ঢাকা, শুক্রবার, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ মে ২০২৪, ০১ জিলকদ ১৪৪৫

মালয়েশিয়া

নৌকা ট্রাজেডির ইঙ্গিত

মালয়েশিয়ায় স্টুডেন্ট ভিসায় মানবপাচার

বাংলানিউজ ইনভেস্টিগেটিভ টিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০৭ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১৫
মালয়েশিয়ায় স্টুডেন্ট ভিসায় মানবপাচার

কুয়ালালামপুর থেকে ফিরে:  রমরমা চলছে স্টুডেন্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় মানবপাচার। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্টুডেন্ট ভিসায় এই পাচারের অবস্থা ২৪ মাসের মধ্যেই নৌকায় মানবপাচারের মতো পরিস্থিতিতে গিয়ে দাঁড়াবে।

পার্ট টাইম চাকরির প্রলোভনে মালয়েশিয়া আসা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা এখন দিন কাটাচ্ছে অর্ধাহারে অনাহারে। অনেকেরই ঠিকানা হয়েছে মালয়েশিয়ার ডিটেনশন ক্যাম্পগুলো।
 
মালয়েশিয়ার অলিতে-গলিতে ব্যাঙ্গের ছাতার মতোই গড়ে উঠেছে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও ইনস্টিটিউশন। যেগুলো থেকে বাংলাদেশি দালালরা স্টুডেন্ট ভিসা বের করে। দেশ থেকে শিক্ষার্থীর নামে শ্রমিক পাঠানো হয়। মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশি দালালদের এই সিন্ডিকেট এসব শ্রমিকের শিক্ষাগত যোগ্যতার ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে। আবার অনেক সময় সত্যিকারের শিক্ষার্থীরাও এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে কূল হারায়।
 
স্টুডেন্ট ভিসায় টানা এক বছর থাকা যায় মালয়েশিয়ায়। এ কারণে শ্রমিকদের এই প্রলোভন দেখিয়ে শিক্ষার্থী ক্যাটাগরিতে মালয়েশিয়ায় আনে দালালরা। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের পার্ট টাইম চাকরির প্রলোভন দিয়ে আনা হয় মালয়েশিয়ায়।
 
বাংলাদেশের শিক্ষার্থী সাজ্জাদকে পার্ট টাইম চাকরির ফাঁদে মালয়েশিয়ায় আনেন কোয়েস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ডেপুটি ডাইরেক্টর আনান্থ লাচুমানান। দেশে এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে বাংলাদেশ মালয়েশিয়া স্টাডি সেন্টার। তবে মালয়েশিয়ায় এসে কোন ধরনের পার্ট টাইম চাকরি পাননি সাজ্জাদ।
 
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় এ ধরনের বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, নৌকায় বসে থাকা অভুক্ত মানুষদের মতোই হয়ে উঠেছে এসব কলেজের ভিসা প্রসেসিং সেন্টারগুলো।

সম্প্রতি কুয়ালালামপুরের বাতু লিমায় ভিক্টোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি কলেজে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ফুটপাথ থেকে শুরু করে কলেজের ভিসা সেন্টারে শতাধিক শিক্ষার্থী। এদের ৯০ শতাংশই বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। কোটার তুলনায় অতিরিক্ত বিদেশি শিক্ষার্থীকে ভিসা দেয়ায় গত মে মাসে ব্ল্যাকলিস্টেড করা হয় কলেজটিকে। মূলত স্টুডেন্ট ভিসায় শ্রমিক আনে কলেজটি।
 
জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আসে কলেজটিতে। আর পাচারের ব্যবসা রমরমা হওয়ায় এখন কলেজে আর নামকাওয়াস্তে ক্লাসও হয় না। এ কলেজে সব মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও শ্রমিক স্টুডেন্ট ভিসায় রয়েছে বলে ধারণা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
 
কুয়ালালামপুরের লিংকন ইউনিভার্সিটি, মেলভার্ন কলেজ, লাইফ কলেজ, এডাম কলেজ, টিএমসি কলেজ, এফটিএমএস কলেজ, কলেজ গেমিলাং, অপটিমাস কলেজসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ ধরনের মানবপাচারে জড়িত রয়েছে বলে চিহ্নিত করেছে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
 
এসব কলেজের অধীনে স্টুডেন্ট ভিসায় কাজ করতে এসে বর্তমানে জেলে রয়েছে অনেক বাংলাদেশি। কারণ মালয়েশিয়া সরকারের আইন অনুযায়ী স্নাতক বা ডিপ্লোমা কোর্সের শিক্ষার্থীদের কাজের অনুমতি নেই। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজের অনুমতি দেয়া হয় শর্তশাপেক্ষে।
 
গত ১৮ জুন সানওয়ে পিরামিড এবং আশপাশের এলাকায় কর্মস্থল থেকে ১৫৪ জন শিক্ষার্থীকে আটক করে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশ।
 
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ কমিউনিটির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিনই মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন স্থানে কাজ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ছে শিক্ষার্থী ও স্টুডেন্ট ভিসায় আসা শ্রমিকরা।
 
মালয়েশিয়ায় লিংকন ইউনিভার্সিটির ছাত্র রফিকুল ইসলামের বাড়ি ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায়। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি পার্ট টাইম চাকরি করে সংসারে সাহায্য করার আশায় মালয়েশিয়া আসি। তবে এখানে এসে কাজ জোটে নির্মাণ প্রকল্পে। ভারি ভারি সব কংক্রিটের খণ্ড আর রড-সিমেন্ট বইতে হচ্ছে এখন।
 
শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করে এখন মাসে ৮০০ থেকে ১ হাজার রিঙ্গিত (১৭ হাজার থেকে ২১ হাজার টাকা) আয় করতে পারেন। এর মধ্যেই মাসে ৪০০ রিঙ্গিত করে জমা করতে হতো। কারণ বছর শেষে সাড়ে ৪ হাজার রিঙ্গিত দিয়ে ভিসা নবায়ন করতে কলেজকে টাকা দিতে হয়।
 
মাসে ৫০০ থেকে ৬০০ রিঙ্গিতে বাসা ভাড়া, খাবারের খরচ আর হাত খরচ দিয়ে আর বাড়িতে টাকা পাঠানোর স্বপ্ন বাস্তবে রুপ লাভ করেনি। নিজের উপার্জিত অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে মন চায়নি। তাই একসময় ইচ্ছে করেই আর ভিসা নবায়ন না করে রফিকুল অবৈধ হয়ে পড়েন।
 
মালয়েশিয়ায় এখন রফিকুলের মতো অবৈধ শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বিশাল। শুধু দেশের ভাবমূর্তিই বিলীন নয়, প্রবাসে এসব শিক্ষার্থীদের একসময় জেলে বন্দি হতে হচ্ছে।
 
প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ক্যারাম এশিয়ার রিজিওনাল কো-অর্ডিনেটর হারুন আল রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে স্টুডেন্ট ভিসায় শ্রমিক এবং পার্ট টাইম চাকরির লোভে শিক্ষার্থীরা আসছে এবং ধোকা খাচ্ছে। বছর দুয়েকের মধ্যেই এই স্টুডেন্ট ভিসায় আসা লোকদের অবস্থা নৌকায় পাচারকারীদের মতোই হবে। এখনই এই পাচার বন্ধ না করা গেলে ভবিষ্যতের জন্যে বিষফোঁড়া হবে।
 
শুধু পার্ট টাইম বা ফুল টাইম চাকরির প্রলভন নয়, নৌকায় আসা মানুষদের মতোই স্টুডেন্ট ভিসায় আসা লোকদেরও কিডন্যাপ করা হচ্ছে। এয়ারপোর্ট থেকে নামার পরেই তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেয়া হয়। গাড়িতে উঠিয়ে গহীন অরণ্যের গোডাউনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে মুক্তিপণ নিয়ে ছাড়া হচ্ছে তাদের।
 
শিক্ষার্থীদের অবস্থান সর্ম্পকে কুয়ালালামপুরে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার শহীদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। শুধু বৈধ শিক্ষার্থীরাই যেন পড়াশোনা করতে আসে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৭০৬ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১৫
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ