে শিক্ষা ব্যবসা টিএমসির

মালয়েশিয়া থেকে ফিরে: বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের কষ্টসাধ্য অর্থে গড়ে উঠেছে মালয়েশিয়ার কলেজ টিএমসি। মিথ্যা প্রলোভনে শিক্ষার্থীদের কলেজে ভর্তি করিয়ে পাসপোর্ট আটকে রাখে কলেজটি।

সেমিস্টার ফি জমা দেওয়ার আগে ফেরত দেওয়া হয় না পাসপোর্ট। বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীরা ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ উপায়ে কাজ যোগাড় করে। আর এভাবেই তারা সেমিস্টার ফি জমা দিলেই ফেরত পায় ভিসাসহ পাসপোর্ট।
 
কুয়ালালামপুরে ভিভা শপিং মলের পাশ ঘেঁষে ৮৫ জালান লোক ভিউতে মেনারা উনচাং এমাস (ইউই৩) বিল্ডিং এর মাঝে জায়গা পেয়েছে কলেজটির ক্যাম্পাস।  
 
সম্প্রতি সরজমিন টিএমসি কলেজ ঘুরে  দেখা যায়, এখানে প্রায় ৮৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রীই বাংলাদেশি। প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশ থেকে ৫০ থেকে ৬০ জন শিক্ষার্থী প্রতারণা ও ঝুঁকির বিভিন্ন পথ মাড়িয়ে টিএমসি’র শিক্ষার্থী হিসেবে  যুক্ত হচ্ছেন। আর একবার রেজিস্ট্রারে নাম উঠলেই হারাচ্ছেন পাসপোর্ট-ভিসা। অনেকে শিক্ষার্থীর সাইনবোর্ড লাগিয়েই কাজ করতে যাচ্ছেন মালয়েশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।  
 
কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের প্রথমেই দেওয়া হয় দুই মাসের ইংরেজি শেখার ক্লাসে। তবে সেটা নামেমাত্র ক্লাস। ক্লাসে উপস্থিতি থাকে না একদমই। আর শিক্ষকদেরও গা-ছাড়া ভাব। এই কলেজের মোটামুটি সব ছাত্রই পড়ার নামে কাজের সুযোগ নেয়। আর সেই সুযোগে শিক্ষার্থীদের আয়ের টাকায় চলে কলেজ।
 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ছাত্র বাংলানিউজের কাছে অভিযোগ করে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ছাত্রদের মালয়েশিয়া পৌঁছার পর পাসপোর্ট আটকিয়ে রাখে। অনেকের সে পাসপোর্ট পেতে চার মাস আবার কারও কারও ছয় মাসও লেগে যায়। সেমিস্টার ফি পরিশোধ করলে তা ফেরত পাওয়া যায়। আর  ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আবারও পাসপোর্ট জমা দিতে হয় শিক্ষার্থীদের। এরপর আবারো চার থেকে ছয় মাস পাসপোর্ট ছাড়া ঘুরতে হয় তাদের। আর পরের সেমিষ্টারের অর্থ জোগাতে বেছে নিতে হয় রোজগারের অবৈধ পথ।
 
পুরো প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা গড়ে উঠেছে মূলত বাংলাদেশিদের নিয়েই। বাংলাদেশি ছাড়াও রয়েছেন নেপালি অার কিছু শ্রীলঙ্কান শিক্ষার্থী। বাংলাদেশ থেকে যারা যাচ্ছে তাদের ২ ল‍াখ ৮০ হাজার থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা খরচ হয়।  

শিক্ষকরাও মনে করে এখানে বাংলাদেশিরা এসে কাজই করবে। তাই পড়াশোনার বিষয়টিও গুরুত্বহীন।
 
এদিকে বাংলাদেশকে মূল টার্গেট করে ঢাকাতে আঞ্চলিক অফিস খুলেছে কলেজ টিএমসি। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের জন্যে আঞ্চলিক অফিস ঢাকায়। এখানকার অ্যাডভাইজার এন্ড হেড অব মার্কেটিং হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন সোহেল মাসুদ।
 
এই রিপোর্ট লেখার সময় মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছিলেন সোহেল মাসুদ। তিনি শনিবার সকালে বাংলানিউজকে বলেন, ঢাকা থেকে আমরা কিছু কাগজ অনুমোদনের জন্যে পাঠাই। সেই অর্থে আঞ্চলিক অফিস বলা যাবে না। আমাদের বেশ কয়েকটি এজেন্ট রয়েছে। তারা শিক্ষার্থী জোগাড় করে।
 
বাংলাদেশে কতজন এজেন্ট রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সঠিক ভাবে জানানো যাবে না। কাগজ দেখে বলতে হবে।
 
মাসুদ জানান, কলেজটিতে , বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশনের লেকচারার হিসেবে কাজ করতেন তিনি। তবে এখন আর লেকচারার হিসেবে নেই, কলেজটির সঙ্গে কাজ করেন।
 
এ ধরনের নিম্মমানের ও অসৎ কলেজে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ভর্তি প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা এজেন্টরা জানেন। তবে এটি একেবারে খারাপ কলেজ নয়। ২০১৫ সালের জুলাইতে কলেজটির পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে আবেদন করা হবে।
 
অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের প্রলোভিত করার উপহার হিসেবে বাংলাদেশের এজেন্টরা প্রতি শিক্ষার্থীর ভর্তির বিপরীতে ৩০ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত কমিশন পায়। আর সোহেল মাসুদ পান এক লাখ টাকা পর্যন্ত।
 
কয়েকজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বলেন, বাংলাদেশ থেকে বলা হয়, মালয়েশিয়াতে গেলে সোহেল মাসুদ সহায়তা করবেন। অথচ এখানে এসে যোগাযোগ করলেও তিনি পাত্তা দেন না। বরং দুর্বব্যবহার করেন। তার সেক্রেটারি আকিবের আচরণও মারমুখী। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করেন তারা।
 
সবুজ আহমেদ (ছদ্মনাম) গত ছয় মাস আগে মালয়েশিয়ায় যান। তিনি ঢাকার লালমাটিয়ার ইউনিভার্স এডুকেশন অ্যান্ড বিজনেস কন্সাল্টেন্সি নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ করে যান টি এম সি কলেজের শিক্ষার্থী হয়ে। হোটেল ম্যানেজমেন্ট শিক্ষার নাম করে পাঠানো হলেও প্রথমেই অন্যদের মতো তাকেও দুই মাসের ইংরেজি কোর্সের জন্য দেওয়া হয়। কিন্তু সেই ইংরেজি ক্লাস হচ্ছে নামমাত্র।
 
আগামী সেমিস্টারের ফি জোগাড় করতে এবং নিজের থাকা-খাওয়ার খরচ চালানোর জন্যে বাধ্য হয়ে কাজ খুজতে হয় সবুজকে। তিনি বলেন, অনেকে পাসপোর্ট পাবার পর আর দ্বিতীয় বছর পরবর্তী সেমেস্টারে আসেন না। কারণ কষ্ট করে জমা করা টাকা, কলেজকে দিতে ইচ্ছে করে না। এ সময় পাসপোর্ট আটকিয়ে রাখে কলেজ।
 
তিনি বলেন, আমাদের চলাফেরা করতে অনেক কষ্ট হয়। পুলিশ ধরলে পাসপোর্ট ছাড়া কথা শুনতেই চায় না। অনেক ঘুষ দিয়ে এরপর মুক্তি পাওয়া যায়। এসবের মধ্য দিয়েই সেমিষ্টার শেষ হওয়ার আগেই সাড়ে সাত হাজার রিঙ্গিত আয় করতে হয় একেকজন শিক্ষার্থীকে।  
 
এভাবেই সাধারন বাংলাদেলিদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে টিএমসি কলেজ ও এর এজেন্টরা।
 
** মালয়েশিয়ায় অসৎ প্রতিষ্ঠান ‘টিএমসি কলেজ’
 
বাংলাদেশ সময় ১৪৩২ ঘন্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ