মালাক্কা থেকে: গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঘর-বাড়ি। বেশিরভাগই এক, দুই কি তিন তলা।
সুমাত্রান, ভারতীয় আর পশ্চিমা স্থাপত্য রীতির মিশেলে গড়া আমপাঙ হুলু মসজিদের ছাদও লাল টালির। মাল্লাকার এই মসজিদই মালয়েশিয়ার প্রথম মসজিদ। ১৭২৮ সালে ডাচ শাসনের সময়ে দাতুক শামসুদ্দিন এ মসজিদ নির্মাণ করেন।
নির্মাণকালে এর কাঠামো ছিলো কাঠের। ১৮৯২ সালে ওয়াকফ্ স্টেট হওয়ার পর কাঠের সেই মসজিদকে পাকা স্থাপত্যে রূপ দেন ওয়াজির আল ওমর হুসেইন আল আত্তাস। কয়েক স্তরে তোলা হয় চৌকোণা টালির ছাদ।
প্রচলিত গম্বুজ আর মিনার নেই হুলু মসজিদে। তাই বলে না দিলে এটা যে মসজিদ তা বুঝে ওঠা মুশকিলই বটে।
মসজিদের পশ্চিমপাশ ঘেঁষে পুরনো এক কবরস্থান। সেখানে এ এলাকার প্রখ্যাত ধর্মগুরু সৈয়দ আবদুল্লাহ আল হাদ্দাদের কবর। পূর্ব-দক্ষিণ কোণায় শুরু হেরিটেজ সিটি। সেখানে পাইকারি নিত্য-পণ্যের বাজার। কেনাকাটা সবচেয়ে জমজমাট ঝংকার স্ট্রিটে। ওই স্ট্রিটের এক রাস্তা পরই হুলু মসজিদ।
মালাক্কার অবস্থান বিখ্যাত মালাক্কা প্রণালীর পূর্ব পাড়ে। এই প্রণালী উত্তরে ভারত মহাসাগরের জাভা সাগর আর দক্ষিণে প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ চীন সাগরের বর্ধিত অংশ জাভা সাগরকে সংযুক্ত করেছে। ৮০৫ কিলোমিটার লম্বা এই প্রণালী তাই বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুট।
বর্তমান মালাক্কার আয়তন ১৬৬৪ বর্গকিলোমিটার। কিছু ছোট পাহাড় বাদে এ রাজ্য প্রধাণত নিচু ভূমি। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে গড় উচ্চতা ৫০ মিটার। রাজ্যের মাঝ বরাবর উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত মালাক্কা নদী। পূর্বে কেসাং নদী জোহরের সীমান্ত। মালাক্কার জলবায়ু উষ্ণ ও আদ্র থাকে বছর জুড়েই।
কুয়ালালামপুর থেকে এর দুরত্ব ১৪৮ কিলোমিটার। টিবিএস (টার্মিনাল বারসিপাডু সেলানাটান) থেকে মাত্র ১১ কি ১২ রিঙ্গিত (১ রিঙ্গিতে ২০ টাকা) ভাড়ায় আসা যাবে মালাক্কা সেন্ট্রালে। জানালার পাশে সিট নিলে ভাড়া একটু বেশি। ভেতরের দিকে একটু কম।
আন্তর্জাতিক বাস টার্মিনাল মালাক্কা সেন্ট্রালের ডমেস্টিক টার্মিনাল থেকে ১৭ নম্বর বাসে চড়ে একটানে আসা যাবে মালয়েশিয়ার সবচেয়ে পুরনো মসজিদ কামপাং হুলুতে। ভাড়া পড়বে মাত্র ২ রিঙ্গিত। আছে ট্যাক্সি সার্ভিসও।
মালয় উপদ্বীরে প্রথম মসজিদটি ১৭২৮ সালে নির্মাণ হলেও এখানে আরো কয়েক শতাব্দী আগেই ইসলামের প্রসার ঘটে। মালাক্কার গৌরব তাই লুকিয়ে আছে এর সমৃদ্ধ বর্ণিল অতীতে। এ শহরেই শুরু মালয়েশিয়ার ইতিহাস। মালয়েশিয়ার প্রথম শহর মালাক্কা।
ইসকান্দার শাহ নামে পরিচিত শ্রীবিজয়া সাম্রাজ্যের যুবরাজ পরমেশ্বর ১৪০০ সালে মালাক্কা সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। তার রাজ্য বিস্তৃত হয় মালয় উপদ্বীপের অধিকাংশ এবং রিয়াউ দ্বীপপুঞ্জ ও সুমাত্রা দ্বীপের পূর্ব উপকুলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, কোলা সাম্রাজ্যের অনবরত আক্রমণের মুখে দুর্বল হয়ে পড়া শ্রীবিজয়া সাম্রাজ্যের যুবরাজ পরমেশ্বর তার দেশ ইন্দোনেশিয়া ছেড়ে মালয় উপদ্বীপে আসার পর মালাক্কা নদীর মুখে এসে থামেন। বিশ্রামের জন্য বসেন একটি মালাক্কা গাছের নিচে। হঠাৎ দেখেন একটি ইঁদুরমুখো হরিণ (মাউস ডিয়ার) তার শিকারি কুকুরকে ফাঁকি দিয়ে পানিতে নেমে সটকে পড়লো। তখনই সেখানে নতুন রাজ্য গড়ার ঘোষণা দেন পরমেশ্বর। যে গাছের নিচে তিনি বিশ্রাম করছিলেন, সেই গাছের নাম অনুসারে রাজ্যের নাম রাখেন মালাক্কা। সেই মাউস ডিয়ার এখন মালাক্কার কোট অব আর্মস বা কুলচিহ্ন। তবে মালাক্কা গাছ বিলুপ্তপ্রায়।
মালাক্কায় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেই বাণিজ্য বন্দরের গোড়াপত্তন করেন ইসকান্দার শাহ। স্থানীয় অধিবাসী সাগরজীবী ওরাং লাউতদের বশ করে তিনি কাজে লাগান সংলগ্ন সাগরে টহল দেওয়ার কাজে। কয়েক বছরের মধ্যেই মালাক্কা হয়ে ওঠে ব্যবসা বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র। বিশ্বের পুরো পূর্ব অংশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে মালাক্কার খ্যাতি। আসে চীনা বণিক। তারপর আরব, ভারতীয় ও পারসিয়ানরা। তারা সবাই পৃথক বাণিজ্য বসতি গড়ে তোলো মালাক্কায়। ফলে ভারতের রেশম, মালয়েশিয়ার মসলা, টিন ও সোনা এবং চীনের চিনামাটির বাসন বাণিজ্য জমে ওঠে।
সে সময় মালাক্কাতে প্রক্রিয়াজাত হতো শুঁটকি। আর শুঁটকির জন্য যে লবণ লাগতো, তাও উৎপন্ন হতো স্থানীয়ভাবেই। সবজি, গরু ও মাছ আসতো মিত্রদের মাধ্যমে। খাওয়ার চাল হতো আমদানি। গুজরাট, মালাবার ও বেঙ্গল থেকে থেকে আসতো কাপড়। মালয় উপদ্বীপে উৎপন্ন কর্পুর, চন্দন, মসলা, মাছের ডিম ও শৈবালের খ্যাতি ছিলো বিশ্বজোড়া। চীন থেকে আসতো চীনামাটির বাসন, সিল্ক ও লোহা। প্রণালীর উভয় পাড় থেকে আসতো বনজ সম্পদ। প্রথমে টিন, পরে রূপা ও সোনার মুদ্রা প্রচলন করা হয় মালাক্কায়।
ছোট্ট জেলে গ্রাম থেকে মালাক্কা হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য। প্রসার ঘটে ইসলামী শিক্ষার। সমৃদ্ধ হতে থাকে মালয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলা।
ইসকান্দর শাহ এর ছেলে মেগাত ইসকান্দর শাহের আমলে শহরের উত্তর দিকে দু’টি টিন খনি আবিষ্কার হয়। ১৫ শতকের শুরুতেই মালাক্কা পৌঁছে যায় উন্নতির শিখরে। সাম্রাজ্য ছড়ায় উত্তরে বর্তমান থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চল, দক্ষিণে সুমাত্রার পূর্ব উপকূলের অধিকাংশ পর্যন্ত।
সে সময় ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে উত্তর-পূ্র্ব মৌসুমী বায়ুর অনুকূলে পণ্যবাহী জাহাজ আসতো পূর্বের চীন, রাইউকু, জাভা ও মালুকু দ্বীপ থেকে। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর অনুকূলে আসতো ভারতীয় উপকূল, লোহিত সাগর ও পূর্ব আফ্রিকার জাহাজ। সে সময় মালাক্কায় ছিলো ৮৪ ভাষাভাষীর মানুষ।
মালাক্কা সালতানাতের আর এক সুলতান মনসুর শাহ (১৪৫৬-১৪৭৭) ২০০ জাহাজের বহর পাঠিয়ে পাহাং এর মহারাজা দেব সুর ও তার কন্যাকে বন্দি করে নিয়ে গেলে মালাক্কা হয়ে উঠে গ্রেট মালয় সাম্রাজ্যের রাজধানী, হয়ে ওঠে মালয় দ্বীপপুঞ্জে মুসলিম তৎপরতার সদর দফতর।
যদিও লোককাহিনী বলছে, মিং সম্রাট হ্যাং লি পো কন্যা ঝেং হি ৫০০ সঙ্গীসহ মালাক্কায় আসেন। তিনি মনসুর শাহকে বিয়ে করেন। তার সঙ্গীরা স্থানীয়দের সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরে বুকিত চিনাতে বসবাস শুরু করেন। তবে ষোলো শতকের গোড়াতেই সব কিছু পাল্টে যায়। ১৫১১ সালে সুলতান মাহমুদ শাহকে বিতাড়িত করে মালাক্কার দখল নেয় পর্তুগিজরা। (চলবে)
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৬ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৬
জেডএম
** মাহাথিরের মানস সন্তান পুত্রাজায়ায়
**দেশে ফিরলেই বেকার, বিদেশের অভিজ্ঞতা বিফলে
*** দূষণে কালো হয়ে আছে কুয়ালালামপুরের জননী
***মালয়েশিয়ায় জেঁকে বসতে পারে বাংলাদেশ
***টিনঘেরা চৌহদ্দিতে ক্রীতদাস জীবন!
***লজ্জা নয় ওরা অহংকার
***মেডিকেল ট্যুরিজমের পালে হাওয়া মালয়েশিয়ায়
*** বাংলাদেশি পরিচয়েই যতো লজ্জা!
***এক ঋতুর দেশে
**বাংলাদেশি আবহে জাঁকিয়ে বসেছে হোটেল মার্ক
**অন টাইমে রিজেন্টে উড়ে মালয় দ্বীপে
**মালয়েশিয়া থেকে খবর দিচ্ছেন বাংলানিউজের জাকারিয়া মণ্ডল