কুয়ালালামপুর থেকে ফিরে: কোনো অবৈধ অভিবাসীকে নিজ দেশে ফিরতে ৪০০ রিঙ্গিত (৮ হাজার ৪০০ টাকা) কম্পাউন্ড দিতে হয় মালয়েশিয়ান ইমিগ্রেশনে। কিন্তু বাংলাদেশিদের জন্য এ কম্পাউন্ড ১ হাজার ৪০০ রিঙ্গিত (২৯ হাজার ৪০০ টাকা)! বাংলাদেশিদের প্রতি এমন বৈষম্যের কারণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে মানবশক্তি ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট মালয়েশিয়ার বেসরকারি আইটি কোম্পানি বেসটিনেটের নাম।
সম্প্রতি দেশে ফিরছেন এমন কয়েকজন অবৈধ বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুত্রজায়া ইমিগ্রেশন অফিসে অন্য দেশের অবৈধ অভিবাসীদের তুলনায় কম্পাউন্ড হিসেবে বাংলাদেশিদের অতিরিক্ত অর্থ দিতে হচ্ছে।
রফিক (ছদ্মনাম) বাংলানিউজকে বলেন, ইমিগ্রেশন অফিসে কর্মকর্তাদের হাতে আমাদের ৪০০ রিঙ্গিত দিতে হয়। কিন্তু ইমিগ্রেশন কার্যালয়ে ঢুকেই ১ হাজার রিঙ্গিত দিয়ে কুপন নিতে হয়। কিছু পুলিশ সদস্য এই কুপন সরবরাহ করেন শুধু বাংলাদেশিদের জন্য।
সূত্রমতে, মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগসাজসে দেশটির ইমিগ্রেশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে বেসটিনেট। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসী নাগরিক ও শ্রমিকদের টার্গেট করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
একটি অনলাইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইমিগ্রেশনের এ-টু-জেড সেবা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় প্রতিষ্ঠানটি। একক দরপত্রের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ইন্দোনেশিয়া থেকে শ্রমিক আনার বিষয়টি এই অনলাইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার প্রকল্প পায় বেসটিনেট।
নেপাল ও ইন্দোনেশিয়া সরকারের আপত্তির মুখে বেসটিনেটের মালয়েশিয়ার ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এফডাব্লিউসিএমএস) এবং বায়োমেট্রিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা কার্যকর হওয়ার দুই সপ্তাহের মাথাতেই নিষেধাজ্ঞা আসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে।
এই বেসরকারি আইটি ফার্মটির একজন পরিচালক হচ্ছেন মালয়েশিয়ার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তান শ্রী আজমী খালিদ এবং শ্রম বিভাগের সাবেক পরিচালক দাতুক টেংকু ওমর টেংকু বট। আর এ কারণেই দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগে আধিপত্য বিস্তার করে আছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ায় ব্যর্থ হলেও বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসী শ্রমিকদের দেশে পাঠানোর বিষয়টি হাতিয়ে নিয়েছে এই কোম্পানি। পুত্রজায়ায় নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশিদের ওপর এ থাবা বসিয়েছে তারা।
দূতাবাসের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশি অবৈধ শ্রমিকদের এ বিষয়টি সর্ম্পকে ঢাকা অবগত। কিন্তু দূতাবাসের কিছু করার ছিল না। অনলাইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ-টু-জেড সেবা অর্থাৎ দেশে ফেরা পর্যন্ত বিষয়টি একটি অনলাইন প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করতে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেয়া হয়।
অতিরিক্ত ১ হাজার রিঙ্গিত দেয়ার কারণ হিসেবে ওই কর্মকর্তা বলেন, মোট ১ হাজার ৪০০ রিঙ্গিতের মধ্যেই অবৈধ শ্রমিকের কম্পাউন্ড ফি, প্লেনভাড়াসহ অন্যান্য খরচ অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা। তবে জানতে পেরেছি, অর্থ নিয়ে ডাটাবেজ তৈরি ছাড়া আর কোন চুক্তিই মানছে না কোম্পানিটি। অবৈধ শ্রমিকদের দেশে ফেরার জন্য প্লেন ভাড়া নিজেদেরই দিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশি অবৈধ শ্রমিক শফিকুল (ছদ্মনাম) বাংলানিউজকে বলেন, ৬ মাস জেলে ভাই খুব কষ্ট করেছি। এখানে প্রচুর মারে। মোট ৩ বার বাড়ি থেকে প্লেনভাড়া পাঠিয়েছে, প্রতিবারই দালাল মেরে দিয়েছে।
তিনি বলেন, পুত্রজায়ায় ১ হাজার ৪০০ রিঙ্গিত দিয়েও প্লেনের টিকিট আলাদা কিনতে হবে। এছাড়াও এখানকার পুলিশ ও দালালরা বিভিন্ন অযুহাতে সবসময়ই অর্থ আদায় করে।
পুত্রজায়া ইমিগ্রেশন অফিস থেকে ঘুরে আসা বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিকরা যদি প্রবেশ পথে টোকেন না নেন, তবে কাউন্টার থেকে পুনরায় ফেরৎ পাঠানো হয় তাদের। ১ হাজার রিঙ্গিত জমা দিয়েই যেতে হয় কাউন্টারে।
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কতিপয় কর্তাব্যক্তিকে হাত করে বেসটিনেট বিষয়টি এমনভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, বাংলাদেশ দূতাবাসও সেখানে কিছুটা অসহায়। মালয়েশিয়া সরকারের নিয়ম বলা হলেও প্রতারণা করছে আইটি সলিউশন কোম্পানিটি।
৪০০ রিঙ্গিতের স্থলে বাংলাদেশি নাগরিকদের ১ হাজার ৪০০ রিঙ্গিত খরচের বিষয়ে কুয়ালালামপুরে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, অনেকেই জানেন না তাই বেশি অর্থ দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, এ দেশের সরকার ভালোর জন্য কিছু নিয়ম করেছে। কিন্তু কিছু দুষ্ট লোক নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৫
এমএন/জেডএম